ইদানীং লেখালিখি বা আলোচনার পরিমণ্ডলে একটা আক্ষেপ শোনা যায়, রাজ্যটা একেবারে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। সরকার যে ভাবে দুর্নীতিকে মান্যতা দিচ্ছে, তা দেখে পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠাটাই একটা চ্যালেঞ্জ। এই বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবু কিছু প্রশ্ন ওঠে, সেগুলো সরাসরি তোলাও দরকার।
আমরা নিজেরাই যখন পরিস্থিতিটা জানি, তখন শুধু আক্ষেপ না করে নিজেদের কি প্রশ্ন করতে পারি না— এই দুর্দশার দায় কাদের? সহজ উত্তর হতে পারে, শাসক দলের। আমাদের মাস্টারমশাইরা হলে এই উত্তরে দশে চার-পাঁচের বেশি দিতেনই না। বলতেন, এই উত্তর সম্পূর্ণত সত্য নয়, আসলে এই উত্তর নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা ভাবছি যে সব দায় অপরপক্ষের। আমাদেরও যে কোনও দায় আছে, বা থাকতে পারে, সেটা আমরা ভাবিনি।
আগে দুর্গাপুজোয় একটা সংহতির, মৈত্রীর বাতাবরণ থাকত। পুজো আয়োজন করতেন পাড়ার কিছু মানুষ বা কোনও ক্লাব। বড় পুজোগুলো এখনকার মতো রাজনৈতিক নেতাদের নামে হয়ে ওঠেনি— কেউ বলত না এটা অমুকদার পুজো, ওটা তমুকদার। সকালে খবরের কাগজ খুললে যে সব রাজনৈতিক চরিত্রের পাতাজোড়া ছবি দেখা যায় তাদের অধিকাংশের গায়েই লেপ্টে রয়েছে অপরাধী আর অভিযুক্তের তকমা। যারা সবে খবরের কাগজ পড়তে শিখছে, তারা কাদের ছবি দেখে বড় হচ্ছে? বড় হয়ে ওঠার পথে কাদের মনে করছে আদর্শ? বঙ্গসমাজে একদা মনীষীদের তুলে ধরা হত আদর্শ হিসাবে, তাঁরা মনীষী হয়ে উঠতেন শিক্ষা, জ্ঞান, লোকব্যবহার, সামাজিক কৃতির গুণে। আজকের সমাজে এই মুহূর্তে এমন মনীষী কারা, ক’জন? একটা প্রজন্ম বড় হচ্ছে প্রচারমাধ্যমে মুখ্যত অপরাধীদের ছবি দেখে, নিজেদের জীবন তারা কোন আলোয় আলোকিত করবে?
সমাজে যখন ঘুণ ধরে তখন শিল্প-সংস্কৃতিই তাকে পথ দেখায়, অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। এই অন্ধকার ভিতরের অন্ধকার, এই আলো অন্তরের আলো। শিল্প-সংস্কৃতির যে কোনও অনুষ্ঠান মানেই অন্ধকার থেকে আলোয় আসার উদ্যাপন। সেখানেও যদি ক্ষমতার অলিন্দে চরে বেড়ানো রাজনৈতিক মুখগুলোকেই আমরা টেনে নিয়ে আসি, সে কি আমাদের নিজেদের অপারগতারই প্রমাণ নয়? বই বা পত্রিকা প্রকাশের অনুষ্ঠানে, প্রায়ই কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অবাক করে রাজনৈতিক মুখের বহুল উপস্থিতি, বিশেষত যে মুখগুলোর সঙ্গে সংস্কৃতির দূরতম যোগও সুদূরপরাহত। আমাদের তো কেউ বাধ্য করেনি তাদের ডাকতে। না কি সংস্কৃতি-জগতে সর্বজনমান্য কেউ নেই বলেই এই ‘সহজ’ পথের অনুসন্ধান!
এ এক মহা আশঙ্কার ব্যাপার। পৃথিবী জুড়েই এখন দক্ষিণপন্থী-চরমপন্থীদের দাপাদাপি। এরা শাসনক্ষমতায় এসে একে একে সব কিছুতে মাথা গলাতে চায়, ‘নিজেদের লোক’ বসাতে চায়। সংস্কৃতির অঙ্গন নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা আগে খুব একটা মাথা ঘামাতেন না— তার প্রধান কারণ এই জগৎ সম্পর্কে তাঁদের স্বল্প জ্ঞান বা অজ্ঞতা; সেই সঙ্গে এই ধারণাও যে, সংস্কৃতি শুধু অল্প সংখ্যক মানুষের জন্য, যাঁদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতিতে ভোটবাক্সে ইতরবিশেষ ঘটে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য লেখক, কবি, চিন্তাশীল মানুষদেরও পাশে পাওয়া প্রয়োজন, এটা বুঝেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দেশ জুড়ে তৈরি করিয়েছিলেন নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন, যেমন ন্যাশনাল ফোরাম অব রাইটারস, ন্যাশনাল ফোরাম অব ডক্টরস, এঞ্জিনিয়ারস, টিচারস ইত্যাদি— যেগুলির মুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ছিলেন না। ব্যাপারটা খুব একটা দানা বাঁধেনি, সাতাত্তরে ভোটে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের সঙ্গে এই প্রয়াসের বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু সেই সময়েও অনেক প্রধান লেখক কবি এই প্রয়াসে যোগ দেননি, এতে পরোক্ষ রাজনৈতিক মদত আছে ভেবে। জর্জ বুশও ইরাক আক্রমণে সমর্থন পেতে লেখকদের পাশে চেয়েছিলেন। আমরা এখন, এখানে যেটা করে চলেছি সেটা ঠিক এর উল্টো: আমরাই রাজনৈতিক মুখদের চাইছি আমাদের কাজে, আমাদের পাশে। আত্মবিশ্বাসের কতটা অভাব হলে সৃষ্টিশীল মানুষকেও রাজনীতিকদের মুখাপেক্ষী হতে হয়? এ কি স্রেফ একটু ‘প্রসাদ’ পাওয়ার জন্য!
যাদের কোনও বৌদ্ধিক অতীত নেই, তাদেরকেই সংস্কৃতির মুখ করে তোলার ফল চোখের সামনে। রাজনীতি ও সংস্কৃতি জগতের মুখের পার্থক্য থাকছে না। সংস্কৃতি-জগৎ হয়ে যাচ্ছে রাজনীতির জগৎ, দলের লোকেরা সংস্কৃতির লোক। আর তাদের ডেকে নিয়ে আসছি আমরাই। আগে লোকে রাজনীতি করত একটা আদর্শের জায়গা থেকে, এখন আদর্শের বদলে এসেছে দুর্নীতি। সংস্কৃতি-জগতের মানুষেরা কি তা হলে দুর্নীতিকেই সমর্থন করতে চাইছেন? আর আমরা শুধুই মেনে নিচ্ছি? তা হলে আর আমাদের আক্ষেপ কেন। আমরাও যে সমান দায়ী!
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)