E-Paper

সঙ্গীত-সাম্রাজ্যের রাজা

বিশাল জমিদারি সামলানোর পাশাপাশি তাঁর চর্চার বিষয় সঙ্গীত ও সঙ্গীততত্ত্ব। ভারতীয় সঙ্গীতকে বঙ্গদেশে প্রচারের বিষয়ে তত দিনে তিনি অগ্রণী ভূমিকায়। ১৮৭১-এর ৩ অগস্ট, ক্যালকাটা নর্মাল স্কুল-পরিসরে শুরু করেছেন ভারতের প্রথম আধুনিক সঙ্গীত বিদ্যালয় ‘বেঙ্গল মিউজ়িক স্কুল’।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩৫

ডিসেম্বর, ১৮৭৫। দীর্ঘ এগারো মাসের সফরে ভারতের একুশটি শহর সরেজমিনে দেখতে লন্ডন থেকে কলকাতা এলেন যুবরাজ আলবার্ট এডওয়ার্ড, ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’। কলকাতায় তাঁর আহ্বায়ক কমিটির পৌরোহিত্যে পাথুরিয়াঘাটার ‘রাজাবাহাদুর’ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। বিরাট সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন হল পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া ভিলায়, ব্রিটিশ গার্ডেন পার্টির আদলে। যুবরাজকে স্বাগত জানানো হল ‘গড সেভ দ্য গ্রেশাস কুইন’ পরিবেশনে। বাংলায় ‘স্বাগতম গীত’ লিখলেন যতীন্দ্রমোহন, ‘এসো এসো হে কুমার যুবরাজ, মঙ্গল আবাহন গান করে সবে আজ।’ পশ্চিমি অর্কেস্ট্রার আদলে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের ঐকতান-বাদনে অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হল। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় ন্যাসতরঙ্গ বাজিয়ে শোনালেন, নৃত্য পরিবেশন করলেন এক দল তরুণী। সমগ্র সঙ্গীত আয়োজন ও পরিকল্পনার নেপথ্যে রইলেন যতীন্দ্রমোহনের অনুজ শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (ছবি)।

পাথুরিয়াঘাটার ‘ছোট রাজা’ হিসেবে শৌরীন্দ্রমোহন তত দিনে আদৃত। বিশাল জমিদারি সামলানোর পাশাপাশি তাঁর চর্চার বিষয় সঙ্গীত ও সঙ্গীততত্ত্ব। ভারতীয় সঙ্গীতকে বঙ্গদেশে প্রচারের বিষয়ে তত দিনে তিনি অগ্রণী ভূমিকায়। ১৮৭১-এর ৩ অগস্ট, ক্যালকাটা নর্মাল স্কুল-পরিসরে শুরু করেছেন ভারতের প্রথম আধুনিক সঙ্গীত বিদ্যালয় ‘বেঙ্গল মিউজ়িক স্কুল’। সেখানে তাঁর গুরু ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর তত্ত্বাবধানে কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীতের ক্লাস চলছে রমরমিয়ে। জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ক প্রস্তাব থেকে শুরু করে একে একে প্রকাশ করছেন সেতার শেখার বই যন্ত্র-ক্ষেত্র-দীপিকা, পাখোয়াজ শেখার বই মৃদঙ্গ মঞ্জরী, হারমোনিয়াম শিক্ষা-বিষয়ক হারমোনিয়াম সূত্র। যুবরাজের ভারতে পদার্পণের অব্যবহিত আগেই প্রকাশ করেছিলেন তাঁর সঙ্গীতজীবনের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বই, হিন্দু মিউজ়িক এবং যন্ত্রকোষ। মহারানি ভিক্টোরিয়াকে উৎসর্গ করে লেখেন ভিক্টোরিয়া গীতিকা ও ভিক্টোরিয়া গীতিমালা, এবং তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে উৎসর্গ করে আরও দু’টি বই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশগুলির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সংস্কৃত কাব্যের আকারে প্রকাশ করেন ভিক্টোরিয়া সাম্রাজ্য নামে।

যে ‘রাজভক্তিদীপ্ত মন’গুলি সে দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন, তাঁদের বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির প্রদর্শন। বিশেষত সেই প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতের, যা শুধু পাশ্চাত্যসঙ্গীতের মতো শ্রুতিমধুর ও বৈজ্ঞানিকই নয়, যা অনায়াসে গ্রহণও করতে পারে পাশ্চাত্যকে। এই প্রদর্শন আসলে ছিল পশ্চিমের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইতিহাস।

খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই বইগুলিতে শৌরীন্দ্রমোহন এক দিকে যেমন ভিক্টোরিয়াকে মা ও নিজেকে তাঁর অনুগত সন্তান বললেন, তেমনই বইয়ের প্রতিটি ছত্রে প্রচার করলেন তাঁর দেশের সঙ্গীতের কথা। ভারতীয় রাগ-রাগিণীতে ও তালে, কখনও সংস্কৃতে কখনও বাংলায় গান বেঁধে এক দিকে মহারানির জয়ধ্বনি করেছেন, একই সঙ্গে ইউরোপীয় স্টাফ নোটেশনে স্বরলিপিবদ্ধ করেছেন ভারতীয় সঙ্গীতের তত্ত্ব, রাগ-রাগিণীর ক্রমবিকাশের ইতিহাস— যাতে বিশ্বের সঙ্গীতবেত্তারা তার স্বরূপ জানতে পারেন, তার রসাস্বাদন করতে পারেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হতে শৌরীন্দ্রমোহন যুবরাজের হাতে তুলে দেন সদ্যপ্রকাশিত সিক্স প্রিন্সিপাল রাগস বইটি। কবিতায়, গানে, ছবিতে তাতে ফুটে ওঠে ছয়টি রাগের ভাষ্যরূপ, দৃশ্যরূপ, শব্দ-রূপ। ঋতুচক্রের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক তুলে ধরতে প্রতিটি রাগে বন্দিশের আদলে সংস্কৃতে বাঁধলেন আলাদা ছ’টি গান, স্বরলিপিবদ্ধ করলেন তার। স্থান পেল দরবারি রাগমালা-চিত্রের অনুকরণে আধুনিক রাগ-চিত্র। মহারানির সিংহাসন আরোহণের দশম বর্ষপূর্তিতে, ছয় রাগ ও ছত্রিশ রাগিণী বইটি তিনি উৎসর্গ করেন স্বয়ং রানিকে। ভারতীয় সঙ্গীতের গৌরব বিশ্বে তুলে ধরার যে ব্রত নিয়েছিলেন, তা যেন সম্পূর্ণতা পেল। ভারতীয় সঙ্গীতও প্রাচীন সঙ্গীত-সংস্কৃতির পদবাচ্য, বিশ্বে তার বার্তাবাহক হিসেবে লেখা হয়ে রইল শৌরীন্দ্রমোহনের নাম।

হিন্দু কলেজেই বিদ্যার পাঠ নিয়েছেন। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর কাছে আধুনিক যুগের আশীর্বাদ। শৌরীন্দ্রমোহন কখনও বাংলার বাইরে যাননি, পাথুরিয়াঘাটার টেগোর প্যালেস থেকেই চলেছে তাঁর সমগ্র কর্মকাণ্ড। বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে ভারতীয় সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র ও স্বরচিত বই পাঠিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্ব ও ভারতের সাংস্কৃতিক সেতু। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিয়োপোল্ডকে উপহার দেন ৯৮টি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র ও সেই বিষয়ক কিছু বই, যা আজ ব্রাসেলসের জাদুঘরের সম্পদ। পাঠিয়েছিলেন তাঁর সমসাময়িক সঙ্গীততাত্ত্বিক— ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, কালীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, লোকনাথ ঘোষ প্রমুখের বইও। এই সূত্রেই বিশ শতকে আধুনিক সঙ্গীতযন্ত্র-বিজ্ঞানের প্রবর্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান তিনি।

১৮৮০ সালে ‘কম্প্যানিয়ন অব ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ ও ‘রাজা’ খেতাবে ভূষিত হন; ১৮৮৪-তে ব্রিটিশ সরকারের নাইটহুড, ১৮৯৬-এ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা। মনোজগতে হয়ে উঠেছিলেন সঙ্গীতবিশ্বের একাধিপতি। জীবনের অন্তিম পর্বে, সব উপাধি আর খেতাব নিজের বইয়ে ব্রিটিশ রাজমুকুটের আকারে ছেপেছিলেন নিজেই, প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রজা হলেও, স্ব-কল্পনায় তিনি সঙ্গীত-সাম্রাজ্যের রাজা!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

music lyricist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy