E-Paper

বাঁচার পথ বেলেম দেখাবে কি

দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আরও বেশি সুর চড়িয়েছেন। কিন্তু সেখানেই আশার আলো দেখছেন সিওপি প্রধান।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:১৫

অদ্ভুত এক আঁধারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে পৃথিবী। এক দিকে নানা প্রান্তে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্বে গড়ে প্রতি দশ জনের মধ্যে ন’জন আক্রান্ত। অন্য দিকে, সেই ধাক্কা সামলাতে যা করা উচিত, তার চেয়ে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে উন্নত দেশগুলি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী, সে আলোচনায় ঢোকার আগে একটু পরিপ্রেক্ষিতটা বোঝা প্রয়োজন।

২০০৯ সাল, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে বসেছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। উষ্ণায়ন, হিমালয়ের বরফ গলে যাওয়া থেকে শুরু করে আবহাওয়া পরিবর্তনের নানা সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টের সুবাদে সেই প্রথম হেডলাইনে জলবায়ু সম্মেলন। এই আবহে কোপেনহেগেন শহরের মাঝামাঝি মেট্রো স্টেশন বেলা সেন্টারের গা-ছোঁয়া বিশাল সম্মেলন স্থানের সামনের রাস্তায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের বিশালাকার হোর্ডিং আর কয়েকশো মিটার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা চিমনির সারি থেকে বেরোচ্ছে অনর্গল দূষিত ধোঁয়া। মনে হয়েছিল, এই ভাবের ঘরে চুরি করে আলোচনা কি সত্যি সত্যিই এগোতে পারবে?

দীর্ঘ পনেরো বছর একের পর এক জলবায়ু সম্মেলনে কয়লা, তেল, গ্যাস নিয়ে কুৎসিত দরাদরি এবং পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির পিছনে উন্নত দেশগুলির ঐতিহাসিক দায়িত্ব এড়ানোর প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে এই প্রশ্ন ক্রমেই দীর্ঘায়িত হয়েছে। কিন্তু আগামী নভেম্বরে ব্রাজ়িলের বেলেম শহরে যে পরিস্থিতিতে কনফারেন্স অব পার্টিজ়-এর ৩০তম অধিবেশন বসতে চলেছে, তার তুলনীয় পরিস্থিতি বোধ হয় বিরল। জলবায়ু পরিবর্তন বিরোধী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় বার আমেরিকার মসনদে বসা এবং পৃথিবী জুড়ে একের পর এক যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমেরিকার শুল্ক-রাজনীতি বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু আলোচনাকে শুধু পিছিয়েই দেয়নি, তার বিশ্বাসযোগ্যতাকেও তলানিতে ঠেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, আদৌ কি এই আলোচনা পৃথিবীকে কোনও সদর্থক দিশা দেখাতে পারবে? পরিস্থিতি কঠিন। প্যারিস সম্মেলনে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক্-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখার কথা হলেও গত বছরের অধিকাংশ সময়ে সেই সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।

জলবায়ু সম্মেলনগুলি একেবারে নিষ্ফলা নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্যারিসে সব দেশের কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার, গ্লাসগোতে বড় দেশগুলোর নেট জ়িরো, অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণকে শূন্যে আনার সিদ্ধান্ত, দুবাইতে ২০৫০ সাল থেকে কয়লা, তেল এবং গ্যাসের ব্যবহার একেবারে বন্ধ করা এবং বাকুতে শেষ সম্মেলনে উন্নত দেশগুলির উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলিকে সাহায্যের পরিমাণ ২০৩৫ সাল থেকে বাৎসরিক ৩০০ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ আনুমানিক সাতাশ লক্ষ কোটি টাকা করার অঙ্গীকার। অবশ্য এই টাকা যে নেহাতই অকিঞ্চিৎকর তা বোঝা যায়— ভারতের সুন্দরবনে তিন বছরের মধ্যে শুধুমাত্র বুলবুল, আমপান আর ইয়াসে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা।

একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়, এই আপাত ভাল সিদ্ধান্তগুলি মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলির দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের দিকে তাকিয়ে নেওয়া। রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু আলোচনা যে সঙ্কটের মুখে, তা স্বীকার করছেন সিওপি৩০-এর প্রধান আন্দ্রে কোরিয়া দা লাগো। দীর্ঘ দিনের জলবায়ু কূটনীতিক বললেন, ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুলার সঙ্গে বসে কী ভাবে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। দশ বছর আগে প্যারিস সম্মেলনে যে পরিস্থিতি ছিল, তার চেয়ে খানিকটা ভাল হলেও এখনও যে তা অনেকটাই চিন্তার, সন্দেহ নেই। সিওপি প্রধান বলছেন, বিভিন্ন দেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ আরও বেশি মাত্রায় কমানো এবং ইতিমধ্যেই নেওয়া সিদ্ধান্তগুলিকে কার্যকর করা জরুরি। তিনি জানাচ্ছেন, এই উদ্দেশ্যে বেলেম-এ প্রায় তিনশোটি মিটিং হবে শক্তির ব্যবহার, বনাঞ্চল, শহর, কৃষি, মানুষ এবং আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে। জলবায়ু সঙ্কট সামলাতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, তার দিগ্‌নির্দেশ করতে তৈরি ‘বাকু থেকে বেলেম’ রিপোর্ট আগামী সম্মেলনে পেশ হতে চলেছে।

প্রশ্ন হল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুঘলকি রাজত্বে আদৌ কি তা সম্ভব? দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আরও বেশি সুর চড়িয়েছেন। কিন্তু সেখানেই আশার আলো দেখছেন সিওপি প্রধান। তাঁর মতে, এ বারে ট্রাম্পের আরও বেশি বিরোধিতার কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বাজার ক্রমেই তেজি হচ্ছে। এই নয়া জলবায়ু বাজারের সঙ্গে যুদ্ধে ট্রাম্পের জেতা মুশকিল। কিন্তু টানাপড়েন অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী? কী ভবিষ্যৎ ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে? ভারত ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত মৃত্যু এবং আর্থিক ধাক্কার নিরিখে পৃথিবীতে প্রথম সারিতে। এ বছরেও ঘটে চলেছে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি সংযোগ দেখছেন বিজ্ঞানীরা। পরিসংখ্যান বলছে, এমনটা চলতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গ আগামী তিন দশকের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন অঞ্চলগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে চলে আসবে।

বেলেম যদি ঘুরে দাঁড়ানোর সম্মেলন না হয়, যদি বিভিন্ন দেশের নেতৃত্ব পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে বোড়ে চালাচালি বন্ধ না করেন, তবে তার অভিঘাত যে তীব্রতর এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে চলেছে সুন্দরবনের মতো বিপন্ন অঞ্চলগুলির জন্য, তা সহজবোধ্য।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Climate Crisis Climate Change

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy