Advertisement
০৯ মে ২০২৪
Scoop & Jigna Vora

অদৃশ্য অস্বস্তিটা থেকে গেল, পিঠে ফুটছে কাঁটার মতো

দেখতে দেখতে কোথাও একটা অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, জবাবের চেয়ে অনেক বেশি করে একটা প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে— এই তা হলে সাহসী সাংবাদিকতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণাম?

Web Series Scoop

এক আশ্চর্য কোলাজ। এক অস্বস্তির কোলাজ। জিগনা ভোরা (বাঁ দিকে)। ‘স্কুপ’ সিরিজ়ে তাঁর চরিত্রাভিনেত্রী করিশ্মা তন্না (ডান দিকে)। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২৩ ০৮:১৩
Share: Save:

খানিক নস্টালজিয়া, খানিক পুরনো জীবনের অলিগলিতে ঘুরে আসা, খানিক স্মৃতিচারণ, খানিক ফিরে-দেখা, খানিক ভাল লাগা। খানিক ভালবাসা। ওয়েব সিরিজ় ‘স্কুপ’ দেখতে গিয়ে এমন কত রঙের রামধনু যে উঠল মনের আকাশে!

অধুনা প্রাক্তন সাংবাদিক জিগনা ভোরার জীবনের কঠিনতম সময়ের বিবরণী ‘বিহাইন্ড বার্‌স ইন বাইকুল্লা: মাই ডেজ় ইন প্রিজ়ন’ অবলম্বনে তৈরি সিরিজ় চোখের সামনে বিভিন্ন স্লাইডের এক আশ্চর্য কোলাজ তৈরি করে দিয়ে গেল।

সাংবাদিকের জীবন, তার পরিপার্শ্ব, সহকর্মীদের একাংশের অসূয়া এবং পেশাগত ঈর্ষা (কখনও কখনও সে ঈর্ষা একেবারে নিষ্কাম। অর্থাৎ, অকারণ), রোজ নিজেকে প্রমাণের অনন্ত দৌড়, নিজের লেখা খবরটাই যে সেরা এবং সেটাই প্রথম পাতায় সসম্মানে যাওয়া উচিত— সেটা প্রাণপণে সম্পাদককে বোঝানোর চেষ্টা (আসলে নিজের খবরের বিপণন), সেই উদ্যোগে কখনও সাফল্য কখনও ব্যর্থতা, খবরের সূত্রকে কতটা বিশ্বাস করব বা কতটা অবিশ্বাস— সেই লক্ষ্মণরেখা নিজের মধ্যে তৈরি করা, পারলে আধিকারিকের ফাইল থেকে নথিপত্র চুরি করে নিয়ে ফটোকপি করে আবার ‘কেমন দিলাম’ ভাব করে সেটা তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং তাঁর ভোম্বল মুখ দেখে অসীম তৃপ্তি পাওয়া— সমস্ত ফিরে ফিরে এল।

ফিরে এল সময়ে সময়ে রাজনীতিকের শীতল চাহনি, প্রকাশ্য কটাক্ষ বা কখনও-সখনও সরাসরি ধমক (গোত্রান্তরে হুমকি), পারলে তাঁদের সর্বসমক্ষে পাল্টা দেওয়া, সেলিব্রিটি নায়ক-নায়িকার পিছনে জানকবুল করে লেগে থাকা, যদি একটা ‘খবর’ হয়! ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ‘এক্সক্লুসিভ’-এর মায়াবী হাতছানির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী কাগজের সাংবাদিককে ‘ডজ’ করে বেরিয়ে যাওয়া (মাঝেমধ্যে নিজেও ‘গোল’ খাওয়া), কোনও দিন তুঙ্গ সাফল্যে কলার তুলে ‘বিট’-এ যাওয়া, কোনও দিন বিফলতায় প্রতিপক্ষের কাছে মার এবং অফিসে ঝাড় খেয়ে মুখ লুকোনো, পুলিশের ছোট-বড়-মেজো কর্তা বা নবীন আমলার ঘরের বাইরে দিনভর হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও দরজা খোলাতে না-পারার হতাশা, তার পরে মনে মনে নিজেকে ঝাঁকুনি-টাকুনি দিয়ে সেই অপ্রাপ্তি ঝেড়ে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে আবার ঝাঁপানো— ১৯৯০ থেকে অদ্যাবধি তেত্রিশ বছরের পেশাগত জীবনের তেত্রিশ কোটি মুহূর্ত বাঁধ ভেঙে হুড়মুড়িয়ে এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কোথায়!

মুম্বইয়ে জ্যোতির্ময় দে (ইনসেটে) খুনের পরই বদলে যায় আর এক ক্রাইম রিপোর্টার জিগনা ভোরার জীবন।

মুম্বইয়ে জ্যোতির্ময় দে (ইনসেটে) খুনের পরই বদলে যায় আর এক ক্রাইম রিপোর্টার জিগনা ভোরার জীবন। —ফাইল চিত্র।

ঠিকই। বাইলাইন, সোর্স, নিউজ় পেগ, নিউজ় লিড, অফ দ্য রেকর্ড, অন রেকর্ড, কোট-আনকোট, স্টোরি, কপি ব্রিফিং, পেজ ওয়ান, স্কুপ, এক্সক্লুসিভ, ডেডলাইন, ডেটলাইন শব্দগুলো মিলেমিশে পেশাদার সাংবাদিকের মাথার মধ্যে এক আশ্চর্য ঝাঁঝালো ককটেল তৈরি করে দেয়। যার নিত্য এবং নিয়ত সেবনে নেশাড়ুর মতো, মাদকাসক্তের মতো একটা ঝিমঝিমে ভাব আসে। সেই নেশাগ্রস্ততাই নিরন্তর ছুটিয়ে মারে পেশাদার সাংবাদিককে।

তবে কী জানেন, নেটফ্লিক্সে ছ’এপিসোডের এই সিরিজ় এক ঝটকায় সমস্ত দরজা হাট করে খুলে দিল ঠিকই, কিন্তু সব ছাপিয়ে কোথাও একটা অস্বস্তিও তৈরি হল। কোথাও একটা অদৃশ্য কাঁটা খচখচ করছে! করছেই।

‘দ্য এশিয়ান এজ’ পত্রিকার ডেপুটি ব্যুরো চিফ ছিলেন জিগনা (ওয়েব সিরিজ়ে তাঁর নাম ‘জাগ্রুতি পাঠক’। লেখায় চরিত্রের নামটাই ব্যবহার করছি। কারণ, এই লেখা সিরিজ়ের কাহিনির উপর ভিত্তি করেই)। আদালত সংবাদদাতা হিসেবে কেরিয়ার শুরু। পরে অপরাধের তদন্তমূলক সাংবাদিকতায় আসা। পরিভাষায় যাকে বলে ‘ক্রাইম রিপোর্টিং’। মারকাটারি পেশাদার। দাপুটে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী। খবরের জন্য (পড়ুন পেজ ওয়ান এক্সক্লুসিভের জন্য) যত দূর সম্ভব দৌড়নো। আশ্চর্য নয় যে, মাত্র সাত বছরের মধ্যে সহকর্মীদের মনে মাপমতো অসূয়ার উদ্রেক করিয়ে তিন-তিনটি পদোন্নতি হয়েছিল তাঁর! হেলাফেলার আদালত সংবাদদাতা থেকে সাত বছরে ডেপুটি ব্যুরো চিফ! পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই উত্থান খানিক অভাবনীয় তো বটেই। একে মহিলা। তায় আবার গো-গেটার! নিজের অফিসে তাঁর কিছু শত্রুও তৈরি হওয়ারই ছিল। সে ‘বঞ্চিত’ সিনিয়রই হন বা জাগ্রুতির চলনবলন এবং দক্ষতার দাপটে ত্রস্ত হয়ে সরু চোখে তাকানো শিক্ষানবিশ সাংবাদিক।

কিন্তু শত্রু বাইরেও কিছু ছিল।

Web Series Scoop

গ্রেফতার হওয়ার অব্যবহিত পরে সাংবাদিক জাগ্রুতি পাঠক। ছবি: ওয়েব সিরিজ় থেকে।

ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানীতে তখন অপরাধ জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করত দুষ্কৃতীদের বিভিন্ন গ্যাং। কখনও দাউদ ইব্রাহিম। কখনও অরুণ গাউলি। কখনও ছোটা রাজন। আর নিয়ন্ত্রণ করত পুলিশ। আরও স্পষ্ট করে বললে মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ। এই দু’পক্ষকে নিয়েই ‘ক্রাইম বিট’-এর সাংবাদিকের কাজ। এই তিন পক্ষের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা (না কি আঁতাঁত?) ছিল। ‘এক্সক্লুসিভ’ জোগাড় করার জন্য অপরাধী এবং পুলিশকে কে কতটা ব্যবহার করতে পারে, তা নিয়ে আলাদা আলাদা কাগজের সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাগত রেষারেষিও ছিল তীব্র। সর্বত্র থাকে। সব শহরে। সব ‘বিট’-এ। কখনও-সখনও সেই প্রতিযোগিতা খানিক অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে পৌঁছয়। সে অস্বাস্থ্য অন্যের সোর্স ভাঙিয়ে নেওয়া হতে পারে। সে অস্বাস্থ্য অন্য কাগজের খবর তথা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে ভুল প্রমাণিত করার জন্য তাঁর ঊর্ধ্বতন সহকর্মীর কান ভাঙানোও হতে পারে। পেশাগত সেই উষ্মা, বিরক্তি এবং নিরাপত্তাহীনতার সঙ্কেত পড়া খুব কঠিন হয় না। দেখা হলে সিনিয়র সাংবাদিক করিতকর্মা অথচ তত সিনিয়র নয় সাংবাদিকটিকে খানিকটা অবজ্ঞা, খানিকটা তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করেন। আলাপ করতে গেলে অপাঙ্গে তাকিয়ে ভ্রু জোড়ায় খানিক বিস্ময় মাখিয়ে বলেন, ‘‘কে ভাই? কোন কাগজ?’’

জাগ্রুতির সঙ্গে সে ভাবেই আলাপ প্রতিদ্বন্দ্বী কাগজের কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাংবাদিক জয়দেব সেনের (বাস্তবের জ্যোতির্ময় দে)। যা আসলে আলাপের চেয়েও বেশি একে অপরকে মেপে নেওয়া। যে ভাবে লড়াইয়ের শুরুতে রিংয়ের ভিতরে বিপক্ষকে মাপে দু’জন মুষ্টিযোদ্ধা। কারণ, দু’জনেরই অভীপ্সা এক। দু’জনেই ছুটছেন ‘এক্সক্লুসিভ’-এর খোঁজে।

Web Series Scoop

জয়দেব সেনের চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (বাঁ দিকে)। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাংবাদিক জাগ্রুতির চরিত্রে করিশ্মা তন্না (ডান দিকে)। ছবি: ওয়েব সিরিজ় থেকে।

জিগনার স্মৃতির উপর আধারিত সিরিজ়ের কাহিনি বলছে, (জয়দেব) জ্যোতির্ময় তাঁকে খানিকটা ‘তফাতে থাকো’ মার্কা হুঁশিয়ারিই দিয়েছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেই জাগ্রুতি ‘জ্যাকপট’ মেরে বসলেন! অপরাধ জগতে নিজস্ব ‘সোর্স’ কাজে লাগিয়ে টেলিফোনে বিদেশে বসে-থাকা ছোটা রাজনের একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেললেন তিনি। তার পরেই ঘটনায় এল নাটকীয় মোড়। দিনেদুপুরে মুম্বইয়ের রাস্তায় গুলি করে খুন করা হল জয়দেবকে। জাগ্রুতি তখন পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছেন কাশ্মীরে।

২০১১ সালের সেই ঘটনাপ্রবাহ বলছে, মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন জয়দেব। মুম্বইয়ের পওয়াই এলাকায় পিছন থেকে দুই বাইক-আরোহী আততায়ী এসে তাঁকে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান মুম্বই শহরে কার্যত অবিসংবাদী ক্রাইম রিপোর্টার। বিদেশে বসে সেই খুনের দায় স্বীকার করেন রাজেন্দ্র সদাশিব নিকালজে ওরফে ছোটা রাজন। সেই ছোটা রাজন, যিনি একদা ছিলেন দাউদের ডানহাত। কিন্তু মুম্বই বিস্ফোরণের পর চরম শত্রু। তদানীন্তন ঘটনাপ্রবাহে তার চেয়েও বড় ফ্যাক্টর— যিনি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সাংবাদিক জাগ্রুতিকে।

জয়দেব খুন হওয়ার পর চুরমার হয়ে গেল পুলিশ-অপরাধী-সংবাদমাধ্যমের সমঝোতা। রুষ্ট সংবাদমাধ্যম কিংবদন্তি সাংবাদিকের হত্যাকারীকে গ্রেফতারির জন্য অবস্থান, ধর্না, আন্দোলন করে ধারাবাহিক চাপ তৈরি করল পুলিশ-প্রশাসনের উপর। পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের আতশকাচের তলায় পড়ে গেলেন জাগ্রুতি। তদন্তে খানিক দিশেহারা, খানিক সংবাদমাধ্যমের আন্দোলনজনিত চাপে হাঁসফাঁস মুম্বই ক্রাইম ব্রাঞ্চ মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করল সাংবাদিক জাগ্রুতিকে। পুলিশি অভিযোগে বলা হল, খুনের আগে জয়দেব সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য (যেমন তাঁর গতিবিধি, তাঁর বাড়ির ঠিকানা এবং এলাকা, তাঁর মোটরবাইকের নম্বর ইত্যাদি) জাগ্রুতিই সরবরাহ করেছিলেন ছোটা রাজনকে। কারণ, দু’জনের মধ্যে প্রবল পেশাগত রেষারেষি ছিল। দ্বিতীয়ত, জাগ্রুতি জয়দেবের কাগজে যোগ দিয়ে তাঁর জায়গাটা নিতে চাইছিলেন।

Web Series Scoop

যে পুলিশকর্তা এক সময় ছিলেন সাংবাদিক জাগ্রুতির খবরের ‘সোর্স’, তিনিই এক লহমায় বদলে গেলেন জেরার টেবিলে বসে। ছবি: ওয়েব সিরিজ় থেকে।

দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ গ্রেফতার করল জাগ্রুতিকে। বিবাহবিচ্ছিন্না জাগ্রুতি থাকতেন তাঁর মামার বাড়িতে। এজমালি সেই হাউজ়িং সোসাইটির ফ্ল্যাট থেকে সকলের চোখের সামনে টানতে টানতে তাঁকে নিয়ে গিয়ে প্রিজ়ন ভ্যানে তুললেন ক্রাইম ব্রাঞ্চের মহিলা কনস্টেবলরা। ক্ষমতার অন্ধিসন্ধিতে ঘুরে বেড়ানোর সময় জাগ্রুতি যাঁদের দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেননি।

দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হল। ন’মাসেরও বেশি সময় জেলে থাকতে হল জাগ্রুতিকে। তাঁর বন্দিজীবনের সময় থেকেই ওয়েব সিরিজ়ের কাহিনি ঘুরে গিয়েছে তাঁর পরিবারের অভিমুখে। তাঁর এবং তাঁর পরিজনদের দৈনন্দিন যুদ্ধ, জেলের ভিতরে সহবন্দিদের একাংশের অত্যাচার এবং তাদের সমবেত গঞ্জনার মুখে পড়া (এমনকি, এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যে, তুই কি ছোটা রাজনের রক্ষিতা?), জেলের টেলিভিশনে নিজের সম্পর্কে বিভিন্ন খবর দেখে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া, জেলে বসে দেড় হাজার পাতার চার্জশিট খুঁটিয়ে দেখা, প্রাক্তন স্বামীর তাঁর সম্পর্কে কটু মন্তব্য, দূরের হস্টেলে থাকা তাঁর পুত্রসন্তান এবং ভেঙে-পড়া বৃদ্ধ দাদুর যাপনে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সার্থক এই সিরিজ়ের ‘ট্যাগলাইন’— আইদার ইউ ব্রেক দ্য স্টোরি। অর দ্য স্টোরি ব্রেক্‌স ইউ!

শেষ পর্যন্ত জাগ্রুতির বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ ধোপে টেকে না। তিনি জামিন পান। কিন্তু তত দিনে তাঁর ভিতরে অনেক ভাঙচুর হয়ে গিয়েছে। সমাজে ফিরেছেন। কিন্তু পুরনো পেশায় আর ফিরতে পারেননি জাগ্রুতি। যেমন পারেননি জিগনাও। একদা সাফল্যের বিচ্ছুরণে আলোকিত ছিলেন যিনি, তিনি জেলফেরত হওয়ায় তাঁকে আর কেউ ছুঁয়ে দেখতে চায় না। তাঁর সাংবাদিকতায় তালা পড়ে গিয়েছে। জিগনা এখন ‘প্রাক্তন’ সাংবাদিক! তিনি এখন মানুষের মনে প্রশান্তি আনার প্রক্রিয়ায় মনোনিবেশ করেছেন। পাশাপাশি, জ্যোতিষচর্চা এবং ‘ট্যারো কার্ড রিডিং’ করেন। কী কাণ্ড!

Web Series Scoop

তখন তিনি সফল সাংবাদিক। কেক কেটে উদ্‌যাপন করেন এক্সক্লুসিভের সাফল্য! ছবি: ওয়েব সিরিজ় থেকে।

এই কাহিনিতে আরও একজন ‘প্রাক্তন’ হবেন। জেলের বাইরে জাগ্রুতির হয়ে লড়াই চালাচ্ছিলেন তাঁর কাগজের সম্পাদক ইমরান সিদ্দিকি। তিনিই ছিলেন এই অকুতোভয় সাংবাদিকের ‘মেন্টর’। প্রচারসংখ্যার তোয়াক্কা না-করে যিনি ‘ভাল’ কাগজ বানাতে চান। যিনি বলেন, ‘‘কাগজ বিক্রি করা আমার কাজ নয়। আমার কাজ ভাল কাগজ তৈরি করা।’’ যিনি সৎ, পরিশ্রমী এবং দায়িত্বশীল সহকর্মীদের পাশে রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়াতে চান। যিনি মামলার হুমকি শুনেও খবর ছাপার সিদ্ধান্ত থেকে সরে যান না। নড়ে যান না। যিনি বলেন, ‘‘একজন চিকিৎসক অনৈতিক হলে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু খবর অনৈতিক হয়ে পড়লে জনতার মৃত্যু হয়!’’ যিনি উদ্ধৃত করেন সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘যদি একজন বলেন, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে আর অন্যজন বলেন, বাইরে রোদ উঠেছে, তা হলে সেই দুটো কথাই লিখে দেওয়া সাংবাদিকের কাজ নয়। সাংবাদিকের কাজ হল জানালাটা খুলে দেখা যে, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে না রোদ্দুর উঠেছে!’’ বলেন, ‘‘আগে ভাল সাংবাদিকতা মানেই ছিল বিতর্ক। এখন বিতর্ক মানেই ভাল সাংবাদিকতা।’’ বিরল সম্পাদকের সংলাপ শুনতে শুনতে বহুশ্রুত আপ্তবাক্যটিও মনে পড়ছিল— জার্নালিজ়ম ইজ় অল অ্যাবাউট প্রিন্টিং হোয়াট পিপ্‌ল ডু নট ওয়ান্ট ইউ টু প্রিন্ট। রেস্ট অল আর পাবলিক রিলেশন্‌স। সাংবাদিকতা হল সেই বিষয়গুলো লেখা, যা লোকে চায় গোপন থাকুক। বাকি সব জনসংযোগ!

তাতে অবশ্য ইতরবিশেষ কিছু হয়নি। হয় না। সহকর্মীকে সমর্থন করেছিলেন বলে সম্পাদকের নামে রটনা হয়, জাগ্রুতির সঙ্গে তাঁর ‘সম্পর্ক’ রয়েছে। শেষমেশ অফিস রাজনীতির চোটে ইমরানকেও চাকরিটি ছাড়তে হয়। তাঁর বদলে সম্পাদকের পদে আনা হয় এক বশংবদকে।

Web Series Scoop

সৎ, পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল সহকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর খেসারত দিতে হয় সম্পাদক ইমরানকেও। ছবি: ওয়েব সিরিজ় থেকে।

জাগ্রুতি এবং ইমরান— হনসল মেহতার পরিচালিত সিরিজ়ে দু’জনকে দেখতে দেখতে মনে হল, কেন যে খামোখা কিছু মানুষ নিছক বেতনভুক সাংবাদিক বা সম্পাদকদের ‘সর্বশক্তিমান’ মনে করেন! কেনই বা সেই সাংবাদিক বা সম্পাদকেরা নিজেরাও মাঝেমাঝে সেই মায়াবী বিভ্রমে ভোগেন! মনে পড়ছিল এই পেশা সম্পর্কে অগ্রজ সাংবাদিকের বলা বাক্য— উই আর মোস্ট অর্ডিনারি পিপ্‌ল হু ডিল উইথ একস্ট্রা অর্ডিনারি পিপ্‌ল! আমরা আসলে খুব সাধারণ মানুষ, যারা অসাধারণ মানুষদের নিয়ে কাজ করি। ভাবছিলাম, কেন যে কিছু মানুষ নিজেকে ‘অসাধারণ’ ভাবতে পছন্দ করেন! কেন যে কিছু মানুষ চাকরিকে মহিমান্বিত করেন! হাজার হোক, দিনের শেষে এ-ও তো একটা চাকরিই। যতই ভিভিআইপি বৃত্তে বা ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করি, আসলে তো সাংবাদিকেরা অন্যের আলোয় আলোকিত! আলো সরে গেলে আমরা কোথায়!

পুলিশে যে ‘সোর্স’-দের সঙ্গে জাগ্রুতির দহরম-মহরম ছিল, তারা যখন টেবিলের উল্টো দিকে বসে তাঁকে জেরা করে, তখন তাদের চোখমুখ, কণ্ঠস্বর, শরীরী ভাষা— সমস্ত লহমায় পাল্টে যায়! ক্রাইম ব্রাঞ্চের যে অফিসার এত দিন পরিচিত সাংবাদিককে খবর দিয়েছেন, নিজের অফিসে ডেকে একই প্লেট থেকে তুলে বড়া-পাও খেয়েছেন এবং খাইয়েছেন, তিনিই বাঁ পায়ে মেঝের উপর ভর দিয়ে ডান পা টেবিলের উপর তুলে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে ডান হাতের তালু দিয়ে কখনও টেবিলের উপর চাপড় মারতে মারতে আবার কখনও তর্জনী উঁচিয়ে বাঘা গলায় বলতে থাকেন, ‘‘ম্যাডাম, ঠিকসে জবাব দিজিয়ে! বিলকুল ঠিকসে!’’ আর জাগ্রুতির কপালে বিনবিন করে ঘাম জমতে থাকে। চিবুক থেকে গলা বেয়ে নামতে থাকে স্বেদের ধারাস্রোত।

ক্রাইম ব্রাঞ্চের যে যুগ্ম কমিশনার জাগ্রুতির আনা খবর ‘কনফার্ম’ করার জন্য প্রয়োজনীয় ‘কোট’ দেন, তাঁর সঙ্গে খানিকটা ফষ্টিনষ্টির সুযোগ নষ্ট করতে চান না, আচমকা পারফিউম উপহার দিতে চান, নিজের সরকারি গাড়ি জাগ্রুতির জন্য অবারিতদ্বার করে দেন, সেই আইপিএস অফিসারই জাগ্রুতিকে ফোনে গম্ভীর গলায় বলেন, খবরের সূত্র সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়ে তবেই খবর লেখা উচিত। সেই অফিসারের নির্দেশেই জাগ্রুতির বিরুদ্ধে রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম দমনমূলক আইন ‘মকোকা’ (মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অফ অর্গানাইজ়ড ক্রাইম অ্যাক্ট) প্রয়োগ করা হয়। সেই অফিসারই তাঁর অধস্তনদের নিজের অফিসে ডেকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় ধমক দেন। কারণ, তাঁরা একের পর এক সাংবাদিককে জেরা করেও জাগ্রুতির বিরুদ্ধে জুতসই তথ্যপ্রমাণ আনতে পারছেন না!

Web Series Scoop

এই তা হলে সাহসী সাংবাদিকতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণাম? ছবি: ওয়েব সিরিজ় থেকে।

ভিন্‌রাজ্যের যে আইপিএস অফিসারের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন (এমনকি, নতুন করে সংসার পাতার পরিকল্পনাও করছিলেন দু’জনে), নিজের ডিভোর্স মামলার তদ্বির করার ফাঁকে যাঁর সঙ্গে দেখা করতেন হোটেলে, জাগ্রুতির গ্রেফতারির খবর শুনে তিনি বান্ধবীকে চিনতে অস্বীকার তো করেনই, হোটেলে গিয়ে ক্লোজ্‌ড সার্কিট ক্যামেরায় তাঁদের ঢোকা-বেরোনোর যাবতীয় দৃশ্য মুছিয়ে আসেন ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে।

আপাতদৃষ্টিতে পরিচিত, বন্ধুভাবাপন্ন পুলিশ অফিসারদের জেরার মুখে পড়ে বিভ্রান্ত, ধ্বস্ত জাগ্রুতিকে যখন তাঁর সম্পাদক বলছেন, ‘‘আমি যাদের থেকে ন্যূনতম সততাটুকুও আশা করি না, তুমি তাদের থেকে আনুগত্য আশা করো!’’, তখন যে পদস্থ পুলিশ অফিসার এক রিংয়ে জাগ্রুতির ফোন তুলতেন, তিনিই জাগ্রুতির অফিসের শিক্ষানবিশ সাংবাদিককে খবর ‘খাইয়ে’ তার বিনিময়ে সেই নাদানকে জাগ্রুতির বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ নথি জোগাড় করে আনতে বলছেন!

দেখতে দেখতে কোথাও একটা অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, জবাবের চেয়ে অনেক বেশি করে একটা প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে— এই তা হলে সাহসী সাংবাদিকতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণাম? এই প্রশ্নটাই আসলে ওই অস্বস্তিটা। একটা অদৃশ্য কাঁটা। পিঠে ফুটছে। সব ছাপিয়ে খচখচ করছে! করছেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE