রাজীব গান্ধী অ্যাসাসিনেটেড! তিনটি শব্দ। ১২ অক্ষরের ‘অ্যাসাসিনেটেড’ শব্দের প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে একটা করে বাড়তি স্পেস। ঘটনার গুরুত্ব এবং অভিঘাত বোঝাতে।
আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের ‘ফ্ল্যাশ’ হাতে দিলেন রাতের শিফ্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিফ সাব এডিটর রথীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।
২১ মে, ১৯৯১।
মাথাটা ভোম্বল হয়ে গেল। এক বছরও হয়নি আনন্দবাজারে শিক্ষানবিশ সাংবাদিকের চাকরিতে যোগ দিয়েছি। দেওয়া হয়েছে রিপোর্টিং বিভাগে। ভাগ্যিস! সারা দিন নিউজ় ডেস্কে বসে ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করতে হলে কবে পালাতাম! সপ্তাহে এক দিন, মঙ্গলবার নাইট ডিউটি। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১টা। বসে বসে ফোন ঘোরাও পুলিশ, দমকল, অ্যাম্বুল্যান্স আর বড় হাসপাতালগুলোর ইমার্জেন্সিতে। যদি কোনও ঘটনা-দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। অন্য কাগজে একই দিনে নাইট ডিউটির রিপোর্টারদের সঙ্গে একটা অলিখিত সিন্ডিকেট থাকত। কেউ ‘এক্সক্লুসিভ’ করবে না। নাইটে এক্সক্লুসিভ হয় না। উল্টে বরং খবর দেওয়া-নেওয়া হত। কোথাও বড় গোলমাল হলে সব কাগজের রাত-পাহারাদারেরা একই সঙ্গে ঘটনাস্থলে যেতাম। আরও একটা নির্দেশ দেওয়া থাকত অফিসের তরফে। অলিখিত। কিন্তু জরুরি। রাতে নাইট রিপোর্টারই সব। সে-ই চিফ রিপোর্টার, সে-ই নিউজ় এডিটর এমনকি, সে-ই চিফ এডিটর।
তখন লোকসভা ভোটের হাওয়া গরম। ঘন ঘন গোলমাল আর সংঘর্ষ লেগে আছে। খবর এল, রানিকুঠিতে র্যাফ নেমেছে। তখন র্যাফ একটা বড় ব্যাপার। এখনকার মতো লুল্লুভুল্লু নয়। তারাই তখন কলকাতা পুলিশের ‘এলিট ফোর্স’। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে কাগজের অফিসে টেলিফোনের সামনে বসে থাকা সিন্ডিকেট ঠিক করল, চালাও পানসি রানিকুঠি।
নাইট রিপোর্টার অফিসের বাইরে অ্যাসাইনমেন্টে গেলে নিউজ় ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্তকে জানিয়ে বেরোতে হত। যাতে তিনি অবহিত থাকেন যে, রিপোর্টিং থেকে একটা কপি আসবে রাতে। সেইমতোই রথীন’দাকে জানিয়ে গাড়ি নেওয়ার স্লিপ আর নোটবইটা পকেটে পুরে নীচের কারপুলে গিয়েছি সবে। ইন্টারকমে ফোন। ছ’ফুটের উপর লম্বা রথীনদার গলা এমনিতেই ভরাট। ফোনে সেটা আরও গম্ভীর শোনাল, ‘‘এক্ষুনি উপরে আয়! রাজীব গান্ধী নিহত!’’
লিফ্ট ধরার জন্যও দাঁড়াইনি। প্রায় তিন লাফে সিঁড়ি টপকে উঠলাম তিনতলায়। রথীনদার বাড়িয়ে দেওয়া দেওয়া কাগজের টুকরোটার দিকে আবার তাকালাম— শ্রীপেরুমপুদুর নামের একটা নাম না-জানা জায়গা থেকে তিন অক্ষরের নিউজ় ফ্ল্যাশ এসেছে— ‘রাজীব গান্ধী অ্যাসাসিনেটেড’।
সেই রাতে আরও একটা শব্দ জানলাম, শিখলাম: সুইসাইড বম্বার। আত্মঘাতী বোমারু।
নাগেশ কুকনুর পরিচালিত ওয়েবসিরিজ় ‘দ্য হান্ট - দ্য রাজীব গান্ধী অ্যাসাসিনেশন কেস’ এক ধাক্কায় চৌত্রিশ বছর আগের সেই রাতটায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
নেটফ্লিক্সে ‘আমেরিকান ম্যানহান্ট’ সিরিজ় দেখেছি। ওজে সিম্পসন, বস্টন ম্যারাথনে বোমা বিস্ফোরণ এবং ওসামা বিন লাদেনকে নিয়ে সেই সিরিজ় টান টান তথ্যচিত্র। সেখানে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আসল চরিত্রদের ক্যামেরার সামনে রেখে তাঁদের মুখে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। তথ্যনিষ্ঠ থাকার সৎ চেষ্টা। ঠিকই। কিন্তু সেই কারণেই কাজটা আবার অত কঠিনও নয়। নাগেশের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। অনিরুদ্ধ মিত্রের লেখা বই ‘নাইন্টি ডেজ়: দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য হান্ট ফর রাজীব গান্ধীজ় অ্যাসাসিন্স’ থেকে সাত পর্বের যে সিরিজ় তিনি নির্মাণ করেছেন, তাতে কোনও চরিত্রই কাল্পনিক নয়। সকলেই বাস্তব। কিন্তু সকলেই ‘অভিনীত’। সে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর হোন বা নরসিংহ রাও। কিংবা স্বয়ং রাজীব গান্ধী। নাগেশ চৌত্রিশ বছর আগেকার দূরদর্শনের কিছু ঝাপসা এবং ঝিরিঝিরি ফুটেজ ব্যবহার করতে পেরেছেন শুধু। বাকিটা তাঁর মস্তিষ্কের কাজ। তাঁর পরিচালনা। তাঁর নির্মাণ।
পরিচালক নাগেশ কুকনুর। —ফাইল চিত্র।
আমার মনের লেন্স অবশ্য তৎকালীন দূরদর্শনের মতো কমজোরি নয়। সিরিজ়টা দেখতে দেখতে চৌত্রিশ বছর আগের রাতটা ঢেউয়ের মতো ঝাঁপিয়ে এল।
কাগজ ধরিয়ে রথীন’দা ফিরে গিয়েছেন শিফ্ট ইনচার্জের সিটে। নিউজ়রুমের এক প্রান্তে রাখা টেলিপ্রিন্টার মেশিন থামছে না। দ্রুত চলতে শুরু করেছে পিটিআই এবং ইউএনআই সংবাদ সংস্থার যন্ত্র। সেখান থেকে ভলকে ভলকে কাগজের তাড়া বেরিয়ে আসছে রাজীব-হত্যার সর্বশেষ খবর নিয়ে।
শিক্ষানবিশ সাংবাদিক তথা নাইট রিপোর্টার বকলমে চিফ রিপোর্টার বকলমে নিউজ় এডিটর বকলমে চিফ এডিটর এই সময়ে কী করবে? ফালতু সময় নষ্ট না করে অফিসের পিবিএক্সে যোগাযোগ করে বলবে, জরুরি প্রয়োজন। প্রধান সম্পাদক অভীক সরকারের বাড়িতে লাইনটা দিতে। তিনি ফোনে আসার পর এক লাইনে তাঁকে বিষয়টা জানাবে। সত্যিকারের প্রধান সম্পাদক তাকে জানাবেন, তিনি যথাসম্ভব দ্রুত অফিসে রওনা হচ্ছেন। শিক্ষানবিশ নাইট রিপোর্টারকে নির্দেশ দেবেন সত্যিকারের চিফ রিপোর্টার এবং সত্যিকারের বার্তা সম্পাদককে ফোনে যোগাযোগ করে অনতিবিলম্বে অফিসে আসার কথা বলতে। তার পরে একে একে সমস্ত সিনিয়রকেও একই বার্তা পাঠাতে।
ফোনের ডায়েরি খুলে পরপর ডায়াল করতে করতে ভাবছিলাম তার সপ্তাহখানেক আগের কথা। নির্বাচনী প্রচারে কলকাতায় এসেছিলেন রাজীব। আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল দেশপ্রিয় পার্কে তাঁর জনসভা কভার করার। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে সেখানে পৌঁছোলেন রাজীব। গলা ভেঙে গিয়েছে। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। ঘন ঘন ফ্লাস্ক থেকে গরম জলে চুমুক দিচ্ছেন। যদি গলাটা একটু খোলে। সভার শেষে রাজীবের কনভয় যখন দেশপ্রিয় পার্ক থেকে বেরোল, গাড়ির চাকায় চাকায় জড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ।
আরও পড়ুন:
তার আগে সেইদিন সন্ধ্যাতেই কলকাতা প্রেস ক্লাবে ‘মিট দ্য প্রেস’ ছিল রাজীবের। আমার সেখানে অ্যাসাইনমেন্ট ছিল না। কিন্তু চিরডেঁপো আমি সেখানেও গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। স্রেফ রাজীবকে কাছ থেকে দেখব বলে।
প্রেস ক্লাবের হলঘরে গিজগিজে ভিড়। তার মধ্যে এসে বসলেন রাজীব। রাজপুরুষের মতো চেহারা। ভুবনমোহিনী হাসি। মাথার সামনের চুল খানিকটা পাতলা হয়ে এসেছে। তীক্ষ্ণনাসা। পরনে খদ্দরের কুর্তা-পাজামা। গলায় তেরঙা কংগ্রেসি উত্তরীয়। ফুট তিনেকের দূরত্ব থেকে জ্যোতিষ্কের মতো লাগছিল তাঁকে।
কিন্তু সাংবাদিক বৈঠক শুরু হওয়ার কিছু ক্ষণ পরেই ঝপ করে লোডশেডিং! অন্ধকারে ডুবে গেল চারদিক। বোঝা গেল, এই পরিস্থিতিটার জন্য কেউ তৈরি ছিলেন না। ফুল অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স। তখন মোবাইল-পূর্ব যুগ। ফলে টর্চ ইত্যাদির প্রশ্ন নেই। কার পকেটে দেশলাই বা লাইটার আছে ইত্যাদির সুলুকসন্ধান করতে করতে মিনিট পাঁচ-সাত কেটে গেল। সকলেই স্থাণু। কিন্তু গুঞ্জন তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে হাঁকডাক। রাজীবও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছেন। একই রকম ভ্যাবাচ্যাকা তাঁর সঙ্গী কংগ্রেসের নেতা এবং হুট বলতে সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকে পড়া তাঁদের আমচা-চামচারা।
নিকষ অন্ধকারে বসে থাকতে থাকতে আচমকাই মনে হল, এখন যদি কেউ এসে রাজীবকে একটা চড় মারে? ওই কুপকুপে অন্ধকারে বসে আছেন। হাজার হোক, দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তো। আর ভোটের যে হাওয়া উঠেছে, তাতে সম্ভবত আবার প্রধানমন্ত্রীই হতে চলেছেন। কিন্তু যা দেখছি, তাঁর তো কোনও নিরাপত্তাই নেই!
আলো-টালো আসার পর আবার সাংবাদিক বৈঠক শুরু হল। কিন্তু ব্যাপারটা মাথায় টিকটিক করছিল। দেশপ্রিয় পার্কের আগে (বা পরে, এখন আর অত মনে নেই) টালা পার্কে গিয়েছিলেন রাজীব। সেখানেও তাঁকে ঘিরে জনতার ঢল। গায়ে-পায়ে ঝুলছে মানুষ। বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ তো ওঁকে একটা ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলেও দিতে পারে। ঘুরেফিরে আসছিল প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন শ্রীলঙ্কা সফরে কলম্বোয় ‘গার্ড অফ অনার’ নেওয়ার সময় আচম্বিতে এক ফৌজির রাজীবের মাথায় রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করার কথা। উদ্যত রাইফেলটা চোখের কোণে দেখতে পেয়ে দ্রুত প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চট করে মাথাটা সরিয়ে নেওয়ায় মাথা বেঁচেছিল। কিন্তু ঘাড়ে বড়সড় চোট লেগেছিল রাজীবের।
রাতে অফিসে ফিরে প্রেস ক্লাবের ঘটনা এবং তজ্জনিত বিনবিনে আশঙ্কার কথাটা বলেছিলাম কয়েক জন সিনিয়রকে। তাঁরা খুব একটা পাত্তা দেননি। দেওয়ার কারণও ছিল না। পেশায় যার একটা বছরও ঘোরেনি, শিক্ষানবিশিও কাটেনি, সে এই ধরনের গেরামভারী মতামত প্রকাশ করলে তা বিশুদ্ধ পাকামি বলেই প্রতিভাত হয়।
ঘটনাচক্রে, তার এক সপ্তাহের মধ্যে শ্রীপেরুমপুদুরের ঘটনা। রাজীবের একেবারে কাছে গিয়ে মালা পরিয়েছিলেন এক তরুণী। তার পরেই বিস্ফোরণ। রাজীবের ছিন্নভিন্ন শরীর শনাক্ত করতে সম্বল ছিল তাঁর পায়ের ‘লোটো’ স্নিকার্স। রাজীব-সহ মৃত্যু হয়েছিল ১৮ জনের। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ওই ধরনের ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। যা দেশের রাজনীতির অভিমুখটাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
চৌত্রিশ বছর পরে ‘সোনি লিভ ওরিজিনাল্স’-এ রাজীবের হত্যারহস্যের পরতে পরতে জট খোলা দেখতে গিয়ে সেই রাতটা মাথার মধ্যে ঝনঝন করে বাজতে শুরু করল।
আরও পড়ুন:
কিন্তু নাগেশ কুকনুরের কেরামতি সেই রাত নয়, তার পরের ৯০ দিনের মালা গাঁথায়। যখন সরকারের গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) ধাওয়া করে গিয়েছে রাজীবের সম্ভাব্য আততায়ীদের। সে মশলা অনিরুদ্ধের লেখা বইয়েই ছিল নির্ঘাত। নাগেশ সেই কাহিনিতে রক্তমাংসের চরিত্র বসিয়ে তাদের রূপ দিয়েছেন। চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন করেছেন এবং তাঁদের শিখিয়ে-পড়িয়ে উপযুক্ত করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা— কোনও তথাকথিত তারকা নেননি। এই ওয়েবসিরিজ়ে যাঁরা মূল বা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাঁরা সকলেই অচেনা, প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল। কিন্তু নিজস্ব অভিনয়ের স্কিলে অসম্ভব শক্তিশালী। ক্লোজ় এবং লং শটে তাঁদের প্রত্যেকের চোখ কথা বলে। বিশেষ তদন্তকারী দলের প্রধান সিবিআই অফিসার ডি কার্তিকেয়ন (অমিত সিয়াল), এসপি অমিত বর্মা (সাহিল বৈদ্য), ডিএসপি রঘোথামন ( ভগবতী পেরুমল), ডিআইজি আমোদ কান্ত (দানিশ ইকবাল), ডিআইজি রাধাবিনোদ রাজু (গিরিশ শর্মা), এনএসজি কমান্ডো (বিদ্যুৎ গর্গ) বা শিবরাসন (শফিক মুস্তাফা)। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব! এমন প্রতিভাশালী অথচ অচেনা অভিনেতার ঝাঁক যে এ দেশে ছিল, নাগেশের তৈরি সিরিজ় না দেখলে জানতেও পারতাম না।
এঁরা সকলে নিখুঁত অভিনয় দক্ষতায় চিত্রনাট্যের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলেছেন। তেমনই গোটা সিরিজ় জুড়ে সমান্তরাল রেখায় চলেছে দু’টি কাহিনি। একটি তদন্তকারীদের। একটি ষড়যন্ত্রীদের। চলমান দুই কাহিনির পটভূমিকায় রয়েছে ৩৪ বছর আগের সময়কালের খুঁতহীন পরিপার্শ্ব। ল্যান্ডলাইন টেলিফোন সেট, সরকারি দফতরের আসবাবপত্র, লালবাতি লাগানো সরকারি সাদা অ্যাম্বাসাডর, পাবলিক বাস— যা চোখের পলক ফেলার আগে আপনাকে রফতানি করে দেবে উদারনীতি-পূর্ব ভারতবর্ষে।
১৯৯১ সালের মে মাসে রাজীব-হত্যার সময় নাগেশ আমেরিকার ডালাসে ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি করতেন। ঘটনার বিবরণ তিনি পড়েছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইম্সের সপ্তাহান্তিক সংস্করণে। যেখানে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন খবর থাকত। পাকেচক্রে, তার চৌত্রিশ বছর পরে সেই রাজীবের হত্যা নিয়ে তিনিই সিরিজ় তৈরি করলেন। এবং এমন একটি সিরিজ় নির্মাণ করলেন, যাকে বছরের মাঝপথেই ‘বছরের বেস্ট’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
কারণ, নাগেশ খুব নির্মোহ ভাবে রাজীব-হত্যার নাটকীয়তা থেকে সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে বিযুক্ত করেছেন। তাঁর পরিচালনাধীন তদন্তের কাহিনি নিরুচ্চার। কোনও উচ্চকিত সংলাপ বা অতি নাটকীয়তা নেই। কিন্তু সর্বত্র একটা উত্তেজনা, টেনশন আর উদ্বেগের স্রোত তিরতির করে বয়ে গিয়েছে। সঙ্গে অসামান্য আবহসঙ্গীত। যা স্ক্রিন থেকে একটি সেকেন্ডের জন্যও চোখ ফেরাতে দেয় না। এতটাই চিত্তাকর্ষক সেই ধারাবিবরণী যে, প্রতিটি মুহূর্তে দর্শক তাকে আঁকড়ে থাকতে বাধ্য হন।
সাধারণত এই সব গল্প পেলে অনেক পরিচালক একটু বয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখিয়ে ফেলেন। কিন্তু নাগেশ বস্তুনিষ্ঠতা এবং মতামতের মধ্যে এক বিরল ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। বলতে চেয়েছেন, সত্য আসলে খুব জটিল একটি বিষয়। এবং তা বহুমুখী। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখলে সত্যকে নিজের নিজের মতো করে অন্বেষণ করা যায়। গোটা সিরিজ়ের যাত্রাপথ জুড়ে দর্শকের জন্য তিনি অনেকগুলো উন্মুক্ত বাঁক রেখে গিয়েছেন। যাতে দর্শক নিজেই ঠিক করতে পারেন, তিনি কোন বাঁকে এসে কোন পথে যাবেন বা সেখানেই থেমে যাবেন কি না। যেমন রাজীব-হত্যার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর বলছেন, ‘‘আমি চাই না, এই তদন্তে কোনও রাজনৈতিক চাপ, অন্য কোনও বাধা বা কারও হস্তক্ষেপ থাকুক।’’ যেমন তাঁর পরের প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধানকে ডেকে বলছেন, ‘‘তোমরা এলটিটিই প্রধান প্রভাকরণের বদলে শিবরাসনকে গোটা ঘটনার নায়ক বানিয়ে দিচ্ছ!’’ তার পরেই দেখা যাচ্ছে, বেঙ্গালুরু (তৎকালীন সংলাপে ‘ব্যাঙ্গালোর’) শহরের উপান্তে একটি বাড়িতে অন্তরিন শিবরাসন-সহ অন্যান্য সশস্ত্র তামিল জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার জন্য সরকারি নির্দেশ পেতে টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে কমান্ডোবাহিনীকে। যখন নির্দেশ এল, তত ক্ষণে শিবরাসন নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মঘাতী। অন্যেরা গলায় ঝোলানো সায়ানাইড ক্যাপসুলে কামড় দিয়ে জীবনের চৌকাঠ পেরিয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, রাজীব- হত্যার তদন্তে যে ভাগ্য একটা বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়েছিল, সেটা দেখানো। যেমন, যে বিস্ফোরণে ১৮টা লোকের প্রাণ গেল, সেখানে বিস্ময়কর ভাবে অবিকৃত এবং অক্ষত রইল একটা ক্যামেরা, যাতে রাজীব-হত্যার পূর্ববর্তী মুহূর্তের ছবির রোল পাওয়া গেল। যে ছবি থেকে ‘আত্মঘাতী বোমারু’ ধানু এবং শিবরাসনের হদিস প্রথম পাওয়া গেল! ভাগ্য নয়তো কী!
বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে একে অপরকে টপকে কৃতিত্ব নেওয়ার রেষারেষি, অসহযোগিতা, ব্যর্থতা এবং উচ্চতম পর্যায়ের আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ— সরকারি তদন্তে যা যা হয়ে থাকে, কিছু দেখাতে কসুর করেননি নাগেশ। সেই জন্যই তাঁর পরিচালিত সিরিজ় অবিশ্বাস্য এক বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে।
বহুব্যবহৃত ক্লিশে ‘ওয়ান ম্যান্স টেররিস্ট ইজ় অ্যানাদার ম্যান্স ফ্রিডম ফাইটার’-কে নাগেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। এবং তার পাল্টা ভাষ্য তৈরি করেছেন। বিশেষ তদন্তকারী দলের হাতে ধরা-পড়া এলটিটিই জঙ্গি যখন পলাতক এবং আত্মগোপনকারী শিবরাসন (রাজীব-হত্যার মূল চক্রী) সম্পর্কে বলছেন, ‘‘ওয়ান ম্যান্স হিরো ইজ় অ্যানাদার ম্যান্স টেররিস্ট’’, তখন প্রশ্নকর্তা অফিসার তাঁকে পাল্টা বলছেন, ‘‘হিরোজ় ডোন্ট টেররাইজ় এনিওয়ান!’’ নায়কেরা কাউকে ভয় দেখায় না।
আরও পড়ুন:
এই ধরনের সিরিজ় পরিচালনার একটা চেনা ফাঁদ আছে— ঘটনাটাকে একটা উচ্চকিত, উত্তেজক এবং বাজারচলতি থ্রিলার করে ফেলা। সে এমনি কোনও অপরাধ হোক বা রাজীব-হত্যার মতো ঘটনা। অধিকাংশ পরিচালক সেই ফাঁদে আটকা পড়েন। নাগেশ পড়েননি। এই সিরিজ়ের শেষে কোনও বীরগাথা রচিত হয় না। কোনও ধুন্ধুমার ক্লাইম্যাক্স তৈরি হয় না। বরং এক অর্থে ব্যর্থতা এবং হতাশার বোধ তৈরি হয়। অবশ্য নাগেশের বাকি যা কাজ (রকফোর্ড, ইকবাল, ডোর, লক্ষ্মী, ধনক-এর মতো ছবি) রয়েছে, তাতে তিনি ওই ধরনের কোনও সস্তা চটকের মধ্যে ঢুকবেন, সেটা ভাবাই অন্যায়। কিন্তু অনুমান করতে পারি তাঁর কাজ কতটা শক্ত ছিল, যখন তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘এত কঠিন কাজ এর আগে কখনও করিনি। একে তো রাজীব গান্ধী হত্যার মতো ঘটনার তদন্ত। সেই তদন্তকারী দলের সদস্যেরা এখনও প্রত্যেকেই বেঁচে রয়েছেন। ফলে আমাকে বস্তুনিষ্ঠ থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমি সাংবাদিকের মতো রাজীব-হত্যার উদ্দেশ্যটা খুঁজতে চাইনি। আমি শুধু তদন্ত সংক্রান্ত তথ্যগুলো যথাসম্ভব সৎ ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছি।’’
চৌত্রিশ বছর আগে-পরে ছবির সঙ্গে ছবি জুড়ে যাচ্ছিল। মুহূর্তের সঙ্গে মুহূর্ত। হাট হয়ে খুলে যাচ্ছিল মধ্যবয়সির অতীতস্মৃতি ভরা আলমারির পাল্লা। চোখে ভাসছিল পিটিআইয়ের ‘ফ্ল্যাশ’— রাজীব গান্ধী অ্যাসাসিনেটেড!