সম্প্রতি মিজ়োরামকে পূর্ণ সাক্ষর রাজ্য হিসাবে ঘোষণ করলেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ২০২৩-২৪ সালের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস)-র প্রতিবেদনে মিজ়োরামের সাক্ষরতার হার ৯৮.২ শতাংশ, যা ভারতে সর্বাধিক। এই সমীক্ষা নমুনার ভিত্তিতে হলেও, পরবর্তী জনগণনা না হওয়া পর্যন্ত এর উপরেই ভরসা করে আলোচনা করা ছাড়া উপায় নেই। পিএলএফএস ২০২৩-২৪’এর তথ্য জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের সাক্ষরতার হার ৮০ শতাংশ। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল-সহ মোট ৩৬টি রাজ্যের মধ্যে তার অবস্থান ২২।
পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হালহকিকত ঠিক কেমন? “ক্লাস এইটের পর পড়া ছেড়ে বিয়ে করেছি। এখন সব ভুলে গিয়েছি। আবার পড়তে পারলে পড়ব,” বললেন কলকাতার এক গৃহশ্রমিক। বছর ত্রিশ বয়সের এই মহিলার সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ হয় ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২৫-এর এক পাইলট সমীক্ষায়। মেয়েদের সাক্ষরতার পরিস্থিতি বুঝতে বঙ্গীয় সাক্ষরতা প্রসার সমিতি পরিচালিত এই সমীক্ষা হয় হুগলির কোন্নগর, উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর, পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং, আর বীরভূমের সাঁইথিয়ার মোট আটটি গ্রামে, এবং হাওড়া, বরাহনগর, বিধান নগর এবং কলকাতার বেশ কিছু এলাকাতে। ১৮-৫৯ বছর বয়সি মোট ২৭২ জন মেয়ের সঙ্গে কথা বলা হয়।
সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, গ্রামাঞ্চলের মোট ২১১ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৫১ জন ও শহরাঞ্চলের ৬১ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৭ জন সম্পূর্ণ অক্ষরজ্ঞান-বঞ্চিত। নিম্ন-প্রাথমিকে স্কুলছুট, কিংবা প্রাথমিক অবধি লেখাপড়া করেছেন গ্রামীণ অঞ্চলের ৪১ জন, শহরাঞ্চলের ১১ জন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, যাঁরা সম্পূর্ণ অক্ষরজ্ঞান-বঞ্চিত, তাঁরা ছাড়াও প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক অবধি পড়াশোনা করা উত্তরদাতারাও যেতে চাইছেন সাক্ষরতা কেন্দ্রে। ২০ থেকে ৪০-এর কোঠায় থাকা এই মেয়েরা পড়তে, লিখতে পারছেন না। সমিতি-চালিত ‘বিদ্যাসাগর বয়স্ক সাক্ষরতা কেন্দ্র’-এ যাঁরা পড়তে আসেন সেই তালিকা থেকেও দেখা যাচ্ছে, ৫ থেকে ৭ বছর স্কুলে পড়ার পরে স্কুলছুট হওয়া মানুষরা পড়তে আসছেন।
অতএব যাঁরা স্কুলে পড়েছেন তাঁরা সাক্ষর, এমন ধরে নেওয়া যাচ্ছে না। কয়েক বছর স্কুলের শিক্ষা পেয়েছেন, এমন পুরুষ বা মহিলারা কিছু কিছু অক্ষর চিনতে পারলেও, শব্দ ও বাক্য পড়তে, বাক্য গঠন করতে বা লিখতে পারছেন না। যা ইঙ্গিত দেয় যে, নিরক্ষরতা প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে যে প্রতিষ্ঠান, সেই স্কুলে কয়েক বছর যাওয়া-আসা করেও সব শিক্ষার্থী সাক্ষর হচ্ছেন না। স্কুলে-অর্জিত সাক্ষরতার মান এমনই যে, স্কুল ছাড়ার পরে তা ধরে রাখতে পারছেন না মানুষ। বাক্য-অনুচ্ছেদ পড়ে বুঝতে পারা, লিখতে পারা, বনিয়াদি অঙ্ক কষা, এ সব দক্ষতায় থেকে যাচ্ছে গুরুতর ফাঁক। এর কারণ কী? শেখানো ও শেখার পদ্ধতি, পাঠক্রম, পাঠ্যসূচিই কেবল প্রশ্নের মুখে পড়ে না, সামগ্রিক ভাবে শিক্ষানীতির রূপরেখা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
খুব সহজে বলে দেওয়া যায়— বহু মানুষ যে-হেতু এই শিক্ষাব্যবস্থাতেই সাক্ষর হচ্ছেন, ডিগ্রি-ডিপ্লোমা পাচ্ছেন, তাই স্কুলশিক্ষার নীতি-পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানে হয় না। শিক্ষার্থীর ক্ষমতা-অক্ষমতাই কেবল বিচার্য। তাই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় শীর্ষ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীরাই থাকে স্কুলশিক্ষা নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে। অথচ, সভ্য সমাজের ধর্ম হল শিক্ষার সার্বিক প্রসার। রাষ্ট্র শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার দিয়ে থাকলেও, শিক্ষাগ্রহণ প্রভাবিত হয় নানা সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে। সেখানে শ্রেণি, বিত্ত, জাত, ধর্ম, লিঙ্গের মতো নানা পরিচয়গত দিক জড়িয়ে থাকে। সাঁইথিয়ার চারটি গ্রামে ৭৪ জন জনজাতি গোষ্ঠীর নারীর সঙ্গে কথা বলা হয়, তাঁদের ৩২ জন সম্পূর্ণ অক্ষরজ্ঞান-বঞ্চিত, কিন্তু অন্যত্র এই প্রবণতা অনেকটাই কম। পশ্চিমবঙ্গের পিএলএফএস (২০২৩-২৪) প্রতিবেদন জানাচ্ছে, তফসিলি জনজাতির মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ, যা অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে কম। এ রাজ্যে গ্রামাঞ্চলে নারী ও পুরুষের মধ্যে সাক্ষরতার হারের ফারাক রয়েই গিয়েছে— গ্রামে ১৪ শতাংশ বিন্দু, শহরে ৮ শতাংশ বিন্দু। আর সাক্ষরতা বা শিক্ষায় শ্রেণিভিত্তিক অসাম্য বুঝতে তো সমীক্ষারও প্রয়োজন নেই। তা তর্কাতীত সত্য।
শিক্ষা-সাক্ষরতায় আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও, নতুন শিক্ষানীতি তা স্বীকার করে, কিন্তু সৎ উদ্দেশ্যে নীতি তৈরি করে না। ২০২০-র শিক্ষানীতিতে কেন্দ্র শিক্ষাবিজ্ঞানকে অস্বীকার করে অঙ্গনওয়াড়ির মতো শিশু-বিকাশ কেন্দ্রকে বিদ্যালয়ের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ফিকির করল। উচ্চ-প্রাথমিক স্তর শুরু হওয়া মাত্র ‘ভোকেশনাল’ প্রশিক্ষণের নিয়ম চালু করল। শিক্ষানীতিতে ‘মুক্ত-শিক্ষা’, ‘বিকল্প শিক্ষার’ মতো উপাদান ঠেসে সাক্ষরতা ও প্রারম্ভিক শিক্ষাকে জটিলতর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলল।
ইদানীং যে প্রশ্নগুলি আরও বেশি করে উচ্চারিত হয়েছে, তারও উত্তর মেলেনি। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে ‘পিএমশ্রী’ সাঁটা হবে না বলে কেন্দ্রের তরফ থেকে অর্থবরাদ্দ কেন বন্ধ করে রাখা হল? কেন এ রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলি রকমারি অনাচারের শিকার হল? সর্বজনীন স্কুলশিক্ষা, কার্যকর সাক্ষরতা সুনিশ্চিত করার বনিয়াদি কর্তব্য পালন করছে না কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনও সরকার। বরং একটা জনবিরোধী মেজাজ দেখা যায়। সাক্ষরতা প্রসারের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, সামাজিক সংগঠন বা উৎসাহী ব্যক্তি-নাগরিক লেখাপড়া শেখানোর অজস্র উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেন। কিন্তু অক্ষরজ্ঞান-বঞ্চনার সঙ্কট রাষ্ট্রের সক্রিয় কর্তব্যপালন ছাড়া দূর হবে না। সর্বোপরি, শ্রেণি-জাত-লিঙ্গ-ধর্মগত বৈষম্যে রাষ্ট্রীয় ইন্ধন বন্ধ না হলে পূর্ণ সাক্ষরতা অধরা থেকে যাবে এ দেশের।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)