তেরো হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এক গ্রামে ঘুরতে এসে তুষারপাত দেখলাম। সেই শুভ্র হিমেল মগ্নতায় ডুবে যাওয়া অসম্ভব, যদি সেই সময় আশকারা দিয়ে ফেলি সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে। ডিজ়েল পুড়িয়ে সুদূর প্রান্তে আসার কার্বন-ফুটপ্রিন্টের হিসাব কষতে গেলে পর্যটন উপভোগ্য হবে না। পর্যটনের দরুন পরিবেশ ও পরিমণ্ডলের উপরে কী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, সেই তালিকা তৈরি করতে বসলে আর কিছুই মনোরম লাগবে না। হোটেল বানাতে গিয়ে ক’টা গাছ কাটা পড়ল, সেই চিন্তা মাথায় আনলে ঘোরা আর থাকার আরাম বিঘ্নিত হয় যে!
বাজার, বাণিজ্য ও ধনতন্ত্রের ‘হাত’টা নজরের বাইরে না রাখলে, ‘ভোগ’ যথেষ্ট উপভোগ্য নয়। প্রকৃতি, স্থানীয় মানুষ, তাঁদের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা ও অসংবেদনশীলতা দিয়েই গঠিত আমাদের ক্রয়-ক্রিয়া। আমাদের গাড়ি চালানোর আয়েশ থেকে তাই বিয়োগ হয়ে যায়— যাঁরা এই রাস্তা তৈরি করেছেন সেই শ্রমিকদের ঘাম, শ্রম ও জীবন। আমাদের বিলাসিতা শুধুই আরও উন্নত অনুভূতির বিকল্প সন্ধানী— গোটা জোগাড়-যন্ত্রের জটিলতা ও কুফল নিয়ে ভেবে দেখার সময় বা প্রয়োজন খুঁজে পায় না তা।
উদারীকরণের পঁয়ত্রিশ বছর পর, বিত্তশালী মানুষের কাছে পণ্যসামগ্রী শুধু যে সহজলভ্য হয়েছে তা নয়। পণ্য ও পণ্য-অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আমূল পাল্টেছে। যা ছিল নিমিত্ত, তা এখন আধিক্যের পর্যায়ে। পণ্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে কিছু শর্তে। সেই শর্তের ভিত্তিই হল, পণ্যের সঙ্গে গভীরতাবিহীন সম্পর্ক। পণ্যের উপরিভাগ বা বহির্ভাগের সঙ্গে যোগাযোগ, যা স্বল্পমেয়াদি। সেখানে ঘন ঘন নিত্যনতুন চাহিদার জন্ম ও মৃত্যু হচ্ছে। অতলে না যাওয়াই তার ধারণ ও চালনাশক্তি। পণ্য-অভিজ্ঞতার জৌলুস-মগ্নতাই যথেষ্ট; ‘ডেলিভারি’ সময়মতো পেলেই হল!
পণ্যের উৎপত্তি, তার বিতরণ-ব্যবস্থা বা বিস্তৃত আয়োজনপ্রণালী নিয়ে ভাবলে উপভোগ অসম্ভব। মানুষ, পরিবেশ বা অন্যান্য জীবের প্রতি নির্দয়তার নিদর্শন গুনতে গেলে পর্যটন হবে না; পাতের সুপরিবেশিত খাবার মুখে রুচবে না; আরামদায়ক সব যন্ত্র ও ব্যবস্থায় সুখ মিলবে না। তাই আমাদের আকৃষ্ট করতে পণ্য যতটুকু উন্মোচিত করে, যতটুকু চিত্তাকর্ষক ও নান্দনিক, সেটুকুই আমাদের ভোগের সম্বল। পণ্যকে কেন্দ্র করে যে মুনাফা, প্রতিযোগিতা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও আবর্জনা সৃষ্টি, তাতে ক্রেতা ভাবিত হলে পণ্যের বাজার থাকবে না, ভোগকে মনে হবে দুর্ভোগ।
যে বিলাসী বাথটবের সুগন্ধি ফেনা আমাদের শরীর ছেড়ে নল বেয়ে নর্দমা বা নদীর দুর্গন্ধে মিশছে, সেটা আমাদের উদ্বেগের কারণ হলে স্নানের প্রশান্তি ভঙ্গ হয়। কী পরিমাণ কয়লা পোড়ালে জলকে বহুতল বাড়ির ট্যাঙ্কে তোলা যায়? বা সেই জলকে ঠান্ডা বা গরম করে আরও আরামদায়ক করা যায়? স্নানঘরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায়? কতটা উদ্যম প্রয়োজন প্লাস্টিকের বোতলে তরল সাবান এঁটে আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে? এ সব চিন্তা এলে শরীর আর উষ্ণ-শীতল জলের আরামে ভিজবে না, ভিজলেও সেই অভিজ্ঞতা সুখের হবে না।
মোদ্দা কথা: বাজার, ব্যবসা ও বিজ্ঞাপন চায় পণ্যমগ্নতা। ক্রেতা ডুবে থাকবে পণ্য অভিজ্ঞতায়। পণ্য-সংস্কৃতিকে সমালোচনার সমস্ত ইচ্ছা দমন করবে ভোগের মহা আয়োজন। আমরা ব্যস্ত থাকব চাহিদায়, ক্রয়ে, বর্জনে। পণ্যের জৌলুসের আড়ালে থাকা যাবতীয় প্রক্রিয়া, কর্মোদ্যম, শোষণ— পণ্যতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় চলছে, চলবেও। এই আড়াল বা পণ্য দ্বারা পণ্যের কালো দিকটা ঢেকে রাখার বাজারি কারসাজিই পণ্যকে আরও লোভনীয় করে, তার মুনাফা বাড়ায়। এই আড়ালই ভোগের পরিতৃপ্তি ও চরম চরিতার্থতা। পণ্যতত্ত্বের মূলে এ আড়াল-কৌশল।
আপনি গ্রীষ্মে শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত বাজারের মজা নিন, ছাড় খুঁজুন, পানীয় সেবন করুন, বাকিতে কিনুন, কেনা নিয়ে ভাবুন, মগ্ন থাকুন, ইচ্ছে-তালিকা দীর্ঘায়িত হোক। কিন্তু বাজারের জমিতে কিসের কল ছিল বা কতটা খেলার মাঠ ও ক’টা গাছের মৃত্যুর উপর এই বাজার দাঁড়িয়ে আছে, বা অন্যের আবাসন কেড়ে কী ভাবে উঠেছে দেওয়ালে ঘেরা বহুতল বাড়ি— এ সব প্ৰশ্ন নৈব নৈব চ। ভোগের মূলে এই ভুলে থাকা, দেখেও না দেখা। পণ্য যা কিছু সচেতন ভাবে আড়ালে রেখেছে, তার উন্মোচন ব্যবসার পক্ষে ভাল না। পণ্য চায় আমাদের ভোগ করাতে, সমালোচক তৈরি করতে নয়। পণ্য চায় আমরা আমাদের চাহিদায় দম দেব প্রতিনিয়ত। বাজারের বর্জন-প্রক্রিয়া, অনৈতিক শ্রমিক আইন, মাঠ-পুকুর-জঙ্গল দখল, শাসক-দল ও পুঁজিপতির মধ্যে গোপন আঁতাঁত— এ সব আলোচনা, বিক্রির পক্ষে ভাল না। পণ্য চায়, সবাই তাকে মেনে তার নেশায় আসক্ত থাকুক। পণ্যকে প্রশ্ন করায় নয়, ভোগেই ক্রেতার অধিকার। পণ্য-জৌলুসের আড়ালে যে কদাকার ছবিটা, তা ক্রেতার অগোচরে রাখার ফন্দিই বিশ্বব্যাপী ব্যবসার বাহুবল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)