Advertisement
E-Paper

রাজ্যে কাজ জুটলেও কেন ভিন্‌রাজ্যে যেতে চাইছে এই প্রজন্মের বাঙালি?

পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাজের খোঁজে যাওয়া শ্রমিকের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ ২০ শতাংশ। রাজ্য ধরে হিসাব করলে যা সব থেকে বেশি।

সুপর্ণ পাঠক

সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:৪৬
Why the jobseekers of West Bengal prefer other states

—প্রতীকী চিত্র।

পরিষ্কার বাঙলা শুনেই বুঝেছি, বাঙালি। কিন্তু এতটুকু মেয়ে! তা-ও আবার পুরীর এই হোটেলে? আলাপ করতেই হল। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, মেয়েটি জলপাইগুড়ির ক্রান্তির কাছের একটি গ্রাম থেকে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী কৌশল বিকাশ যোজনা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন এখানে শিক্ষানবিশ।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এত হোটেল! সেখানে কোথাও কাজ করা যেত না? উত্তরে মেয়েটি যা বললেন, তা কিন্তু অনুধাবনযোগ্য। রাজ্যে নাকি এই স্তরের হোটেলে অতিথিসেবার জন্য পেশাদার নিয়োগের চল নেই। থাকলেও নাকি পরিচালন ব্যবস্থায় সেই পেশাদারিত্ব নেই, যা অতিথিসেবায় প্রশিক্ষিতদের জন্য সঠিক কাজের পরিবেশ দিতে সক্ষম। আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই! সেই সঙ্গে মাইনেও নাকি কম।

সাধারণ ঘরের মেয়ে। কিন্তু বুঝে গিয়েছেন যা, তার জন্য উচ্চশিক্ষার পথে গিয়ে পেশাগত যোগ্যতা অর্জন করার থেকে এই জাতীয় প্রশিক্ষণই আয়ের পথ সুগম করতে পারে। আবার এ-ও জানেন যে, এই প্রশিক্ষণ থেকে সরাসরি পাঁচতারা হোটেলে চাকরি পাওয়া যায় না। উল্টো দিকে গোটা দেশে সাধারণের জন্য তৈরি হোটেলগুলিতে এখন প্রশিক্ষিত কর্মীর চাহিদা বাড়ছে। তাই শুধু হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকেই যে হোটেলে চাকরি হচ্ছে, তা নয়। অতিথিসেবার পেশাদারদের নানান প্রশিক্ষণ স্তরের জন্যই তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সুযোগ। যেমন পুরীতে। তাই মেয়েটি পুরীর এই হোটেলটিকে বেছে নিয়েছেন তাঁর হাতেকলমে কাজ শেখার জন্য। পরিচালকরা নাকি তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছেন। এবং যাতে মেয়েটির কোনও অসুবিধা না হয়, তার প্রতিও নজর রেখেছেন। পশ্চিমবঙ্গে এই আবহ অনুপস্থিত। অন্তত তার চেতনায় তো বটেই।

এর পরে? যদি এই হোটেলেই না হয়, তা হলে বেঙ্গালুরুতে চেষ্টা করবেন। কারণ, এই জাতীয় অভিজ্ঞতা থাকলে হোটেলের বাইরেও কাজের সুযোগ রয়েছে। বড় সংস্থাগুলিতে হাউসকিপিং বিভাগ রয়েছে। যেখানে এই জাতীয় প্রশিক্ষিত কর্মীদের কাজ মেলে। এই হোটেলটির ম্যানেজারও ইনফোসিসে বেশ কিছু দিন কাজ করে এসেছেন। ক্রান্তির এই মেয়েটিও ওড়িশা বা দক্ষিণ ভারতে ভবিষ্যত গড়ার কথা ভাবছেন নিজের রাজ্য এবং পরিবারকে ছেড়েই।

এমন নয় যে, পেশার সন্ধানে আগেও বাঙালি রাজ্য ছাড়েনি। উচ্চশিক্ষিত বাঙালি উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়েছে। সংসার পেতেছে। কিন্তু বাইরের রাজ্য থেকে এ রাজ্যে কাজের খোঁজে আসা মানুষের পাল্লাটা ভারীই ছিল। সাধারণ থেকে কর্পোরেট, সব ক্ষেত্রেই। শংকরের 'সীমাবদ্ধ' উপন্যাসে তাই দক্ষিণ ভারতীয় অ্যাকাউন্ট্যান্ট বলেন, একটি বাক্স নিয়ে হাওড়ায় নেমেছিলেন চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে। তাঁর স্বপ্ন সফল। অবসরের পরে ফিরে যাবেন নিজের রাজ্যে।

কিন্তু আজ? পরিসংখ্যান বলছে, দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাজের খোঁজে যাওয়া শ্রমিকের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ ২০ শতাংশ। রাজ্য ধরে হিসাব করলে যা সব থেকে বেশি। সমস্যা হচ্ছে, এই জাতীয় পরিসংখ্যান আজকাল আর নিয়মিত পাওয়া যায় না। যেটুকু মেলে, তা-ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার করা হিসাব থেকে। তবুও ২০১১ সালের সেনসাসে চোখ রাখলে পরিযায়ী শ্রমিকের পরিসংখ্যানে আমাদের রাজ্য চতুর্থ ছিল। উত্তর প্রদেশ (৩৭.৩ লক্ষ), বিহার (২২.৬ লক্ষ), রাজস্থান (৬.৬ লক্ষ) আর পশ্চিমবঙ্গ (৫.১১ লক্ষ)।

মাথায় রাখতে হবে, রাজ্যের বাইরে কাজের খোঁজে যাওয়ার চরিত্রটি কেমন। কারা যাচ্ছেন? যদি দেখা যায়, অত্যন্ত সাধারণ দক্ষতার কাজের জন্যও পেশা তৈরির পছন্দের জায়গা হিসাবে রাজ্যের বাইরের এলাকা শীর্ষে চলে যাচ্ছে, তা হলে কিন্তু অনেক কিছু ভাবার থাকে। আজ বেঙ্গালুরুতে ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে মোটর সাইকেল করে ঘরে ঘরে খাওয়ার পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশই এই রাজ্যের।

এই জায়গাটাই কিন্তু চিন্তার। কাজের জগৎটা তো দক্ষতার পিরামিড। একদম নীচে থাকে সব থেকে কম দক্ষ কাজের জায়গা। এই জাতীয় কাজ প্রায় সব শিল্পেই প্রয়োজন হয়। যেমন হাউসকিপিং, ক্যুরিয়ার বা ড্রাইভার। আর এই দক্ষতার পিরামিডে যত উপরে উঠব, ততই তুলনামূলক ভাবে কাজের সুযোগ কমবে, চাহিদা থাকবে উচ্চ থেকে উচ্চতর শিক্ষার। তাই উচ্চশিক্ষিতরা স্বাভাবিক ভাবেই শুধু দেশের মধ্যেই নয়, গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। কিন্তু যখন সাধারণ কাজের জন্য বাইরের রাজ্যে যাওয়ার মিছিল লম্বা হতে থাকে, তখন চিন্তার জায়গা তৈরি হয় বইকি।

যাঁরা বাইরে যাচ্ছেন, তাঁরা যে শুধু কাজের সুযোগ নেই বলেই বাইরে দৌড়চ্ছেন, তা নয়। ফেরা যাক যে মেয়েটির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাঁর প্রসঙ্গে। তিনি কেন রাজ্য ছেড়ে, পরিবার ছেড়ে ভিন রাজ্যে হাজির হয়েছেন? তাঁর যুক্তি, এখানে কাজ থাকলেও কাজের পরিবেশ ও যথাযথ আয়ের সুযোগ নেই।

এই নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কিন্তু তাতে কি মেয়েটির মত বদলাবে? ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি বদলানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শুরু করে। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে মুখ করে সিআইআই-কে নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনার চেষ্টা শুরু হয়। মউ সই হতে থাকে। এর জন্য সোমনাথবাবুর নামই হয়ে যায় 'মউদাদা'। তখন এই ভাবমূর্তির বলি হয়েছিল শিল্পে নতুন বিনিয়োগ। আর এখন? কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও রাজ্যের ভাবমূর্তি কিন্তু রাজ্যের ছেলেমেয়েদের কাছেই নেতিবাচক।

আর এটাই চিন্তার। শিক্ষা থেকে পেশা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু রাজ্যের নতুন প্রজন্মের কাছে পছন্দের জায়গা পশ্চিমবঙ্গ নয়। একটা কথা তর্কের জন্য অনেকেই বলেন, কাজের পরিবেশ যে রাজ্যের বাইরে খুব ভাল, তা নয়। এ রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের খুব ফারাক নেই। তর্কের খাতিরে যদি তা মেনেও নিই, তা হলেও কিন্তু কর্মসন্ধানীদের যুক্তিটাও শুনতে হবে। এঁদের বক্তব্য হল— রাজ্যে কোনও কারণে একটা চাকরি খোয়ালে অন্য চাকরি পেতে কালঘাম ছুটে যায়। কিন্তু ভিন্‌রাজ্যে এই অসুবিধা নেই। আগে এই কথা শোনা যেত ইঞ্জিনিয়ারদের মতো পেশাদারী শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিদের কাছ থেকে। আজ কিন্তু শুনতে হচ্ছে সামান্য দক্ষ কর্মসন্ধানীদের কাছ থেকেও। শুধু নীতি নির্ধারকদের নয়, এ নিয়ে কিন্তু ভাবতে হবে যাঁরা কর্মসংস্থান তৈরি করেন তাঁদেরকেও।

Jobseekers of West Bengal West Bengal other state
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy