E-Paper

মস্তিষ্ক-তরঙ্গ যে ছবি আঁকে

সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, একটি বেসরকারি সংস্থা ভারত এবং তানজ়ানিয়ায় প্রায় আট হাজার মানুষের উপর ইইজি পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের তরঙ্গ সংগ্রহ করেছে।

আরণ্যক গোস্বামী

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:০৪

এক সময় মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচন ছিল কেবল বিজ্ঞানের অভিজাত গবেষণাগারগুলির একচেটিয়া অধিকার। সেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যদি পৌঁছে যায় ভারতের অজ পাড়াগাঁয়ে, কিংবা আফ্রিকার প্রত্যন্ত তানজ়ানিয়ার গ্রামে, সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়? অবিশ্বাস্য মনে হলেও, সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এমনই এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা জানিয়েছে। স্বল্প খরচে ইইজি পরীক্ষা ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গ সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা শুধু প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ভাঙছে না, বিজ্ঞানকে বাস্তবিক অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলছে।

সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, একটি বেসরকারি সংস্থা ভারত এবং তানজ়ানিয়ায় প্রায় আট হাজার মানুষের উপর ইইজি পরীক্ষার মাধ্যমে মস্তিষ্কের তরঙ্গ সংগ্রহ করেছে। এই পরীক্ষা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, ঘুম, মনোযোগ, স্মৃতি, বা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে। এত দিন এই ধরনের গবেষণার জন্য প্রয়োজন হত অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রযুক্তি, প্রশিক্ষিত কর্মী এবং নির্দিষ্ট গবেষণাগার। কিন্তু একটি সহজে ব্যবহারযোগ্য ও সাশ্রয়ী যন্ত্র উদ্ভাবনের ফলে, স্বল্প প্রশিক্ষণের পরেই কর্মীরা মস্তিষ্কের তথ্য সংগ্রহে পারদর্শী হয়ে উঠছেন। এই গবেষণা দেখিয়েছে, বিজ্ঞান এখন সবার জন্য, সবার মধ্যে, এবং সবার দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।

এটি শুধু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বিজ্ঞানের বৈষম্যমূলক কাঠামো ভাঙার ক্ষেত্রেও এটি এক বিপ্লব। আজ পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ নিউরোসায়েন্স গবেষণা হয়েছে পশ্চিমের দেশগুলির শিক্ষিত, শহরবাসী, শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এর ফলে বিশ্বের মস্তিষ্ক-গবেষণায় বহুলাংশে বাদ পড়েছে উন্নয়নশীল দেশের মানুষরা, বিশেষ গ্রামীণ ও জনজাতি জনগোষ্ঠী। কিন্তু ভারতের এই নতুন প্রকল্প সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে। এটি কেবল তথ্য সংগ্রহ নয়, বরং এক বিশাল অন্তর্ভুক্তির আন্দোলন— যেখানে গ্রামবাংলার কৃষক, প্রান্তিক নারী, এমনকি হিমালয়ের পাহাড়ি শিশুরাও বিজ্ঞানচর্চার মূল কেন্দ্রে উঠে আসছেন। যিনি কখনও স্কুলে যাননি, তিনিও যখন জানেন যে তাঁর মস্তিষ্কের ছবি সংরক্ষিত হয়েছে, হয়তো এক মস্ত কাজের অংশীদার হওয়ার তৃপ্তি অনুভব করেন।

এই গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তানজ়ানিয়ার হাডজাবে শিকারি গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ। এই জনগোষ্ঠী এখনও আধুনিক প্রযুক্তির বাইরে, যাঁদের জীবনধারা ও চিন্তাভাবনার ধরন একেবারেই ভিন্ন। তাঁদের মস্তিষ্কতরঙ্গ বিশ্লেষণ করে বোঝা গিয়েছে যে তথাকথিত আধুনিক শহরবাসীর মস্তিষ্কের তুলনায় তাঁদের চিন্তা ও বিশ্রামের ধরন আলাদা। এই বৈচিত্র থেকেই বোঝা যায়— মানুষের জ্ঞান অর্জনের বৈশিষ্ট্য প্রভাবিত হয় তার পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং অভ্যাসের দ্বারা। ফলে ভারত বা আফ্রিকার মতো দেশে যদি মানসিক স্বাস্থ্য নীতি, শিক্ষাব্যবস্থা বা ডিজিটাল প্রযুক্তি উন্নয়ন করতে হয়, তা হলে এ ধরনের স্থানীয় মস্তিষ্ক-তথ্য প্রয়োজন।

তবে এই যুগান্তকারী অগ্রগতির সঙ্গে কিছু গুরুতর নৈতিক প্রশ্নও উঠে আসে, যা এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। যে-হেতু ইইজি ডেটা মস্তিষ্কের সবচেয়ে সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করে, তাই এ সব তথ্য কারা সংগ্রহ করছে, কী ভাবে সংরক্ষণ করছে, এবং ভবিষ্যতে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে— এই নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা বা ‘গাইডলাইন’ থাকা অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় যোগদানকারীরা কি সত্যিই বুঝে ও সম্মত হয়ে এই গবেষণায় যোগ দিচ্ছেন? তাঁদের গোপনীয়তা ও সম্মান নিশ্চিত করতে কি উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে? আর এই গবেষণার ফলাফল থেকে যদি কোনও বাণিজ্যিক উদ্ভাবন হয়, তা হলে যোগদানকারীদের কাছে কী ভাবে তার সুফল পৌঁছবে? এই প্রশ্নগুলো নিছক বিজ্ঞানীরাই নয়, নীতি-নির্ধারক ও সাধারণ মানুষকেও ভাবতে হবে।

এই গবেষণার সামাজিক প্রভাবও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের মতো দেশে মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় সঙ্কট। চিকিৎসার অভাব, কুসংস্কার এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। এমন পরিস্থিতিতে এই যন্ত্র ব্যবহার করে মানসিক স্বাস্থ্যের কিছুটা সমস্যা শনাক্ত করা সম্ভব। হতাশা, একাগ্রতার অভাব, কিংবা বয়স্কদের মস্তিষ্কে অ্যালঝাইমার’স-এর ঝুঁকি, জনসমীক্ষায় এগুলির কোনও নকশা উঠে এলে জনস্বাস্থ্যও উপকৃত হবে।

এই প্রেক্ষাপটে ভারতের এই ইইজি উদ্যোগ শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিগত পরীক্ষা নয়— এ হল এক ধরনের নৈতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান আন্দোলন। যেখানে প্রতিটি মানুষ শুধু গবেষণার বিষয় নয়, গবেষণার অংশীদার। যেখানে বিজ্ঞান শুধু তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম নয়, মানুষকে বোঝার এক সেতু। সত্যিকারের বিজ্ঞান কেবল মস্তিষ্কের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে না, মানুষের অভ্যন্তরের স্বরকেও শুনতে চায়। উন্নয়নশীল বিশ্বে, যেখানে গবেষণা ও সুযোগ সীমিত, সেখানে এত কম খরচে এবং এত বৃহৎ পরিসরে এমন নিউরোসায়েন্স প্রকল্প চালানো সত্যিই এক বিশাল মাইলফলক। ভারত যে নজির স্থাপন করেছে, তা সারা বিশ্বকে দেখাচ্ছে কী ভাবে প্রযুক্তি, জ্ঞান, সুদূরপ্রসারী নীতি এবং মানবিক দায়িত্ববোধ এক সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে। এই পথ ধরেই হয়তো এক দিন আমরা এমন এক বিশ্ব গড়ব, যেখানে বিজ্ঞান হবে সর্বজনের, এবং যেখানে প্রতিটি মস্তিষ্ক তার নিজস্ব গল্প বলতে সক্ষম হবে।

ইউনিভার্সিটি অব আরকানস’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

NATURE Journal Neurons

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy