Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Joshimath

জোশীমঠ থেকে কী শিক্ষা পাচ্ছি? একই ভুল কি অন্যত্র বিপর্যয় ডেকে আনবে?

পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কি এ দেশে আদৌ সম্ভব? না হলে আর একটা জোশীমঠের দেখা আমরা কি শীঘ্রই পেতে চলেছি?

যুগ যুগ ধরে এই ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদের (বিশেষত বনভূমি) এবং ভূগর্ভের (খনিজ এবং অবশ্যই জল) সম্পদের অপচয় নিয়ে কোনও কথাই তেমন ভাবে উঠছে না।  

যুগ যুগ ধরে এই ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদের (বিশেষত বনভূমি) এবং ভূগর্ভের (খনিজ এবং অবশ্যই জল) সম্পদের অপচয় নিয়ে কোনও কথাই তেমন ভাবে উঠছে না।   ছবি: রয়টার্স।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:৩৩
Share: Save:

গাড়োয়াল হিমালয়ের তীর্থশহর জোশীমঠে ভূমিধসের বিষয়ে রিপোর্ট এবং ব্যখ্যাগুলিতে এ কথা উল্লিখিত থাকছে যে, এই বিপর্যয়ের পূর্বাভাস সম্পর্কে ইতিপূর্বে করা সাবধানবাণীগুলির প্রতি সেই জনপদের বাসিন্দাদের অবহেলা ছিল। সেই সঙ্গে এ-ও সত্য যে, সরকারি কাগজপত্রে বার বার উল্লেখ করা হয়েছিল, হিমালয়ের এই অঞ্চলে রেলপথ বিস্তার, সড়ক নির্মাণ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি উচ্চকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ অতিরিক্ত ঝুঁকির ব্যাপার। কেননা,যুগ যুগ ধরে ব্যাপক হারে অরণ্যভূমির ধ্বংসসাধন এই এলাকাকে বড় আকারের ধস এবং আনুষঙ্গিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে।

সংবাদমাধ্যমে জোশীমঠের ঘটনার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য ভাবে উঠে এসে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতি মানুষের ভাবনাকে অনেক ভাবে উস্কে দিল। উত্তর ভারতের শহরগুলিতে শীতকালীন বায়ুদূষণ, নাগরিক এলাকাগুলিতে জমতে থাকা জঞ্জালের পাহাড়, জলের মতো অপরিহার্য অথচ ক্রমাগত কমতে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ অপচয়, সেই সঙ্গে পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে হিমালয়ের হিমবাহগুলির গলনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মতো ঘটে চলা বিপদ ও অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্যের নির্গমন— ইত্যাদি বিষয় তার মধ্যে অন্যতম। এগুলির ভিতর থেকে যে বার্তাটি উঠে আসছে, তা হল এই যে, এই সব বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা ভাবনাচিন্তার স্তর থেকে কার্যকর হওয়ার স্তর পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। যুগ যুগ ধরে এই ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদের (বিশেষত বনভূমি) এবং ভূগর্ভের (খনিজ এবং অবশ্যই জল) সম্পদের অপচয় নিয়ে কোনও কথাই তেমন ভাবে উঠছে না।

অনেক পাঠকেরই এটা আশ্চর্য লাগতে পারে যে, ‘গ্রিন অ্যাকাউন্টিং’ বা মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে এই উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টার ফলে ঘটে যাওয়া পরিবেশ তথা প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতির তুল্যমূল্য হিসাব থেকে দেখা যায় যে, ভারত কিন্তু পরিবেশরক্ষার ব্যাপারে ধীরে অথচ অব্যাহত ভাবে এগিয়ে চলেছে। গত অক্টোবরে ‘রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বুলেটিন’-এ এই নিয়েই একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম খুব একটা মাথা ঘামায়নি বললেই চলে। সত্যি বলতে, প্রথাগত জিডিপির সঙ্গে ‘গ্রিন জিডিপি’ (পরিবেশবান্ধব জাতীয় উৎপাদন)-র ফারাকটি কমিয়ে আনার কাজটি নিরলস ভাবে হয়ে চলেছে। এ থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, প্রথাগত জিডিপির তুলনায় ‘গ্রিন জিডিপি’-র পরিমাণ বাড়ছে। অন্য ভাবে বললে, ভারত তার হারানো ‘জমি’ ফিরে পাচ্ছে।

এর পরে যদি আপনার মনে হয় যে, এই সব তথ্যের সঙ্গে ঘটমান বর্তমানের বিস্তর ফারাক থেকে যাচ্ছে, তবে বলা দরকার যে, সেই নিবন্ধে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সরকারের তরফে করা বেশ কিছু উন্নয়নমূলক কাজের উল্লেখ রয়েছে। সেগুলির মধ্যেপুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়া, জিডিপি-র প্রতি এককে সম্পদের ব্যবহার কমানো। ব্যাপক হারে এলইডি বাল্‌বের ব্যবহারে জোর দেওয়া এবং অধিক শক্তি খরচের প্রবণতাযুক্ত ক্ষেত্রগুলিতে ‘এনার্জি অডিট’ বাধ্যতামূলক করার নীতি, ব্যবহার্য বিভিন্ন বস্তুকে পুনর্নবীকরণের আওতায় নিয়ে আসা, স্বচ্ছ ভারত অভিযানের দ্বারা কঠিন বর্জ্য সঠিক ঠিকানায় পৌঁছনোর চেষ্টা, ‘নমামি গঙ্গে প্রকল্প’ ইত্যাদি এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য। এই নিবন্ধের লেখকরা এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, সাম্প্রতিক তথ্য তাঁদের হাতে এলে পরিবেশ বিষয়ক উন্নয়নে সরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে আরও বেশি আলোকপাত করা যেত।

বিশেষজ্ঞ নন, এমন মানুষের নজরে দেখলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বুলেটিনে প্রকাশিত সেই নিবন্ধকে ‘গ্রিন জিডিপি’-র মূল্যায়নের প্রাথমিক এক প্রচেষ্টা বলেই মনে হতে পারে। পরিবেশবান্ধব জিডিপি-র পরিমাপে যে সব পদ্ধতি এবং প্রাপ্য তথ্য-পরিসংখ্যান সেখানে ব্যবহার করা হয়েছেএবং সেই সব থেকে যে সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে সেগুলি আরও উন্নত হতে পারত।সম্ভবত সংজ্ঞাগুলিও স্পষ্ট হয়ে উঠত, যদি ওই কাজে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ একটু মাথা ঘামাতেন। এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্যে বলা ইতিবাচক বার্তাটিকে কিন্তু কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না। মূল প্রশ্ন এটাই থেকে যাবে যে, পরিবেশবান্ধব বা ‘গ্রিন’ জিডিপি (সংজ্ঞার দিক থেকে দেখলে যা মানবিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত) থেকে এ কথাও বোঝা যায়, হিসাব-নিকাশের নিরিখে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের বর্তমান অবস্থাটি ঠিক কেমন। প্রকৃত বা যথাযথ পরিসংখ্যান নির্ণয় কিন্তু যে কোনও সুস্পষ্ট এবং সংশোধনমুখী কাজের গোড়ার কথা। সুতরাং প্রথাগত জিডিপি-র পরিসংখ্যানকে কেন পরিবেশবান্ধব জিডিপি-র পাশাপাশি ফেলে দেখা হবে না? এই কাজটি করা গেলে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের প্রকৃত অর্থ বোঝা সম্ভব হত এবং তা নিয়ে যথাযথ ভাবে বিতর্কও করা যেত।

ইতিমধ্যে বেশ কিছু ব্যপারে মতামত ব্যক্ত করা এবং কিছু প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে বলে মনে হয়। জোশীমঠ-সংলগ্ন এলাকায় যদি নির্মাণকাজ সাময়িক ভাবে বন্ধও রাখা হয়, তা হলে হিমালয় ও অন্যান্য অঞ্চলে দেশ যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংক্রান্ত সাবধানবাণীগুলি উপেক্ষা করে আবার একই কাজ করে বসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের মতো জলাভাবযুক্ত এলাকায় ধান বা আখের মতো ফসলের চাষ করা আদৌ সঙ্গত কি, যে জন্য বিপুল পরিমাণ জলের প্রয়োজন? যে হেতু কৃষিক্ষেত্রেই জলের ব্যবহার সব থেকে বেশি, সেই দিক বিচার করে কৃষকদের তরফে ভূগর্ভস্থ জলের বর্তমানে যথেচ্ছ ব্যবহারের বিষয়টিকে কি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব?

তাঁদের কি কম জল ব্যবহার করে ধানচাষের মতো খরচসাপেক্ষ উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া উচিত? ইঞ্জিনিয়ার আর নির্মাণ শিল্পের মধ্যে সমঝোতা আদৌ ভাঙা সম্ভব? আমরা কি পরিবেশগত নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রেখে তৈরি আরও বেশি ক্ষমতাশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেখা পাব?

যদি এ সব না ঘটে, তা হলে জোশীমঠের ঘটনার অভিঘাত বড় জোর সপ্তাহখানেক টিকে থাকবে। তার পরে আবার যথেচ্ছাচার চলতে থাকবে।যা আমাদের নিয়ে যাবে আবার এক বিপর্যয়ের দিকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Joshimath Green GDP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE