Advertisement
E-Paper

এক আনা ভয়, চার আনা সাহস

ভোর থেকে রাত, ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করেই মেয়েরা বাঁচে। সাহসী না হয়ে তাদের উপায় নেই। লিখছেন সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়আর কত খারাপ হবে? বড় জোর মেরে ফেলবে! তা বলে জায়গা ছাড়ব না।’— মালা চালক, বর্ধমানের দাসপুরের বছর তিরিশেকের ঘরের বউ এমন এক মোক্ষম চাল চেলেছেন যে, আর কোনও ফিরতি চাল দেওয়া সম্ভব নয়।

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৩২

আর কত খারাপ হবে? বড় জোর মেরে ফেলবে! তা বলে জায়গা ছাড়ব না।’— মালা চালক, বর্ধমানের দাসপুরের বছর তিরিশেকের ঘরের বউ এমন এক মোক্ষম চাল চেলেছেন যে, আর কোনও ফিরতি চাল দেওয়া সম্ভব নয়। জীবনের মায়া ত্যাগ করতে পারলে, তার চেয়ে বড় জয় আর কী-ই বা হতে পারে, তাকে রোখার আর কোন পথই বা থাকে প্রতিপক্ষের হাতে? চলতি নির্বাচন ঘিরে যে হুমকি, ভয় দেখানো, মারধর, হিংসা মঞ্চস্থ হচ্ছে, মালা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এলাকাবাসী তাঁর কথায় ভরসা করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব প্রতিরোধ— বাধা দিতে এলে, মারতে এলে, আমরাও ফিরতি মারব। মরিয়া এমন হয়েছেন যে, এই বার, নিজেদের অপমান-শুদ্ধি, আধমরা-শুদ্ধি। শাসানি আর
ভয়ে গুটিয়ে যাওয়ার রুটিন ভাঙা। আর, ভেতর গুড়গুড় করলেও মরণ-ঝাঁপান। এই যে কিছুতেই নুয়ে-না-পড়ার জেদ, তা শাসক, বিরোধী, সবারই কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে পারে।

মেয়েরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন— ইতিহাস বেয়ে এ ধারা অটুট। নন্দীগ্রামে মেয়েরা নিজেদের দেওয়াল করে খাড়া করেছিল শাসক দলের গুন্ডাবাহিনী আর এলোপাথাড়ি লাঠি-গুলির সামনে। পরিণামে মিলেছিল ধর্ষণ আর ছিন্নভিন্ন দেহ। এখনও অনেক মেয়ে গোঙাচ্ছে, কাতরাচ্ছে, মাসুল দিচ্ছে। কিন্তু মার খেয়ে মেয়েরা পিছু কখনও হটেনি। বরং দ্বিগুণ তীব্রতা, তুলকালাম স্পর্ধা নিয়ে ফের নেমে পড়েছে ময়দানে। মৌসুমী কয়াল, টুম্পা কয়াল যখন গলা দাপিয়ে কামদুনির জন্য ন্যায় চেয়েছিল, বোঝা গিয়েছিল ন্যায়টা আসল, ভয়টা নয়।

এত বার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার পরও এমন সাহস আসে কী করে? মেয়েদের ভেতরেই কি লড়াকু সত্তা সঞ্চিত থাকে? তারা যখন ইচ্ছে শিশি থেকে সুবাস গায়ে মেখে নেওয়ার মতো করে লড়াইটাকেও ব্যবহার করে? একেবারেই নয়। সাহস আসে, কারণ তারাই ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করে সবচেয়ে বেশি, সারা জীবন, দিনরাত। বাড়িতে স্বামী-শাশুড়ি, বাইরে সমাজ-জ্যাঠারা, তার ওপর রাজনীতি। ভোরে সূর্য ওঠা থেকে রাতে সিরিয়াল শেষ হওয়া অবধি অন্যায় আর বঞ্চনার সঙ্গে ঘষাঘষিতেই লড়াকু-সঞ্জীবনী সঞ্চয় করে। এই রোজকার ঘর্ষণ— মার, অপমান, লজ্জা, কেরোসিনের লাইনে ঝগড়া, ঘর সেরে বাইরের কাজ— ছোট-বড় লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে থেকে আর তার সঙ্গে হাজারো নিয়ম-নিষেধে দম আটকে গেলেও জীবনটাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার এই যুদ্ধে এক সময় মরিয়া হয়ে কিছু কিছু মেয়ে প্রতিবাদে নেমে পড়ে আর লড়াই চালিয়ে নিয়ে যায়। তখন তারা খবর হয়, তখন সমাজ অবাক হয়।

রাজনীতি যাঁরা চালান, তাঁরাও এটা বুঝছেন। ক’দিন আগে বর্ধমানের রায়নাতে সিপিএম নেতা মেয়েদের পরামর্শ দিয়েছিলেন: আঁচলের তলায় মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে ভোট দিতে যান, প্রতিরোধ এলে পাল্টা ঝাঁটাপেটা করুন। সফল দাওয়াই। ভোটের দিন সকালে বহিরাগতদের এলাকা তোলপাড়ের অভিযোগ উঠল আর প্রমীলাবাহিনী তেড়ে গেল।

এটাও কি মেয়েদের সুকৌশলে ব্যবহার করার পিতৃতন্ত্র নয়? হতে পারে। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে লড়াইটা তো মেয়েরাই করেছে। লালগড়ের লড়াইয়ে ৫০ শতাংশ মেয়ে ছিল। গাজায় যখন ইজরায়েলের সেনা-ট্রাক গুঁড়িয়ে দিতে চায় একটা পুরো দেশের ও তার মানুষের অস্তিত্ব, তখন মেয়েরাই তৈরি করে মানব-দেওয়াল। পুরস্কারজয়ী ফোটোগ্রাফারের ক্যামেরায় বন্দি থাকে সারি সারি সাহসী আর ভয়ার্ত মুখের মেয়ের দল। ভয় কি তাদের করে না? নিশ্চয়ই করে। কিন্তু এক সময় পরিস্থিতি বুঝে ময়দানে নেমে পড়তে হয়। শেষ দেখতে চাইতে হয়। এই লড়াইটাই মেয়েদের পিতৃতন্ত্রের আওতা থেকে ছিনিয়ে আনবে, আনছে।

ওই যে কল্যাণীর শিবু দাস, ভোট দিতে গিয়েছিলেন বলে হাত ভেঙে দিয়েছে যাঁর, তাঁর বউ টুলটুল বলেছিলেন, ‘ওরা যখন মারলই, তখন আজ আমরা ভোট দেবই। ভয় পেলে ওরা আরও ভয় দেখাবে।’ এক আনা ভয়ের বদলে এখন চার আনা সাহস দেখানোর সময়।

woman rights election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy