Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

গাঁধীর কপালে ভবঘুরে তকমাও জুটেছিল

দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরে যেতে যেতেও গাঁধীকে পাড়ি দিতে হয়েছিল মুম্বইয়ে। আর তার বছর ছয়েক পরেই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে তাঁর প্রথম জনসভা। লিখছেন রাজনারায়ণ পাল এসেছিলেন এ শহের দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে, সেখানকার ভারতীয়দের দুরবস্থার কথা সকলকে অবহিত করতে। কিন্তু এখানে বাধ সাধল, পরিচিতির অভাব।

রাজনারায়ণ পাল
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:৪৩
Share: Save:

সে ছিল তাঁর দ্বিতীয় বার কলকাতায় আসা। অচেনা শহর, কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন কিছুই জানা নেই। অগত্যা উঠলেন রাজভবনের বিপরীতে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। বিকেল কাটালেন থিয়েটার দেখে। এ সময়ে ওই হোটেলেই তাঁর পরিচয় হয় দৈনিক টেলিগ্রাফের সাংবাদিক জন এলারথ্রপের সঙ্গে। তিনি তখন থাকতেন সাহেবদের ডেরা বেঙ্গল ক্লাবে। গাঁধীজির সান্নিধ্য এলারথ্রপের ভাল লেগেছিল। তিনি তাঁকে বেঙ্গল ক্লাবে আসার আমন্ত্রণ জানালেন। গাঁধীজিও না করতে পারেননি। যথাসময়ে হাজির হন সেখানে। কিন্তু বিধি-বাম। বেঙ্গল ক্লাব ড্রয়িংরুমে গাঁধীজিকে ঢুকতে দিল না। সে কালের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইউরোপিয়ান ক্লাবের বসার ঘরে ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অগত্যা এলানথ্রপ তাঁকে তার শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। লজ্জিত হলেন গাঁধীজির কাছে। স্থানীয় ইংরেজদের প্রতি এই বিরুদ্ধভাবের জন্য ক্ষমাও চাইলেন। কলকাতা শহরে গাঁধী-বিমুখতার প্রথম নজির। সময় যত গড়িয়েছে গাঁধীজির অনুরূপ অভিজ্ঞতার সংখ্যা মাত্রাহীন হয়েছে।

এসেছিলেন এ শহের দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে, সেখানকার ভারতীয়দের দুরবস্থার কথা সকলকে অবহিত করতে। কিন্তু এখানে বাধ সাধল, পরিচিতির অভাব। ঠিক করলেন বাংলার সর্বজনমান্য ব্যক্তিত্ব সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। এক দিন উপস্থিত হলেন তার ডেরায়। সুরেন্দ্রনাথ তখন বাংলার ডাকসাইটে নেতা। সর্বদা অনুগামী পরিবৃত। সবাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়। তবু তারই মাঝে গাঁধীজি তাঁর আগমনের হেতু রাষ্ট্রগুরুর সমীপে পেশ করলেন। গাঁধীজির উদ্দেশ্যও তার বাস্তবায়ন সম্পর্কে রাষ্ট্রগুরু দ্বিধায় পড়লেন। জানালেন, তাঁর এ কাজে কলকাতাবাসী মনোযোগ দেবে বলে মনে হয় না। এখানে নানান ঝঞ্ঝাট। ওই বিষয়ে তবু সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। পরামর্শ দিলেন যোগাযোগ করতে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের সঙ্গে ও রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় আর মহারাজ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। এরা উদার প্রকৃতির ও জনসেবামূলক কাজে উৎসাহী। অগত্যা এদের সবার সঙ্গেই গাঁধীজি দেখা করলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। তারা কেউ গা লাগালেন না। দু’জনেই বললেন, কলকাতায় জনসভার আয়োজন করা সহজ নয়। আর যদি কিছু করতেই হয়, তবে সুরেন্দ্রনাথের উপরে নির্ভর করেই করতে হবে। হতাশ হলেন ভবিষ্যতের জাতির জনক। ভুললে চলবে না, এ গাঁধী তখনও মহাত্মা নন। কেবলই মোহনদাস মাত্র।

কলকাতার নেতৃবৃন্দ তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল না। অগত্যা প্রাথমিক হতাশা কাটিয়ে তিনি এ বার হানা দিলেন শহরের পত্র-পত্রিকার অফিসগুলিতে। সে সময়ে কলকাতার দুই নামজাদা পত্রিকা অমৃতবাজার পত্রিকা আর বঙ্গবাসী। প্রথমে হাজির হলেন অমৃতবাজার দফতরে। সেখানে গিয়ে যার সঙ্গে কথা বললেন, তিনি গাঁধীজিকে ভবঘুরে ভাবলেন। ফলে কাজের কাজ কিছুই হল না। এর পরে বঙ্গবাসীর অফিসে গেলেন। সেখানেও নাকালের একশেষ হলেন। সম্পাদক তাঁকে বসিয়ে রাখলেন। গাঁধীজি অপেক্ষা করতে করতে দেখলেন, লোকে সম্পাদকের কাছে যাচ্ছে আর আসছে। কিন্তু তাঁর দিকে ফিরে তাকাবারও সময় নেই তাঁর। অগত্যা ঘণ্টা খানেক পর তিনি নিজেই সম্পাদকের কাছে গিয়ে তার নিজের কথা বলতে শুরু করলেন। এতে রুষ্ট সম্পাদক তাঁকে এক হাত নিলেন। বললেন—‘আপনি দেখছেন না, আমার হাতে কত কাজ আছে, আপনার মতে বহু লোক আমার কাছে আসে যায়। আপনি চলে যেতে পারেন। আমি আপনার কথা শুনতে পারব না’। এ শ্লেষ বাক্য গাঁধীজির মনে আঘাত হানল। দুঃখিত হলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সম্পাদকের অবস্থাও উপলব্ধি করলেন। বঙ্গবাসী কলকাতার নাম করা কাগজ। সেখানে আলোচ্য বিষয়ের অভাব নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার নাম তখনও এখানে কেউ শোনেনি। অগত্যা গাঁধী নিরস্ত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, যারা সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে, তারা নিজ নিজ দুঃখকেই বড় বলে মানে। প্রতি জম জন মনে করে সম্পাদকের মস্ত বড় একটা শক্তি আছে। কিন্তু সম্পাদকের কর্তৃত্ব তো তার অফিস ঘরের দরজার বাইরে এক পা-ও নয়।

খানিকটা হতাশ হলেও গাঁধীজি হাল ছাড়লেন না। ভুলে গেলে চলবে না, পরবর্তীকালে গোটা জাতি তাকে মহাত্মা বলে কুর্নিশ জানাবে, হয়ে উঠবেন তিনি জাতির জনক। সুতরাং অত সহজে যে তিনি ভেঙে পড়বেন না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ বার অন্য কাগজের দফতরে সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করলেন। এমনকি ইংরেজ পরিচালিত সংবাদপত্র অফিসেও। সে সময়ে ‘স্টেটসম্যান’ ও ‘ইংলিশম্যান’ ছিল শহরের দুই বড় ইংরেজি সংবাদপত্র। গাঁধীজি তাদের দরজায়ও কড়া লাড়লেন। উভয় কাগজই দক্ষিণ আফ্রিকার গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল। তারা গাঁধীজির বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে শুনলেন। স্টেটসম্যান কাগজের এক সাংবাদিক গাঁধীজির সাক্ষাৎকার নিলেন। ১১ নভেম্বর, ১৮৯৬-এর কাগজে তা ছাপা হল—‘Aggrieved Indians in South Africa/ Interview with Mr. M.K. Gandhi’ শিরোনামে। কলকাতার কাগজে প্রকাশিত এটা গাঁধীজির প্রথম সাক্ষাৎকার।

সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের উপর শ্বেতাঙ্গ অত্যাচারের প্রধান কারণ হিসেবে ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের বাণিজ্যিক হিংসাকেই দায়ী করেন। ভারতীয়দের শ্রমের উপর নির্ভর করেই ঔপনিবেশিকেরা সে দেশে যাবতীয় কর্মকাণ্ডও করে থাকে। কিন্তু সেই ভারতীয়রা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বাধীন উদ্যোগ শুরু করে ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের প্রতিযোগিতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, তখনই তাদের উপর ঔপনিবেশিক আইন খড়্গহস্ত হয়। নেমে আসে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের অসম্মান ও অমর্যাদার সুসংগঠিত সাঁড়াশি আক্রমণ। ঔপনিবেশিক আইনেও তার আঁচ লাগে।

সেই সময় ইংলিশম্যানের সম্পাদক সনডার্স সাহেবের সঙ্গে গাঁধীজির যখন পরিচয় হল, তিনি তাঁকে আপন করে নিলেন। তবে তার আগে কম জেরা করেননি। শেষে যখন বুঝলেন গাঁধী নিরপেক্ষ, দক্ষিণ আফ্রিকার শেতাঙ্গ স্বার্থও তিনি পক্ষপাতশূন্য দৃষ্টিতেই দেখছেন, তখন তার অফিস ব্যবহারের অনুমতিই শুধু দিলেন না, অবাধে তার কাগজখানাও যথেচ্ছ ব্যবহারে সম্মতি দিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি বর্ণ বিদ্বেষ প্রসঙ্গে সনডার্স যে সব সম্পাদকীয় কলম লিখলেন, সেখানে প্রয়োজন মত কলম চালাতে গাঁধীজিকে অবাধ স্বাধীনতা দিলেন। ক্রমে অল্প কয়েক দিনেই উভয়ের মধ্যে ভাব জমে ওঠে, পরে গাঁধীজি দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে গেলেও এ সম্পর্ক অটুট রয়ে যায়। কলকাতায় দেশীয় নেতৃবৃন্দ ও সংবাদপত্রের উপেক্ষার পাশে শ্বেতাঙ্গ কাগজের তরফে এ রূপ অপ্রত্যাশিত সাহায্য শহরে জনসভা করার গাঁধীজির প্রত্যাশাকে খানিকটা উসকে দিল। কিন্তু আচমকা সাগরপারের এক টেলিগ্রাম পৌঁছল গাঁধীজির হাতে। ডারবান থেকে প্রেরিত সে তার বার্তা নিয়ে এল—‘জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট, শীঘ্র ফিরে আসুন’। নিরুপায় গাঁধীজি রওনা দিলেন মুম্বই। দিনটা ছিল ১৪ নভেম্বর, ১৮৯৬। পিছনে পড়ে রইল আমাদের কলকাতা।

পুনশ্চ, যা বলা হয়নি এই ঘটনার আরও বছর ছয়েক পরে (১৯০২) কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক জনসভা হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকার বর্ষীয়ান সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ সেন। লক্ষণীয়, এ সভার সলতে পাকানোর আয়োজন যিনি করেছিলেন তিনি কোনও রাজনীতিক নন, প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কলকাতার বুকে এটাই গাঁধীর প্রথম জনসভা।

শিক্ষক এবং গাঁধী-গবেষক, মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vagabond Mahatma Gandhi Tag
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE