প্রতি বছর দোল ও কালীপুজোর আগে গণমাধ্যমে একটা খবর প্রকাশিত হয়, যার মর্মার্থ এই— এ বছর এই উৎসবে অতিরিক্ত পুলিশি সতর্কতা গৃহীত হচ্ছে। এই সতর্কবার্তা (ঝঞ্ঝার আগে সামুদ্রিক অঞ্চলে যেমনটা হয়) এতটাই ‘স্বাভাবিক’ আমাদের কাছে যে, আমরা এই প্রশ্ন কখনও তুলি না, ঠিক কোন আহ্লাদে এই দুই উৎসবে অতিরিক্ত সতর্কতার রাস্তায় হাঁটতে হয় পুলিশ-প্রশাসনকে? কালীপুজোয় বাজির কারবার, আগুন লেগে যাওয়ার ভয় রয়েছে। কিন্তু দোল? সেখানে তো জল আর রঙ। তা হলে প্রতি বছর কেন সতর্কতা? কেন ‘অতিরিক্ত’ সতর্কতা? এই পর্যন্ত পড়ে বুজুর্গ পাঠক নাক সিঁটকোতে পারেন। ইলেক্ট্রোক্ষিপ্ত পাঠিকা মুখ ঝামটে বলে উঠতেই পারেন— ন্যাকা! জানে না যেন, কী বেলেল্লাপনা দোলের দিন হয়! হ্যাঁ মহাশয়া, জানি। আর জানি বলেই বাঙালির দোল-বেলেল্লাপনার একটা সংক্ষিপ্ত ঝাঁকিদর্শন এখানে লেখার অপচেষ্টা করছি।
বিহার প্রদেশ থেকে আগত এক বন্ধু জানিয়েছিলেন, তাঁদের মুলুকে দোল খেলা আরম্ভ হয় হোলির এক মাস আগে আর শেষ হয় হোলির এক মাস পরে। দু’মাস ধরে রং খেলা চলে— এই নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করায় তাঁর মন্তব্য ছিল, “হোলি যে রং নিয়েই খেলতে হবে, কে বলেছে? গ্রামের রাস্তায় কেউ হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁকে চার-পাঁচজন ঘিরে ধরে চ্যাংদোলা করে পাশের নর্দমায় ফেলে দিয়ে ‘হোলি হ্যায়’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেই তো খেলা জম-জমাট।” না। এ হেন আগ্রাসী ও দীর্ঘমেয়াদি দোল খেলায় বাঙালি বিশ্বাস রাখে না। কিন্তু এক দিনের বসন্তোৎসবে সে যা করে নেয়, তা সম্বৎসরের রসদ। খুব সাম্প্রতিকের ভাষায় বলতে গেলে—‘কেঁখে মস্তি’। এ হেন ‘মস্তি’র ঠেলা সামলাতে প্রশাসনের জিভ বেরিয়ে যেতে পারে। যায়ও। আর এই প্রাণান্ত কোনও সাম্প্রতিক হিড়িক নয়, এটা বাংলা বা বাঙালির কৌলিক।
কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সেলিব্রেটেড কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তর কলকাতার কবিতা’-য় দোল নিয়ে অনবদ্য এক কবিতা লিখেছিলেন, যার প্রথম দুই পঙক্তি ছিল— “ধাঙড় বস্তিতে গিয়ে হোলির বাঁদুরে রং/ মেখে নিলে বোঝা যায় বসন্তের মর্মবেদনা”। সেই কবিতা শেষ হয়েছিল এই পংক্তিতে— “এবার বসন্ত গেল বাংলা মদ, তাসায়, আশায়”। পুরো কবিতা উদ্ধারের দরকার পড়ে না, শুরু আর শেষেই বোঝা যায় হোলির অন্তরে নিহিত বেদনার উৎস ঠিক কোথায়, তার অনুষঙ্গগুলিই বা ঠিক কী কী। দোল ততক্ষণ দোল নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত তার অন্তঃস্থল থেকে নিঙড়ে বের করে আনা হচ্ছে এই বেদনাবোধকে। আর এই নিংড়ানোর পদ্ধতিটাই হল ‘মস্তি’, ‘কেঁখে মস্তি’।