ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে।
মদ্যপান যে ক্ষতিকর, সে কথা নূতন নহে। কিন্তু দেশের অর্থনীতির নিরিখে সেই ক্ষতির পরিমাপ কতটা, সে সম্পর্কে এত দিন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সম্প্রতি দেশের দুই শীর্ষ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকেরা দেখাইলেন, মদ্যপান-জনিত অকালমৃত্যু, কর্মশক্তিনাশ ও চিকিৎসার ব্যয়জনিত কারণে দেশের মোট উৎপাদনে যে ক্ষতি হয়, তাহার অঙ্ক স্বাস্থ্য বাজেটের বরাদ্দকে ছাড়াইয়া যায়। স্বাস্থ্যের জন্য বার্ষিক ব্যয় কেন্দ্রীয় বাজেটের ১.১ শতাংশ, আর মদ্যপানের জন্য ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়াইয়াছে বাজেটের ১.৪ শতাংশ। ইহাও সম্পূর্ণ হিসাব নহে। মদ্যজনিত যকৃতের অসুখ, ক্যানসার ও পথ দুর্ঘটনার জন্য নষ্ট কর্মদিবস এবং চিকিৎসার ব্যয় ধরিয়া ওই হিসাব করা হইয়াছে। মত্ততাজনিত গার্হস্থ্য হিংসা প্রভৃতি সামাজিক ক্ষতির হিসাব ধরেন নাই। দিল্লির এবং চণ্ডীগড়ের দুই সরকারি স্নাতকোত্তর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-গবেষকদের এই সমীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ। মদ্যের উপর কর হইতে প্রাপ্য রাজস্ব বহু রাজ্যের বার্ষিক আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই কারণে বিভিন্ন রাজ্য সরকার মদ্যপানের স্বাস্থ্যহানিকর দিকটি বুঝিয়াও, কার্যক্ষেত্রে রাজ্যবাসীকে মদ্যপানে নিরুৎসাহ করিতে যথেষ্ট উদ্যোগী নহে। পশ্চিমবঙ্গ তাহার অন্যতম উদাহরণ। রাজ্য সরকার স্বয়ং এ রাজ্যে মদ্যের পাইকারি বিক্রেতা হইবার পর লাইসেন্স-প্রাপ্ত দোকান বাড়িয়াছে, রাজস্বও দ্রুত বাড়িতেছে। কিন্তু এই সহজ আয়ের বিপরীতে রহিয়াছে অগণিত জীবনের অপচয়। চিকিৎসার খরচের বৃহদংশ রোগীই বহন করেন, তাই ক্ষতি দৃষ্টি এড়াইয়া যায়।
ক্ষতি কম নহে। ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে নিয়মিত মদ্যপান করেন পুরুষদের ত্রিশ শতাংশ, মহিলাদের দেড় শতাংশ। এই হার অব্যাহত থাকিলে ২০৫০ সালে মদ্যপানজনিত ক্ষতির পরিমাণ ২০১৮ সালের ভারতের জিডিপির তুলনায় বেশি হইবে। এমন গবেষণা কি রাজ্য সরকারগুলির চোখ খুলিতে পারিবে? ভারতে চারটি রাজ্য এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মদ্যপান নিষিদ্ধ। বিশেষত ২০১৬ সালে বিহারে গার্হস্থ্য হিংসা প্রতিরোধে মদ্যপান নিষিদ্ধ করিয়া নীতীশ কুমার মহিলাদের রাজনৈতিক সমর্থন পাইয়াছেন। কিন্তু ইহাও সত্য যে আইন করিয়া মদ্যপান শেষ অবধি প্রতিহত করা যায় নাই। কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, হরিয়ানা প্রভৃতি রাজ্য নানা সময়ে মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াও, পরে অপসারণ করিয়াছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষার গবেষকরা প্রস্তাব দিয়াছেন,
মদ্যের উপর কর এতটাই বাড়াইতে হইবে যাহাতে তাহার ব্যবহার কমিয়া আসে।
মদ্যপানের প্রসঙ্গে নৈতিক প্রশ্নটি নাগরিক অধিকারের। নাগরিকের খাদ্যপানীয়ের অভ্যাস তাহার জীবনযাত্রার অঙ্গ। রাষ্ট্র ব্যক্তিপরিসরে হস্তক্ষেপ করিবে না, ইহাই কাঙ্ক্ষিত। এত দিন কেন্দ্র এ বিষয়ে রাজ্যগুলির উপর সিদ্ধান্তের ভার ছাড়িয়াছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের যে সঙ্কট গবেষকরা দেখাইয়াছেন, তাহাতে আজ ব্যক্তিস্বাধীনতার সহিত জনস্বার্থের একটা সংঘাত উপস্থিত হইয়াছে। মানবসম্পদের সুরক্ষাও সরকারের কর্তব্য। সরকার নিশ্চেষ্ট থাকিতে পারে না। তবে নিষেধাজ্ঞা জারিই একমাত্র উপায় নহে। মদ্য-বিরোধী প্রচার, আসক্তি নিবারণের ব্যবস্থা, মদ্যের রাজস্বের উপর নির্ভরতা হ্রাস, করণীয় কিছু কম নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy