Advertisement
E-Paper

রসবোধের মৃত্যু

সু প্রিম কোর্টের রায়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তো বটেই, সম্ভবত স্বয়ং বিষ্ণুও স্বস্তির শ্বাস ছাড়িবেন। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতার রূপে সজ্জিত হইয়া হাতে একটি জুতা লইয়া ছবি তোলাইলে তাহাতে ধর্মের ঘোর অপমান হয়

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০

সু প্রিম কোর্টের রায়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি তো বটেই, সম্ভবত স্বয়ং বিষ্ণুও স্বস্তির শ্বাস ছাড়িবেন। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতার রূপে সজ্জিত হইয়া হাতে একটি জুতা লইয়া ছবি তোলাইলে তাহাতে ধর্মের ঘোর অপমান হয়— এমন একটি অভিযোগ খাড়া করিতে হইলে রসবোধের যতখানি অভাব প্রয়োজন, হিন্দুধর্মে তাহা কখনও ছিল না। বস্তুত, দেবতাকে প্রিয় করিয়া, তাঁহার উপর মানুষের চারিত্রিক দোষ-গুণ আরোপ করিয়া, তাঁহাকে গল্পে-লোকগাথায় আপন করিয়া লওয়াই হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য। সেই গল্পগুলি নির্বিকল্প দেবমাহাত্ম্যের, নাগপুরও তেমন দাবি করিবে না। তাহাতে ধর্মের অপমান হয় নাই, দেবতারাও সম্ভবত ক্ষুণ্ণ হন নাই। বরং, এই রসবোধ হিন্দুধর্মের ধারাটিকে সজীব রাখিয়াছে। রামরাজত্ব আসিয়া পড়িয়াছে বলিয়াই কি অপমানের বোধ এমন অহেতুক তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিল? তবে, অসহিষ্ণুতা আর রসবোধ হাত ধরাধরি করিয়া চলে না। বস্তুত, রসবোধ বস্তুটির চরিত্রই এমন যে তাহা মানুষকে অসহিষ্ণু হইতে দেয় না— হাসিয়া ফেলিলে আর রাগ করিবার উপায় থাকে না। ভারতে এখন অসহিষ্ণুতাই ধর্ম। সংখ্যাগরিষ্ঠের অসহিষ্ণুতা। যে কোনও বিষয়কেই ধর্মের অপমান হিসাবে দেখিবার প্রবণতাটি ক্রমে সর্বজনীন হইতেছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এই গোত্রের মামলাগুলি হয়তো আদালতের চৌকাঠ পার হইবে না, কিন্তু সমাজের অভ্যন্তরে অসহিষ্ণুতা ও তাহার প্রতিক্রিয়ার চোরাস্রোত ঠেকাইতে পারে, সেই সাধ্য কাহার। অনুমান করা চলে, নাগপুরায়িত ভারতে আরও অকিঞ্চিৎকর ঘটনায় আরও অনেক তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিতে হইবে।

রসবোধ সবলের ধর্ম। সংখ্যাগরিষ্ঠতা সেই বলের অন্যতম উৎস। ভারতে হিন্দুধর্মের মধ্যে যে কৌতুকপ্রবণতা ছিল, লঘুরসের প্রতি উদারতা ছিল, তাহার একটি কারণ কি ইহা নহে যে এই দেশে চিরকালই হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ? সংখ্যালঘুর পক্ষে এই শিথিলতা দেখানো অনেক সময় সম্ভব হয় না— তাহারা সংখ্যালঘু বলিয়াই। ভারতে ধর্মীয় অনুপাত রাতারাতি বদলাইয়া যায় নাই। কিন্তু, হিন্দুদের মধ্যে ক্রমে সংখ্যালঘু-মানসিকতা তৈরি হইতেছে। সংখ্যালঘুরা যে ভয়ে ভীত থাকেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যেও সেই ভয়গুলি দানা বাঁধিতেছে। সেই ভয়ের কোনও ভিত্তি নাই। কিন্তু, ‘গেল, গেল’ ভাবটি জমিয়া বসিলে ধর্মীয় রাজনীতির কারিগরদের সুবিধা— ভীত মানুষকে জোটবদ্ধ করা সহজ।

ভারতে হিন্দুদের মধ্যে ‘মাইনরিটি কমপ্লেক্স’ বস্তুটিও স্বয়মাগত নহে। তাহা নির্মিত হইতেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁহার ভাষণে ঈদের সহিত দীপাবলির, অথবা শ্মশানের সংখ্যার সহিত কবরস্থানের সংখ্যার তুলনা করেন, তখন তাহা এই নির্মাণপ্রক্রিয়ারই অংশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বিদ্বেষী বার্তাগুলি ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহাও। প্রক্রিয়াটি বিপুল। তাহার মূল সুর— ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে নেহরু-যুগের ভারতে হিন্দুদের স্বার্থ সমানেই ক্ষুণ্ণ হইয়াছে। এখন সেই ক্ষতি পূরণ করিবার সময়। ফলে, যেখানে ধর্মের গায়ে আঁচ়়ড়টুকুও লাগে না, তেমন প্রশ্নকেও ধর্মের অপমান হিসাবে দেখা হইতেছে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বিরুদ্ধে হওয়া মামলাকে এই প্রবণতার অংশ হিসাবে দেখাই বিধেয়। তবে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ভরসা, সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী হইবার মতো শক্তি ভারতে এখনও আছে।

Humor Destroyed
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy