Advertisement
E-Paper

দেবদেবীদের নিয়ে রসিকতা? নহীঁ চলেগা

খুশি হতে পারেননি হিন্দু জাগরণ মঞ্চের কর্তা ও কর্মীরা, যাঁরা এখন নরেন্দ্র মোদীর নিউ ইন্ডিয়া-র অভিভাবক। ওই বিজ্ঞাপন দেখে তাঁরা রায় দিয়েছেন: দেবদেবীদের বিউটি পার্লারে এনে তাঁদের অপমান করা চলবে না।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
জাগ্রত: জাভেদ হাবিবের পার্লারে হিন্দুত্বের রক্ষাকর্তাদের ‘বিক্ষোভ’। ঠানে, মহারাষ্ট্র। ছবি: গেটি ইমেজেস

জাগ্রত: জাভেদ হাবিবের পার্লারে হিন্দুত্বের রক্ষাকর্তাদের ‘বিক্ষোভ’। ঠানে, মহারাষ্ট্র। ছবি: গেটি ইমেজেস

জাভেদ হাবিব ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁর কেশসজ্জার কারবার। পুজোর সময় সেই ব্যবসায় জোয়ার আসে। যেমন আর পাঁচটা ব্যবসাতেও। জোয়ারের জল যতটা সম্ভব নিজের নিজের খেতে টেনে আনার তাগিদে ব্যবসায়ীরা এই মরশুমে কবজি ডুবিয়ে বিজ্ঞাপন করেন। যাঁরা বিজ্ঞাপন তৈরি করেন, তাঁদের কাজটা রীতিমত কঠিন। সবাই যখন রকমারি কৌশলে ক্রেতা ধরতে চাইছে, সেই ভিড়ের মধ্যে আরও আরও ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ কথা নয়। তাই বিজ্ঞাপন ভাবতে হয়। এমন বিজ্ঞাপন, যা দেখলে মানুষের মনে আপনিই পুজোর আমেজ আসবে, আবার তার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনী পণ্য বা পরিষেবাটির প্রতিও আকৃষ্ট হবে সে। জাভেদ হাবিবের পার্লারের বিজ্ঞাপনটিতে তেমন ভাবনার অভিজ্ঞান আছে। সেখানে মা দুর্গা তাঁর ছেলেমেয়ে সিংহ-টিংহ সবাইকে নিয়ে সিধে পার্লারে ঢুকে পড়েছেন। যে যার সিট বেছে নিয়ে বসে গিয়েছে, কারও রূপটান শুরু হয়ে গিয়েছে, কেউ একটু আয়েশ করে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে দিব্যি জমেছে, যেন পুজোসংখ্যায় ছবিতে গল্প, সে ছবির দিকে একটুখানি তাকিয়ে থাকলে ঢাকের আওয়াজ শোনা যায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে— আশ্বিনের শারদপ্রাতে...। অনুমান করতে পারি, বিজ্ঞাপন-ভাবনাটি দেখে হাবিব ও তাঁর সহকর্মীরা খুশি হয়েছিলেন।

খুশি হতে পারেননি হিন্দু জাগরণ মঞ্চের কর্তা ও কর্মীরা, যাঁরা এখন নরেন্দ্র মোদীর নিউ ইন্ডিয়া-র অভিভাবক। ওই বিজ্ঞাপন দেখে তাঁরা রায় দিয়েছেন: দেবদেবীদের বিউটি পার্লারে এনে তাঁদের অপমান করা চলবে না। এবং, যে কথা সে-ই কাজ, ইতিমধ্যেই দেশের নানা এলাকায় জাভেদ হাবিবের কয়েকটি পার্লারে পবিত্র ভাঙচুর সম্পন্ন হয়েছে, জাগ্রত হিন্দুরা জানিয়ে গিয়েছেন, পার্লার বন্ধ না করলে আরও বিপদ আসছে। সোশ্যাল মিডিয়া নামক পরিসরটিতেও সেই হুমকির অমোঘ, অনিবার্য প্রতিধ্বনি: হিন্দুধর্মের অপমান চলবে না! শোরগোলের প্রথম প্রহরেই হাবিব নিজে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন, বলেছেন কাউকে আঘাত করার কোনও উদ্দেশ্য ছিল না তাঁর। কিন্তু বিপদ কাটেনি।

কাটার কথাও নয়। জাভেদ হাবিব উপলক্ষমাত্র। উপলক্ষ হিসেবে তিনি অবশ্য অত্যন্ত উপযোগী: মকবুল ফিদা হুসেন থেকে জাভেদ হাবিব— সুযোগ পেলেই পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার, হিন্দুর ভারতে তাঁদের কী ভাবে বাঁচতে হবে, কী কী করা চলবে না। কিন্তু নিউ ইন্ডিয়ার জাগ্রত হিন্দুরা যে বার্তা পৌঁছে দিতে তৎপর, সেটির লক্ষ্য কেবল হাবিব বা হুসেনরা নন, আসমুদ্রহিমাচল তামাম ভারতবাসী। অনাবাসীরাও নিশ্চয়ই আছেন সেই তালিকায়, তবে তাঁরা তো এমনিতেই সংঘ-অন্ত-প্রাণ। (সবাই নিশ্চয়ই নয়, তবে যারা নয় তাদের জাগরণের চেষ্টা করে বোধহয় লাভ নেই।)

কিন্তু বার্তাটি কী? দেবদেবীর অপমান নহীঁ চলেগা? অপমান কাকে বলে? হিমালয়নন্দিনী সপরিবার বাপের বাড়ি আসছেন, তার আগে একটু ফিটফাট হয়ে নেবেন বলে পার্লারে গিয়েছেন— এ যদি অপমান হয়, তবে তো বাংলা গল্প, ছড়া, নাটক, গান, চলচ্চিত্র ইত্যাদির আধখানাই বিসর্জন দিতে হয়! মা-দুর্গা আর তাঁর পরিবারের লোকজন নিয়ে কত রঙ্গই না আমরা চিরটাকাল করে এসেছি। সত্যি বলতে কী, দুর্গা তো তবু দেখতে-শুনতে বেশ স্নেহময়ী মতো, অনেক সময়েই তাঁর মুখে আবার চিত্রতারকার আদল, যতই ত্রিশূল দিয়ে অসুর মারুন, তাঁকে দেখে ভয়-টয় লাগে না, কিন্তু অমন যে নৃমুণ্ডমালিনী শ্রীমতী ভয়ংকরী, সেই শ্মশানচারিণী দেবীটিকে নিয়েও তো আমাদের কবিরা কত রকমের গান বেঁধেছেন, সে-সব গানে তাঁর ওপর রাগ করে কত আকথা-কুকথা বলেছেন, সন্তান যেমন মাকে বলেই থাকে, কই, শ্যামা-মা তো অপমানিত হননি, বরং সক্কাল সক্কাল এসে গীতিকারের বেড়া বেঁধে দিয়ে গেছেন। এমনধারা না হলেই আমরা আশ্চর্য হতাম। আমাদের দেবদেবীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা বরাবরই এই রকম— রাগ দুঃখ অভিমান খুনসুটি আর, সেই সব মিলিয়েই, ভালবাসা, যার সঙ্গে মিশে থাকে আমাদের ভক্তি, এমন ভাবে মিশে থাকে যে কোনও পরমহংসের সাধ্য নেই, সে-ভক্তিকে ওই নিতান্ত মানবিক ভালবাসা থেকে আলাদা করতে পারে। তা হলে আমাদের কাত্তিক ঠাকুর সেলুনে বসে চুলে কলপ লাগাতে চাইলে খামকা তাঁর অপমান হতে যাবে কেন? জাগ্রত হিন্দুদের ব্যাপারটা একটু বোঝালে হয় না?

লাভ নেই। ওঁরা এ জিনিস বুঝবেন না। ভক্তি আর ভালবাসার এই রসায়ন ওঁদের ধাতে নেই। ধর্ম জিনিসটা ওঁদের কাছে কেবল শাসনের অস্ত্র। অভিভাবকের শাসন নয়, সে হল চৌকিদারের শাসন, সেখানে পান থেকে চুন খসলে দেবদেবীরা মুন্ডু কেটে নেন, তাঁদের সঙ্গে কোনও রঙ্গরসিকতা চলে না। ওই দেবতাদের কোনও কৌতুকবোধ নেই। থাকার কোনও কারণও নেই। কেবল হিন্দু জাগরণ মঞ্চ নয়, কেবল বজরং দল নয়, মহান সংঘ পরিবারের বিবিধ সংগঠনের নেতা বা কর্মীদের কথায় ও কাজে আর যা-ই থাকুক, কৌতুকবোধের চিহ্নমাত্র নেই, রসিকতা শুনলেই তাঁদের সর্বাঙ্গ যেন শক্ত হয়ে ওঠে। তাঁদের দেবতারাও, স্বভাবতই, তাঁদের মতো— সদাই মরে ত্রাসে, ওই বুঝি কেউ হাসে। তাই বলছিলাম, আমাদের কাত্তিক ঠাকুর হ্যাংলা কিংবা এ-বার কালী তোমায় খাব-র মর্ম ওঁরা বুঝবেন না।

বুঝতে চাইবেনও না। না-চাওয়াটাই ওঁদের পক্ষে যুক্তিসংগত। ওঁদের রাজনীতি সেই যুক্তির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতার রাজনীতি। যে সর্বগ্রাসী ক্ষমতা দেশ জুড়ে তার নিশ্ছিদ্র সাম্রাজ্য কায়েম করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, কৌতুক তার মহাশত্রু। নতুন কিছু নয় সেটা। একাধিপত্যের দাবিদাররা চিরকাল রঙ্গব্যঙ্গকে ভয় পেয়ে এসেছে। তারা জানে, কৌতুক স্বভাবত বেয়াড়া, বড়-ছোট মানে না, ক্ষমতার আস্ফালন দেখলেই তার চিত্ত চুলবুল করে ওঠে, সে ওই আস্ফালনে পিন ফুটিয়ে দেয়, চোরাগোপ্তা আক্রমণে তাকে বেসামাল করে ফেলে, ক্ষমতার অধীশ্বর তখন হাসির পাত্র হয়ে যায়— চ্যাপলিন স্মরণীয়— আর যাকে দেখে লোকে এক বার হেসে ফেলে, তাকে আর আগের মতো ভয় পায় না। ভয়ের রাজত্ব কায়েম করাই যাদের লক্ষ্য, রসিকতাকে তারা তো ভয় পাবেই। তালিবানরা যে তাদের রাজত্বে কৌতুককে সূচ্যগ্র ভূমিও ছাড়েনি, সেটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।

নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে কৌতুকের বিচরণভূমি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। সংঘ পরিবারের বাহিনীগুলি এ ব্যাপারে দারুণ সফল। তাঁরা জানেন, ভয়ের শাসন এক বার কায়েম করতে পারলে সেই ভয় নিজেই সব কৌতুক, সব ব্যঙ্গ, সব প্রতিবাদ, সব প্রশ্ন বন্ধ করে দেবে, তাঁদের আর পরিশ্রম করতে হবে না। এখন অনুশাসন পর্ব। সেটা জানেন বলেই তাঁরা এখন দারুণ তৎপর, বেয়াদপির খোঁজ পেলেই ‘হা রে রে রে’ বলে সহবত শিক্ষা দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। জাভেদ হাবিব ঠেকে শিখেছেন। অনুমান করা যায়, আরও অনেকেই দেখে শিখলেন— মা-দুর্গা আর তাঁর ছেলেপুলেদের নিয়ে রঙ্গরসিকতার কথা আর ভুলেও ভাববেন না।

নিউ ইন্ডিয়া এল বলে।

নিউ ইন্ডিয়া New India জাভেদ হাবিব Jawed Habib Salon
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy