Advertisement
E-Paper

সরকার যদি নিজের কাজটা...

আহারে, বাচ্চাগুলো কী খাবে?’ না, যে শিশুদের জন্য বিধবা যশোদার দুশ্চিন্তা, তারা সে অর্থে ওঁর কেউ নয়। ওরা বিজয়ের ছেলেমেয়ে। অকালবৈধব্যের পাশাপাশি দুই সন্তানের কর্মসূত্রে গ্রামের বাইরে চলে যাওয়া— নিজের পক্ষে চাষ করে ওঠা হয় না।

শুভ্রা দাস

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০

আহারে, বাচ্চাগুলো কী খাবে?’ না, যে শিশুদের জন্য বিধবা যশোদার দুশ্চিন্তা, তারা সে অর্থে ওঁর কেউ নয়। ওরা বিজয়ের ছেলেমেয়ে। অকালবৈধব্যের পাশাপাশি দুই সন্তানের কর্মসূত্রে গ্রামের বাইরে চলে যাওয়া— নিজের পক্ষে চাষ করে ওঠা হয় না। বিজয়কে ভাগে দিয়েছেন। বিজয় ছিলেন তাঁদের সারা বছরের মজুর। খেতমজুর থেকে ভাগচাষিতে উত্তীর্ণ, কিন্তু অনটন পিছু ছাড়েনি। ছাড়বেই বা কী করে? ছোট চাষি, ভাগচাষিদের কপালটাই যে খারাপ, কখনও উৎপাদনের অনিশ্চয়তা তো কখনও বাজারের ব্যাজার মুখ। এই যেমন এ বছর, প্রকৃতি সদয়, আলুর ফলন আশা ছাড়িয়েছে। কিন্তু, দাম নেই। জ্যোতি এখন ১৭০ টাকা বস্তা, মানে ৩৪০ টাকা কুইন্টাল।

ধনিয়াখালির এ তল্লাটে ভাগের নিয়ম হল, মালিক দেবে বীজ, সার, কীটনাশকের খরচের অর্ধেক, চাষের সবটুকু শ্রম, সেচের খরচ, ইত্যাদি ভাগচাষির। এক গাঁয়ের, এবং চাষিবাড়ির মেয়ে হওয়ার সুবাদে বিজয়ের কাছ থেকে চাষের খুঁটিনাটি হিসেব নিতে অসুবিধে হল না। ভাগের হিসেবে বিজয়ের যে আলু পাওয়ার কথা, তা বর্তমান বাজার দরেই তাঁকে বিক্রি করতে হবে, কোল্ড স্টোরেজে রাখার সংগতি নেই। কিন্তু এই দরে বিক্রি করলে বিজয়ের লোকসান হয়, ৬৫৩১ টাকা। যেহেতু তিনি নিজেই খেটেছেন, মজুরির খরচটা বাদ দিয়েই হিসেব করতে হবে, তাতে তিন মাস খেটে তাঁর বাঁচে ৪০৭ টাকা। অর্থাৎ, তাঁর দৈনিক মেহন্নতানা দাঁড়াল চার টাকা বাহান্ন পয়সা! আর জমির মালিক কিছু না করেও পাচ্ছেন ১৯০৮ টাকা। মন্দার বাজারেও।

চার ছেলেমেয়ে, অসুস্থ মা ও স্ত্রীকে নিয়ে বিজয়ের পরিবার। স্বামী স্ত্রী দুজনে খেটেও নুন পান্তা কিছুই ঠিক মতো জোটে না। আমন ধানেও লাভের মুখ দেখা হয়নি, ধানের দাম কম থাকায়। সরকার ঘোষণাপটু, কিন্তু ন্যায্য মূল্যে ধান কেনার ঘোষণা কখন যে ফড়ে-পাইকার-দালালদের গাড়ি চেপে গুদামে চলে যায়, তা বোধ হয় সে টেরও পেতে চায় না। বিজয়কে বাজারে সার-বীজের দোকানিদের কাছে ধার ছাড়াও মহাজনের কাছে চড়া সুদে টাকা নিতে হয়েছে। অতএব, দাম যা-ই হোক, ফসল বিক্রি না করে তাঁর উপায় আছে? ধান থেকে যদি কিছু লাভের মুখ দেখতেন, কিছু আলু হিমঘরে রেখে পরে বিক্রির কথা চিন্তা করতে পারতেন।

তো, ভাগের আলুটা যশোদা ছেড়ে দিলেন, খরচের যেটুকু দিয়েছেন সেইটুকু বাদ দিয়ে। সব জমি-মালিকের এতটা বিচলিত হলে চলে না। তাঁর খরচ কম, ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী, অন্যেরা তো তা নয়। আচ্ছা, তিনিও তো না ছাড়লে পারতেন। বিজয় তাঁর কে হয়? সে তো মজুরই বটে, আবার স্বজাতিও নয়, আদিবাসী। আসলে, গ্রামসমাজের গতি অত সরল নয়, টাকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটাই আবার সব কিছু নয়, তার বাইরেও টিকে আছে বিচিত্রমনা মানুষ। এমন তার চলন, এই মুহূর্তে যে মজুর মালিকের মা-বোনকে কল্পনা করে গালি পাড়ছিল, সে-ই আবার আপৎকালে সেই মালিকের জন্য রাতবিরেতে হাজির থাকে। আবার, যে মালিক মজুর সব খেয়ে গেল বলে নিশিদিন কাঁদুনি গায়, সেও, তার ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের জন্য মরাই থেকে বার করে দেয় এক ঝুড়ি দু-ঝুড়ি ধান।

শোষণ নেই তা নয়, মজুরের শ্রম ছাড়া মালিকের অস্তিত্ব বিপন্ন, কিন্তু তারই মাঝে কোথাও যেন একটা দয়াধর্মের ধারাও থেকে যায়, যা আসে গ্রাম-পাড়া-প্রতিবেশ থেকে। যে লোকটার সঙ্গে গ্রামে বাক্যালাপ বন্ধ করেছিলাম, সেই লোকের সঙ্গে হঠাৎ কলকাতায় দেখা হতে কী আনন্দ, সহপাঠিনীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম ‘আমার কাকা’ বলে। এই যে বিজয়, তিনি তো মজুর, কিন্তু মহিলার ছেলেমেয়েদের কাছে তিনিই মামা। হয়তো পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ কৃষিসম্পর্কের কারণে, মজুর-মালিক শ্রেণিবিভাজনটার মধ্যেও নানা স্তর, বিভিন্ন সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার টানেই যশোদা একা ঘর আগলে পড়ে থাকেন গ্রামে। বিজয়ের বাচ্চাদের চিন্তায় কাতর হওয়াটা, তাই, শুধু আর্থিক সংগতির ব্যাপার নয়, সমাজের নানা শুভ-অশুভ, বর্ণময়তা-বিবর্ণতার মধ্য দিয়ে মনের ব্যাপার।

এই হৃদয়বত্তার ছিটেফোঁটাও যদি সরকারের কার্যকলাপে প্রতিফলিত হত, তা হলে বিজয়কে চড়া সুদে ধার নিতে হত না, অবিশ্বাস্য কম দামে ফসল বিক্রি করতে হত না। সেরা আলুটা তিন-সাড়ে তিন টাকা দরে পাইকারকে দিতে হচ্ছে, কলকাতার মুকুন্দপুর বাজারে যার দাম দশ টাকা— মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে কোন মন্ত্রবলে যে প্রতি কিলোতে সাড়ে ছ’টাকা যোগ হয়ে যায়! সরকার বলেছে সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে আলু কিনে নেবে। ঠিক এমন প্রতিশ্রুতিই তো শোনা গিয়েছিল ধানের বেলায়, শীতের বাগাড়ম্বর বাসন্তী হাওয়ায় বিলীন। কেনাবেচা করা সরকারের কাজ নয়, বরং সরকার যদি নিজের কাজটা ঠিক মতো করত, চাষিকে সারাক্ষণ হায় হায় করতে হত না। স্বল্পসুদে ঋণ, কৃষি-উপকরণ, সেচের ব্যবস্থা হলেই চাষিকে ফসল তোলামাত্রই বিক্রি করতে হত না। গ্রামজীবনের কুৎসিত-স্বার্থসর্বস্ব দিকটাই সরকারকে অনুপ্রাণিত করে, তার মানবিক রূপটা অগোচরে, অবহেলায় নিজের মতো বাঁচবার চেষ্টা চালিয়ে যায়।

প্রতীচী ইন্সটিটিউটে কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত

Government Poor Kind
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy