Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
জনপ্রতিনিধিরা সংযত না হলে উচিত জবাব ঠিকই পেয়ে যাবেন

তবু আস্থা রাখি গণতন্ত্রে

সাংসদেরা সেন্ট্রাল হলে এসে কফি টোস্ট খেলেন, বারোটার সময় আর একবার চেষ্টা হল, তুমুল হট্টগোলের ফলে স্পিকার পরের দিন পর্যন্ত অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করলেন।

কৃষ্ণা বসু
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০০:২৩
Share: Save:

মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, মহাপুরুষেরা এ কথা বলে গিয়েছেন। গণতন্ত্রে আস্থা হারানোকে কি পাপ বলা যাবে? একটা যোগ অবশ্য আছে। অধিকাংশ মানুষের মতের প্রতিফলনে দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা, সেটাই তো গণতন্ত্রের উৎস। গণতন্ত্রে আস্থা হারালে দাঁড়াব কোথায়? বিকল্পগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক, যথা একনায়কতন্ত্র, বা মিলিটারি-রাজ। এই সব চিন্তা মনকে পীড়িত করছিল, তার অন্যতম কারণ, দিল্লিতে বসে বাজেট অধিবেশনের শেষ দিকের কার্যকলাপ দেখছিলাম। প্রতিদিন এগারোটায় অধিবেশন শুরু হতেই চিৎকার চেঁচামিচি, সাময়িক মুলতুবি। সাংসদেরা সেন্ট্রাল হলে এসে কফি টোস্ট খেলেন, বারোটার সময় আর একবার চেষ্টা হল, তুমুল হট্টগোলের ফলে স্পিকার পরের দিন পর্যন্ত অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করলেন। একই দৃশ্যের অবতারণা প্রত্যেক দিন দেশবাসী লোকসভা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখেছেন।

সেন্ট্রাল হলে বসে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছিল। প্রাক্তন সাংসদ (বাংলাদেশে সুন্দর শব্দ ব্যবহার করা হয়, সাবেক সাংসদ) হিসাবে অধিবেশন কক্ষে হট্টগোল আমরাও দেখেছি, তবে এমন দিনের পর দিন কর্মহীন অচল সংসদ দেখিনি। স্পিকার সাংমা তাঁর সিংহাসনে বসে বই পড়তেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘দিদি, আমি বই পড়ি, বিরোধীরা ওয়েলে নেমে যতই বিক্ষোভ দেখাক আমি হাউস কিছুতেই মুলতুবি করব না, গলা শুকিয়ে ক্লান্ত হয়ে আপনিই থেমে যাবে।’ সাংমা পোড়-খাওয়া রাজনীতিক। স্পিকার বালযোগী ছিলেন নবাগত আর ভালমানুষ। প্রথম দিকে গন্ডগোল হলে মাথা নেড়ে বলতেন, ‘নট গুড, নট গুড’। ওঁকে শেখানো হল, বলবেন, ‘নাথিং উইল গো অন রেকর্ড’। পরে তিনি ওই বাক্যটি বলতেন। মনোহর জোশী মোটের উপর কঠোর হাতে পরিচালনা করতেন। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে কাছে থেকে স্পিকার হিসাবে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি, তত দিনে আমি ‘সাবেক’ হয়ে গিয়েছি। দূর থেকে দেখেছি সভা পণ্ড হয়ে গেলে তাঁর হতাশা। ভেবেছিলেন লোকসভা টেলিভিশন চালু হলে সদস্যরা সংযত হবেন। ফল হয়েছে বিপরীত— কত রকম নতুন ধরনের বিক্ষোভ দেখানো যায় তার প্রতিযোগিতা। স্পিকার চেয়ারের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে নিজের দলের কাছে পরে বহু মূল্য দিতে হল। এর পর মহিলাদের যুগ। মীরা কুমার, সুমিত্রা মহাজন আমার সহসাংসদ ছিলেন। তাঁদের এই দায়িত্বশীল পদে দেখে আনন্দিত হয়েছি। দুঃখ এই, সংসদ পণ্ড হওয়ার ছবি পালটায়নি।

গণতন্ত্রে বিরোধী দল অত্যন্ত আবশ্যক। তাদের কাজ শাসকদলের ভুলত্রুটি তুলে ধরা। অধিবেশন কক্ষে জোরালো ভাষায় সে-কাজ করা সম্ভব। অভিযোগ অসত্য হলে শাসকদল তা খণ্ডন করবেন, সত্য হলে শুধরে নেবেন। বিরোধী পক্ষের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, এমন ধারণা যেন কিছুতেই না হয়। অতীতে দেশে কোনও গুরুতর ঘটনা ঘটলে সরকারপক্ষ নিজে থেকেই পার্লামেন্টে প্রতিবেদন রাখতেন, নেহরু থেকে বাজপেয়ী আমল, সে রকমই দেখা যেত। মনমোহন সিংহ স্বভাবত স্বল্পভাষী। তাঁর নির্বাক থাকা নিয়ে পরিহাস প্রচলিত হয়েছিল। বলা হত, আপনার মোবাইলটি মনমোহন মোডে রাখুন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিন্তু জোরালো ভাষায় নিজের মতাদি বলে থাকেন। দেশের সাধারণ নাগরিকের মোবাইলে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা দিনে একাধিকবার ভেসে আসে। গুরুতর ঘটনার পর তিনি যখন বাক্যহারা হয়ে যান তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয়।

শুধুমাত্র সংসদ অচল হওয়ার কারণে গণতন্ত্রের মানুষ আস্থা হারাবেন এমন নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে জনআলোচনায় গণতন্ত্রে ব্যর্থতা বা দুর্বলতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে পড়েছে। অধিকাংশের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যদি মনে করেন তাঁদের মত দেশের সকল মানুষের ওপর চাপিয়ে দেবেন তখন তাকে বলা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, যা কিনা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী। যখনই কোনও দল বিপুল জনমত নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তাদের মধ্যে এই প্রবৃত্তি চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম যুগে এই মনোভাব ছিল। সম্প্রতি এর উদাহরণ আমরা দেখেছি শাসকদল বিজেপির কার্যকলাপে। তারা যেন ঊর্ধ্বশ্বাসে নিজেদের মতবাদে সারা দেশকে বেঁধে ফেলতে চাইছে। অপর দিকে মানুষ যখন মতদান করেন তখন যে সর্বদা যথাযথ বিবেচনাবোধ কাজ করে, এমন নয়। কখনও তাঁরা নির্বাচনী প্রচারে বিভ্রান্ত হন, কখনও বা যে শাসকদলের অধীনে আছেন, তাদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে অপর কোনও দলকে রাজ্যপাটে বসান। মানুষের এই আশা ও আশাভঙ্গের কথা খলিল জিব্রান তাঁর এক কবিতায় সুন্দর করে বলেছিলেন। তার মর্মার্থ: ‘দুর্ভাগা সেই জাতি যে নতুন শাসককে জয়ধ্বনি দিয়ে অভ্যর্থনা করে, তার পর বিদায় দেয় ধিক্কারে, আবার অপর এক জনকে জয়ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানাবে বলে।’

গণতন্ত্রের উপর এক নতুম উপদ্রব শুরু হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কোনও দেশের নির্বাচন প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা হয়েছে। এত রকম নানা দিক থেকে ঘাতপ্রতিঘাতের ফলে মানুষের মনে গণতন্ত্রের উপর আস্থা টলে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।

কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এখনও পর্যন্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মানুষের পক্ষে একমাত্র মঙ্গলজনক উপায়। আমাদের সামনে অন্য কোনও পন্থা নেই। আমরা বলে থাকি ভোটারের চরিত্র বোঝা মুশকিল, দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ। কিন্তু ভোটারের এই চরিত্রই গণতন্ত্রের ভরসাস্থল। তাঁরা ঠিকই বুঝতে পারেন হয়তো ভুল হয়েছে, ঠিক লোককে ক্ষমতায় বসানো হয়নি। তাঁরা জানেন গণতন্ত্র তাঁদের হাতে পালটে দেওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছে, সুযোগ পাওয়ামাত্রই তাঁরা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। খলিল জিব্রান তাঁর কবিতায় মানুষের যে দোলাচল মনোভাবের কথা বলেছেন, শেষ পর্যন্ত সেটাই গণতন্ত্রের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখে। জনগণ যেন দর্পহারী মধুসূদন।

আজ ত্রিপুরা জয়ে উচ্ছ্বাস ও অহংকার, কাল উত্তরপ্রদেশে ধাক্কা, দপর্চূণ। এটি সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। সব দলের ক্ষেত্রেই এই লীলা প্রযোজ্য। দিনের পর দিন সংসদ অচল করার খেলাও জনগণ ঠিকই নজরে রাখছেন। বড় ছোট সকল দল এই খেলায় লিপ্ত। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, ওয়েলে নেমে গোলমাল করে সভা পণ্ড করা নাকি গট-আপ! শাসকদলের কাছে দেশের গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার এক উপায়। অভিযোগের সত্যাসত্য নির্ণয় সম্ভব নয়, কিন্তু রাজনীতিতে মানুষের মনে কোনও ধারণা, ইংরেজিতে যাকে বলে পারসেপশন, বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। সকল দল এই সভা অচল খেলায় যুক্ত হলে জনগণ কী ভাবে জবাব দেবে! তবুও বলব জনপ্রতিনিধিরা যদি সংযত না হন, উচিত জবাব ঠিকই পেয়ে যাবেন। মন্ত্র জপার মতো মনে-মনে বলি, গণতন্ত্রে আস্থা হারাব না, কারণ সেটা হবে এক অর্থে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো।

ভূতপূর্ব লোকসভা সদস্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Parliament mass representatives Turmoil
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE