Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
‘ব্রিদ ইন ইন্ডিয়া’ না হলে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ হতে পারে না

শ্বাসপ্রশ্বাসের অধিকার

ইউরোপে দূষণের বিরুদ্ধে জনমত অনেক দিনই প্রবল। কোপেনহাগেনের ভোটে দেখেছি গ্রিন পার্টি দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় এক নির্ধারক তৃতীয় শক্তি ছিল।

আপ্রাণ: গভীর ধোঁয়াশার মধ্যে পার্কে দাঁড়িয়ে শরীরচর্চা করছেন কয়েক জন নাগরিক। দিল্লি, ৮ নভেম্বর, ২০১৭। ছবি: পিটিআই

আপ্রাণ: গভীর ধোঁয়াশার মধ্যে পার্কে দাঁড়িয়ে শরীরচর্চা করছেন কয়েক জন নাগরিক। দিল্লি, ৮ নভেম্বর, ২০১৭। ছবি: পিটিআই

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০৪
Share: Save:

কয়েক বছর আগে ভোটের সময় কোপেনহাগেনে ছিলাম। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নির্বাচনী কর্মসূচিতে পরিবেশের প্রশ্ন প্রবল ভাবে হাজির। দূষণ কেন বাড়ছে— জবাব চাই, জবাব দাও। ডেনমার্কের রাজধানী শহরের জনসংখ্যা ৫৭ লক্ষ। গাড়ির ধোঁয়ার প্রশ্নই নেই। এবং গাড়িঘোড়া তুলনায় কম। সাইকেল গুরুত্বপূর্ণ বাহন। বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখেছিলাম, ভদ্রমহিলা অফিসে এলেন সাইকেল চেপে। এই দেশে দূষণ কোথায়?

ইউরোপে দূষণের বিরুদ্ধে জনমত অনেক দিনই প্রবল। কোপেনহাগেনের ভোটে দেখেছি গ্রিন পার্টি দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় এক নির্ধারক তৃতীয় শক্তি ছিল। গ্রিন পার্টির প্রাসঙ্গিকতা অবশ্য এখন আগের চেয়ে কমেছে। কিন্তু তার কারণ হল, মূলস্রোতের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই দূষণকে এক প্রধান আলোচ্য বিষয় করেছে।

আর আমার দেশ? রাজধানী দিল্লিতে একটি নবজাতকও যে দূষণকে অনৈচ্ছিক ভাবে নিজের শরীরে গ্রহণ করছে তা দৈনিক ৪৫টি সিগারেট খাওয়ার সমান। রাজধানীর ‘স্মগ’ নিয়ে তো এখন দুনিয়া জুড়ে জোর আলোচনা। রাজধানী বলে কথা।

২০১৩ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছিল, এ পৃথিবীতে সবচেয়ে দূষিত শহর হল দিল্লি। ২০১৬ সালে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ কমিটির প্রধান ভুরে লাল তাঁর রিপোর্টে বলেছিলেন, শিল্পবিপ্লবের সময় যে গ্রেট লন্ডন স্মগ হয়েছিল, দিল্লিতে ধোঁয়াশা তার চেয়েও অনেক বেশি। ১৯৯৮ সালে সরকারের সঙ্গে এম সি মেটা-র মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে, তার পর কখনও হাই কোর্ট কখনও সুপ্রিম কোর্ট, কখনও ভুরে লাল কমিটি, কখনও জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনাল— কত নির্দেশ, গবেষণা, লেখালিখি। কিন্তু ২০১৭’র নভেম্বরেও দেখছি, ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলই পরিবেশ দূষণকে অগ্রাধিকার দিতে প্রস্তুতই নয়।

অরুণ জেটলি দিল্লির লোদি গার্ডেনে নিয়মিত হাঁটতেন। বছর দুয়েক আগে চিকিৎসকরাই তাঁকে পরামর্শ দেন সকালে ওখানে না হাঁটতে। সকালে নাকি স্মগ ভয়াবহ। কিছুদিন আগে ওঁর গাড়িতে বসতেই অরুণ দেখালেন, সরকারি গাড়িতেও উনি নিজেই বায়ু শুদ্ধ করার যন্ত্র বসিয়েছেন। আধুনিক অভিজাত অরুণ জেটলি নিজে সচেতন। কিন্তু তাঁর দল ভীষণ ব্যস্ত অন্য নানা কাজে— বল্লভভাই পটেলের বিশাল লৌহমূর্তি স্থাপনার, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ, কীভাবে গোমাংস ভক্ষণ এ দেশে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা সম্ভব তার প্রচেষ্টা। এমনকী যে গঙ্গাকে হিন্দুত্বের সঙ্গে যুক্ত করে বিজেপি, সেই গঙ্গার দূষণ রোধের চিত্রটিও কিন্তু উৎসাহব্যঞ্জক নয়। গঙ্গায় বর্জ্য পরিস্রুতির ব্যবস্থা তৈরির জন্য বরাদ্দ ২০ হাজার কোটি টাকা, তিন বছরে খরচ হয়েছে ২০০০ কোটি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। দেরির কারণ নাকি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা রক্ষা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া মান মেনে কার্যত আমরা কেউই শ্বাস নিতে পারি না। বছরে গড়ে ১৮ লক্ষ ভারতীয় মারা যান বায়ুদূষণে। (দ্য ল্যানসেট ২০১৫) চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা বলছে, দিল্লির ৪৪ লক্ষ শিশু ফুসফুসের রোগে মারা যায়। শুধু তো দিল্লির ব্যাপার নয়। ভারতের মানুষ কোথাও আর্সেনিক, কোথাও ট্যানারির জন্য, কোথাও শিল্পক্ষেত্রের বর্জ্য পদার্থের প্রভাবে আক্রান্ত। সন্ত্রাসে যত মানুষ মারা যান, তার চেয়ে বেশি ভারতবাসী মারা যাচ্ছেন দূষণে। নরেন্দ্র মোদী স্বচ্ছ ভারতের স্লোগান তুলছেন। খুব ভাল কথা। কিন্তু স্বচ্ছ ভারত মানে শুধু ঝাড়ু দিয়ে রাস্তাকে আবর্জনামুক্ত করা আর টয়লেট নির্মাণ নয়।

বলছি না, টয়লেটের প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে দূষণমুক্ত ভারত গঠনের জন্য ঐকমত্য রচনার কোনও চেষ্টা দেখি না। হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনের চেয়ে দূষণমুক্ত ভারত গঠন কি বেশি জরুরি নয়? কংগ্রেস না হয় সত্তর বছর ধরে ভারতকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ সর্বক্ষণ এ কথা বলেই চলেছেন। তা, তিন বছরে মোদী কি বিকল্প ন্যারেটিভ দিতে পেরেছেন, যাতে আমরাও কোপেনহাগেনের মতো ভোটের প্রধান বিষয়বস্তু করব পরিবেশকে? তার বদলে কী দেখছি? তাজমহলটাকে রাখারই কোনও প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তাজমহলের মাটির নীচে শিবের মন্দির রয়েছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু তাজমহলের যে দীর্ঘদিনের মার্বেল ক্যানসার সেটি সারানোর জন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে কী? আগরার ট্যানারির ভয়াবহ রাসায়নিক প্রভাব নিয়ে কেউ কোনও বিতর্ক সৃষ্টি করছে? আমাদের দেশে নাগরিক সমাজও কি দূষণ নিয়ে আন্দোলিত?

লালুপ্রসাদ এক বার বলেছিলেন, যব তক সামোসা মে আলু, তব তক বিহার মে লালু। আসলে আলুর মানে ছিল দারিদ্র। শুধু লালু নন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই বড় উপভোক্তা হল দরিদ্র মানুষ। নরনারায়ণের ভোটই হল রাজনীতির মুক্তি মন্ত্র। দরিদ্র মানুষ যদি সামাজিক ভাবে অসচেতন হয়, তবেই মঙ্গল। যদি নিম্নবর্গকে অমর্ত্য সেনের মতো মানুষের উপদেশ মেনে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষাদান করা হয়, তবে কিন্তু বিপদ ঘোরতর। শিক্ষা দেবে চেতনা, চেতনা দেবে বিপ্লব। তখন ভোটার অভিযোগে র তর্জনী তুলে বলবে, রাম-রহিমের বিভাজনের নেশায় ছিলাম, অবান্তর বিষয়ের কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে এখন চাই মুক্ত বায়ু, চাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য আর অধিকার। তোমার জন্য দেওয়াল লিখে উঞ্ছবৃত্তির এই জীবিকা চাই না আমার!

শুধু ভারত নয়, পরিবেশের বিপদ বিশ্বচরাচরে। ভয়ংকর এক ঋতু-বিপর্যয় দেখছি আমরা। শীতকালে গরম, গ্রীষ্মে অকাল বর্ষণ। স্টিফেন হকিং বলছেন, এই গ্রহটাই এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের অসুখে আক্রান্ত। ভবিষ্যতে থাকার জন্য অন্য আর এক গ্রহ খুঁজে বের করতে হবে। হকিং তাঁর স্টাইলে বিপদবার্তা দিয়েছেন। পৃথিবী নড়েচড়ে বসেছে। পৃথিবীর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি ‘ক্লাইমেট’ নিয়ে ভাবিত। ভারতের উপর সেই বিশ্বায়নের চাপও ক্রমবর্ধমান। অতীতে মনমোহন সিংহ এখন নরেন্দ্র মোদী অর্থাৎ ভারত সরকার যে পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে সক্রিয় নয়, এমন নয়। কিন্তু আরও অনেক দূরে যাওয়া দরকার। আরও অনেক দ্রুত।

আমার তো মনে হয়, দূষণ বিষয়ে সচেতন হতে দেরি করলে সেটা পরিচ্ছন্ন শক্তি সমৃদ্ধ ভারত গঠনে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথে বিরাট বাধা হবে। তাই সন্ত্রাসদমনে জিরো টলারেন্সের মতো পরিবেশের প্রয়োজনেও চাই নাগরিকদের চরম অসহিষ্ণুতা।

রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ব্যস্ত ধর্মীয় মেরুকরণে, আমিষ-নিরামিষে, পটেলের মূর্তি থেকে সিলেবাস পরিবর্তনে। দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে প্রকল্প ঘোষণায়। রাস্তার নাম বদল ইত্যাদি ইত্যাদিতে। নাগরিক সমাজও এ দেশে তপ্ত সেই সব বিতর্ক নিয়ে। রাজা আলোচ্যসূচি ঠিক করে দিয়েছেন। জিএসটি-বিমুদ্রাকরণ, ডোকলাম থেকে ৩৭০ ধারা। কিন্তু ‘ব্রিদ ইন ইন্ডিয়া’ না হলে যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ হতে পারে না, সে কথা বলার কেউ নেই। হঠাৎ ভয়াবহ ‘স্মগ’-এ রাজধানীতে যখন আঁধার নেমে এল, তখন রাজনীতির বিতর্ক শুরু হল, দায়ী কে? মোদী না কেজরীবাল? কেন্দ্র না রাজ্য? আর নাগরিক সমাজ? সে-ও এই তরজায় মাতল! মেতে থাকল!

সময় এসেছে নাগরিক সমাজের ঘুম ভাঙার। এক জন সুনীতা নারায়ণ বা এক জন সুভাষ দত্ত নন, দায়িত্ব আমাদের সকলেরই। এই দেশকে, এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে বাধ্য করতে হবে নির্বাচনী ইস্তাহার বদলাতে।

আমরা পারব না, এটা মানতে ইচ্ছে করছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Make in India Pollution Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE