গ্রানিত জ়াকা
১ জুন, ২০০২। জাপানের সাপোরো শহর। যা হওয়ার ছিল, হল তা-ই। জার্মান বাহিনীর কাছে ৮-০ গোলে চূর্ণ হল সৌদি আরব। তবে এই হারকে তত ‘লজ্জাকর’ বলবেন না কেউ। এ-ই তো ভবিতব্য। ১৬ বছর পর রাশিয়া বিশ্বকাপের পরে বলাই যায়, আজ আর ভবিতব্য এমন নয়। আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া ০-৩, জার্মানি-মেক্সিকো ০-১, পর্তুগাল-ইরান ১-১— পরিসংখ্যানই বলছে গড়ে উঠছে নয়া ফুটবল-সংস্কৃতি। স্কিল আর ঐতিহ্যের মিশেলে যে আভিজাত্য, তা কি তবে ধসে পড়ছে?
তর্কটা ত্রিস্তরীয়। প্রথম স্তরটি একমুখী। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে নতুন জীবনের খোঁজে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। সেই ঢল এখন এতই বেশি যে জার্মানি, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ডের মতো ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে অভিবাসী মানুষের সংখ্যা শতাংশের হিসেবে ১০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। নতুন দেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া চিরদিনই খুব কঠিন। গরিব দেশ থেকে গেলে কাঠিন্য আরও কিছু বেশি। ফলে সমাজের ‘নিচু’ থেকে ‘উঁচু’ তলায় উত্তীর্ণ হতে গেলে কিছু আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। যেমন, শিক্ষা। কিংবা সমাজসেবা। তবে এ জাতীয় সুযোগ নেই সকলের। অগত্যা ফুটবল।
রোমেলু লুকাকু। বেলজিয়ামের সাবেক উপনিবেশ কঙ্গো থেকে প্রভু-দেশে অভিবাসী হয়েছিলেন তাঁর বাবা রজার লুকাকু। রোমেলুর জন্ম অ্যান্টওয়ার্প-এ। মা দুধে জল মিশিয়ে খাওয়াতেন রোমেলুকে। সেই দারিদ্র কাটিয়ে আজ বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের তারকা খেলোয়াড় তিনি।
কিলিয়ান এমবাপে। বাবা সাবেক ফ্রান্স-অধিকৃত ক্যামেরুনের মানুষ, মা সাবেক ফ্রান্স-অধিকৃত আলজিরিয়ার। প্রভু-দেশে জন্ম কিলিয়ানের। আজ প্রভু-দেশের নয়নের মণি। দলে দলে মানুষ ‘লা মার্সেইয়েজ়’ গাইছেন ক্যামেরুন-আলজিরিয়ার বংশোদ্ভূত বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ নবীন খেলোয়াড়-এর জন্য। অসাধ্যসাধনের নাম ফুটবল।
দ্বিতীয় স্তরটি দ্বিমুখী। প্রভুরাও অনেক সময় পদানত হন ‘ছোট’ দেশের কাছে। ফুটবলে। বোয়েতাং ভাইদের গল্পটা পরিচিত। শরণার্থী হয়ে ঘানা থেকে জার্মানিতে চলে এসেছিল কেভিন আর জেরোম বোয়েতাং-এর আগের প্রজন্ম। জার্মানিতে কেভিন খেলতেন অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে। তার পর অনূর্ধ্ব-২১ দলের জার্সি গায়ে জার্মানিকে ইউরো কাপ চ্যাম্পিয়নও করেন। সে সময় তাঁর সতীর্থ ছিলেন মেসুট ওজ়িল, মানুয়েল নয়ার, সামি খেদিরা, মাট্স হুমেল্স। জার্মান ফুটবলের সোনার সময়। কিন্তু শিবির চলাকালীন নাইট ক্লাবে যাওয়ায় সাসপেন্ড করা হয় কেভিনকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘানা ফিরে গিয়ে সে-দেশের জাতীয় দলে যোগ দেন তিনি। জেরোম থেকে যান জার্মানিতেই। ২০১৪ ব্রাজ়িল বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ে মুখোমুখি হয় দু’ভাইয়ের দেশ: জার্মানি আর ঘানা। চমকের নাম ফুটবল।
স্ট্রাইকার সামান ঘোদ্দোস-এর বাবা-মা ইরান থেকে অভিবাসন করেছিলেন সুইডেনে। ২০১৭-য় তিনি সুইডিশ দলে যোগ দেওয়ার পর খবর পৌঁছয় তেহরানে। ‘স্বদেশ’ থেকে ডাক পড়ে ঘোদ্দোসের। সাড়া দেন তিনি। রাশিয়ায় বিশ্বকাপের মঞ্চে পা রাখেন ইরানের জার্সি গায়ে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারে অভিযোগ করেছিলেন, “মেক্সিকো যখন লোক পাঠায়, সেরাদের পাঠায় না।... ওরাই মাদক আনছে। ওরাই অপরাধ আনছে। ওরা ধর্ষণকারী।” এই উদ্ধত মিথ্যার প্রতিবাদ ওমর গঞ্জালেজ়, মেক্সিকোর সেরা ক্লাব পাচুকার ডিফেন্ডার। বাবা-মা সুন্দর জীবনের খোঁজে মেক্সিকো ছেড়ে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকোয় ফিরেছেন সুন্দর ফুটবলের খোঁজে। মার্কিন জাতীয় দলে খেললেও গঞ্জালেজ় জানেন মেক্সিকোতেই তাঁর ফুটবল-ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
তৃতীয় স্তরটি বহুমুখী। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে ‘স্বপ্নের’ দেশে পৌঁছনো, তার পর আর এক অভিবাসীর কাছে প্রশিক্ষণ। উদাহরণ নাইজিরিয়ার মেয়ে পারপেচুয়া এনকওচা। নিবাস উত্তর সুইডেনের স্কেলেফটি শহর। পেশায় স্থানীয় টিমের খেলোয়াড় এবং কোচ। বাকি সময়টা কেটে যায় সুইডেনে আফগান অভিবাসীদের ফুটবল শেখানোর কাজে। ক’মাস আগেই সুইডেনে পৌঁছেছে তারা। এনকওচার কথায়, “ওদের সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পাই। আমি জানি, ওরা কোথা থেকে এসেছে।”
ফুটবল, মাইগ্রেশন অ্যান্ড গ্লোবালাইজ়েশন: দ্য পার্সপেক্টিভ অব হিস্ট্রি গবেষণাপত্রে (২০০৭) ম্যাথিউ টেলর বলেছেন, গত ১০-১৫ বছরে বিশ্ব ফুটবলের বাঁক বদলের কারণ তিনটি: বাণিজ্যিকীকরণ, পেশাদারিত্ব ও বিশ্বায়ন। ১১ বছর আগের গবেষণায় যে ছবি দেখিয়েছিলেন ম্যাথিউ, এ বার তার পূর্ণ রূপ দেখল লেনিনের দেশ। ১৮৮১’তে স্কটল্যান্ড দলে খেলেছিলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার অ্যান্ড্রু ওয়াটসন। ১৯৮০-৯০-এর দশকেও ইংল্যান্ড বা পর্তুগাল দলে অশ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড় ছিলেন হাতেগোনা। আজ ফ্রান্সে তাঁরা ৭৮.৩ শতাংশ, সুইৎজ়ারল্যান্ডে ৬৫.২ শতাংশ।
এমন মিলমিশ অবশ্য অনেকেরই না-পসন্দ। বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি ফুটবলার লরাঁ ব্লাঁ-র মন্তব্য: “দেশের ফুটবল অ্যাকাডেমিগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ বিদেশি ফুটবলারের সংখ্যা ৩০ শতাংশে বেঁধে দেওয়া উচিত। এতেই সুরক্ষিত থাকবে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য। ১২-১৩ বছর বয়স থেকে এই সংরক্ষণ চালু করা উচিত। এ ভাবেই জাতীয় দলে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা কমাতে পারব আমরা।” বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের দায়ে দেশ জুড়ে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তবে এটা যে অনেকেরই মনের কথা, মালুম হয় রোমেলুর উক্তিতে: “আমি ভাল খেললে ওঁরা বলেন, বেলজিয়ামের স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। কোনও দিন ভাল খেলতে না-পারলে ওঁরা বলেন, কঙ্গো-বংশোদ্ভূত স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু।” কিন্তু ফুটবলারের দেশ ও ভাবে নির্ধারণ করা যায় না। ঘোদ্দোসের মন্তব্য: “আমার শোওয়ার ঘরে দুটো জাতীয় পতাকা টাঙানো থাকে। একটি সুইডেনের, অন্যটি ইরানের। আমার কাছে এটা ক্লাব পছন্দ করার মতো, তার বেশি কিছু নয়।”
এ বারের বিশ্বকাপে সুইস ফুটবলার গ্রানিত জ়াকা আর জ়েরদান শাচিরি-কে নিয়ে খুব হইচই হয়েছে। শাচিরির (ছবিতে) জন্ম কসোভোয়। ২০০৮ সালে তা সার্বিয়ার থেকে স্বাধীন হয়ে গেলেও সার্বরা সেটা স্বীকার করেন না। কসোভোর স্বাধীনতার পক্ষে কথায় বলায় তাঁর বাবাকে সাড়ে তিন বছর বন্দি থাকতে হয়েছিল তৎকালীন য়ুগোস্লাভিয়ায়। জ়াকার বাবা-মা আলবানীয় বংশোদ্ভূত, ভাই আলবানিয়ার জাতীয় দলের ফুটবলার। ১৯৯৮-৯৯ যুদ্ধের পরে এই দুই পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল সুইৎজ়ারল্যান্ডে। গোল করার পর তাই আলবানিয়ার জাতীয় প্রতীক ইগলের মতো ভঙ্গি করেছিলেন তাঁরা। ফিফার শাস্তির কোপে পড়লেও বার্তাটি ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া গিয়েছিল। অগণিত ফুটবল-ভক্ত ইগলকে প্রতিবাদের প্রতীকেই গ্রহণ করেছেন।
এই ইগলরাই ফুটবলের ভবিষ্যৎ। অফুরান প্রাণশক্তিতে তাঁরা ভেঙে দিচ্ছেন ফুটবল দুনিয়ার একচেটিয়া আধিপত্য, জিতে নিচ্ছেন মাঠের লড়াই আর দর্শকদের মন। ইগল সীমানা জানে না, সীমানা মানে না। বিশ্বকাপ তাই, শেষ পর্যন্ত, ইগলদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy