Advertisement
E-Paper

অভিবাসন: কিছু অপ্রিয় সত্য

এই যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে অখণ্ডনীয়। কিন্তু অনেক কথা ‘রাজনৈতিক ভাবে বেঠিক’ অর্থাৎ অপ্রিয় বলে এ দেশে, ও দেশে, কোনও দেশেই বলা হয় না। অভিবাসন নীতিও ব্যতিক্রম নয়।

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৮ ০১:১১
প্রার্থী: মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

প্রার্থী: মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

অনেক দিন ধরেই জার্মানির কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে আসি, যেমন এ বারেও এসেছি, অল্প দিনের জন্য। সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক থেকে এখনও পর্যন্ত অনেক পাল্টে গিয়েছে সারা বিশ্ব, জার্মানিও ব্যতিক্রম নয়। সব বড়লোক দেশেই বিদেশিদের পাকাপাকি ভাবে থেকে যাওয়ার সমস্যা বাড়ছে বলে শোনা যায়। এরই মাঝে মার্কিন মুলুক আর ইউরোপের মধ্যে দৈনন্দিন মনোমালিন্য বেড়েই চলেছে। পরিবেশ নীতি, বাণিজ্য নীতি, উদ্বাস্তু নীতি ইত্যাদি নিয়ে সংঘাত ক্রমবর্ধমান। একেবারে সম্প্রতি আমেরিকার সরকার ঠিক করেছে বেআইনি ভাবে আগত বাবা-মায়েরা তাঁদের শিশুসন্তানদের সঙ্গেও থাকতে পারবেন না। কাগজে পড়লাম, আমাদের দেশের অনেক মানুষও এই সমস্যার মধ্যে পড়েছেন— তাঁরা মার্কিন মুলুকে থাকতে চাইছেন, কিন্তু আইন তাঁদের বাধা দিচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিকর্তারা মার্কিন সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। মানবতাবাদী উদারপন্থী বিশিষ্ট মানুষেরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের অমানবিক অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে বিস্তর বক্তব্য পেশ করছেন। যুদ্ধজর্জরিত দেশের মানুষ, রাষ্ট্রের দ্বারা অত্যাচারিত সহায়সম্বলহীন মানুষ একটু আশ্রয়ের জন্য দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন। বড়লোক বড় দেশগুলোর উচিত সাহায্যের হাত বাড়ানো।

এই যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে অখণ্ডনীয়। কিন্তু অনেক কথা ‘রাজনৈতিক ভাবে বেঠিক’ অর্থাৎ অপ্রিয় বলে এ দেশে, ও দেশে, কোনও দেশেই বলা হয় না। অভিবাসন নীতিও ব্যতিক্রম নয়। আমি পর পর কতকগুলো বক্তব্য উপস্থাপিত করছি, অথবা গল্পচ্ছলে কিছু সত্য কাহিনি বলে যাচ্ছি। এই কথাগুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন। আমি কোনও মতামত দেব না। পাঠকরা পড়বেন আর ভেবে দেখবেন। যা বলছি, কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কিছু বিদেশের স্থানীয় লোকদের সঙ্গে গল্প করে জানতে পেরেছি। আর, কিছু এ যাবৎ অনুচ্চারিত জিজ্ঞাসা।

পশ্চিমবঙ্গে এক কালে রেশন কার্ড বিলি করার রাজনৈতিক উদ্যোগ হয়েছিল বলে শুনেছি, এখনও হয় কি না জানি না। ভারতে বা অন্যান্য দেশে এ ধরনের বিষয়ে প্রকৃত অবস্থাটা কী, আমি জানি না, অনেকেই জানেন না। কিন্তু আশ্রয়প্রার্থীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাগজপত্র পাইয়ে দিয়ে, আর্থিক বা অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করে তাদের ভোট-সক্ষম করে তোলা হয় বেশ কিছু বড়লোক দেশে, অথচ অন্য দেশ থেকে পড়াশোনা করে আসা ছাত্রছাত্রীরা সেখানে ভাল কাজের বিনিময়ে থাকবার সুযোগ পেতে চাইলে তাদের চুল পেকে যায়। কোনও দেশের নাম করছি না, একটু খোঁজ করলেই বোঝা যাবে কোন দেশগুলোর কথা বলছি। ঠিক এখনই দু’বাহু বাড়ায়ে যাকে তাকে অভিবাসনের সুযোগ দেওয়ার জন্য সে দেশের রাজনীতি একেবারে টলোমলো। গোটা ইউরোপেই সাধারণ মানুষের বিরক্তির শেষ নেই। মানবিকতার বুলি, উদারনীতির জয়গান আর স্বার্থপর রাজনীতিকে আলাদা করে দেখা যায় না। ভোটের জন্য নির্লজ্জ ভাবে অভিবাসন নীতি বা উদ্বাস্তু নীতি অনুসরণ করা হয়, কিন্তু সে কথা বললে তথাকথিত সভ্য জগৎ শুনতে চায় না।

দু’বছর আগের কথা। গ্রিসে যাচ্ছি। ইউরোপের একটি বিমানবন্দরে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছি। সেখানে অপেক্ষা করছেন অন্য দেশ থেকে আসা একটি দল, মহিলাই বেশি, কিছু পুরুষও। পোশাকআসাক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাঁরা খুবই সচ্ছল। ওই বিমানবন্দরের শপিং মল থেকে অনেক দামি দামি জিনিসও কিনলেন তাঁরা। সবার সঙ্গে এক রকম দেখতে একটি করে ব্যাগ, তাতে বেশ কিছু কাগজপত্র আছে। আর ব্যাগটির উপর রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী বিভাগের ছাপ। জানতে পারলাম, এঁরা আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু, নিজেদের দেশে চরম দুঃখকষ্ট, দারিদ্র ইত্যাদির জন্য কোনও একটি বড়লোক দেশে থাকতে যাচ্ছেন।

অনেক দিন আগের কথা। সন্ধ্যাবেলা। জ়ুরিখ স্টেশন থেকে ট্রেনে করে যাচ্ছি এক জায়গায়। প্রায় প্রতিটি স্টেশনে ভারতীয়দের মতো দেখতে দু’এক জন উঠছেন। উঠেই আমাকে তামিল ভাষায় সম্বোধন করছেন, বোধ হয় আমার চেহারা আর তখনকার কালো গোঁফের জন্য। সবাই পেট্রল পাম্পে কাজ করেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলাম তাঁরা সবাই শ্রীলঙ্কার তামিল মানুষ, নিজেদের পাসপোর্টগুলো পুড়িয়ে দিয়ে বলেছেন তাঁরা সবাই এলটিটিই-র সদস্য, শ্রীলঙ্কার সরকারের চরম অত্যাচারে তাঁরা সুইৎজ়ারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইছেন, কেউ আসলে কোনও দিনই এলটিটিই-র ধারে কাছে ছিলেন না।

আমেরিকাতে পড়াতে গিয়েছি, আমার পুরনো জায়গা— রচেস্টার-এ। কিছু ছাত্রের সঙ্গে, তাদের গাড়িভাড়ার খরচা দেওয়ায়, তারা গাড়ি ভাড়া করে চালিয়ে আমাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। ফেরার সময় তাদের এক জনের কাকার বাড়িতে গেলাম। ছেলেটি তৈরি হচ্ছিল, কাকা আমার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। তিনি বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না যে, আমি পড়ানো শেষ করে দেশে ফিরে যাচ্ছি। কেন থেকে যাচ্ছি না? নিশ্চয়ই আমার আর ভিসা নেই বলে! আমি অধ্যাপক, আমার ওখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই, আমি আবার আসতে পারি— আমার এই বক্তব্য তিনি বুঝতে পারেননি। তিনি আমাকে বললেন যে আমি বেআইনি ভাবে থেকে যেতে পারি, তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। দু’মাস টেক্সাসের একটি গ্যাস স্টেশনে বা একটি কৃষি ফার্মে মজুর হয়ে কাজ করতে হবে আমাকে, তার পর আমি গ্রিন কার্ড পেয়ে যাব, সব পাকাপাকি হয়ে যাবে। বললেন এ দেশটায় এক বার এলে কেউ যেতে চায় না, যেতেও হয় না। আমার ভাগ্য ভাল, টেক্সাসে দিনমজুর হতে হয়নি।

এক বয়স্ক বিদেশিনি কিছু দিন আগে আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি একটি দোকানে কাজ করতেন। বললেন, ‘‘আচ্ছা বলো তো, সারা বিশ্বে সব দেশে যদি যুদ্ধ লেগে যায় আর সবাই আমার দেশে আসতে চায়, থেকে যেতে চায়, তা হলে আমরা কী করব? আগে সরকার আমাদের বুড়ো বয়সে অনেক কিছু সুবিধা দিত, আর দেয় না, বলে— টাকা নেই। কিন্তু উদ্বাস্তুদের জন্য দেদার খরচা হচ্ছে!’’ আমি কলকাতার লোক, মানবিকতার যুক্তি শুরু করে বললাম, ‘‘জানেন, এ রকম অনেক যুদ্ধের আসল কারণ— আপনাদের দেশের সরকারের আন্তর্জাতিক স্তরে দীর্ঘ কালের শোষণের রাজনীতি, তার দায় নিতে হবে না?’’ তিনি খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কিন্তু আমি তো কারও ক্ষতি করিনি!’’ আর কিছু বলতে পারিনি।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। স্থানীয় লোকেদের এক কথা, একেবারে সব্বাই এক সুরে বলছেন, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে, কারণ স্বল্প আয়ের মানুষদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এ ছাড়া, দৈনন্দিন অপরাধের হারও বেড়েই চলেছে। এই রূঢ় বাস্তবের সমাধান কী, জানা নেই। শুধু গালভরা মানবিকতার বুলি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হয় না। একটা কথা ভারতীয় বা বাঙালি হিসেবে চিন্তা করার চেষ্টা করি। আমরা তো অনেক ক্ষেত্রে অন্যদের দেশে থাকবার জন্য দয়াপ্রার্থী। তারা থাকতে দেবে না, আমরাও ছাড়ব না। অন্য দেশ আমাকে থাকতে দেবে কি না, সেটা আমার দাবির ব্যাপার হতে পারে না। অনেক সংগ্রামী স্লোগান জোর করে দখল করে নেওয়ার কথা, ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু আসলে এটা তো আত্মসম্মান এবং অপমানের প্রশ্ন। সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রায় জলের দরে শিক্ষা পেয়ে চিরজীবনের মতো অন্য দেশকে সমৃদ্ধ করার তাগিদ হয়তো দারিদ্র, লোভ এবং অনেক দিন পরাধীন থাকার ফল। বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তি নিয়ে এতই মগ্ন যে, মিথ্যে জাতীয়তাবোধ নিয়ে ভাবার সময়ও তাদের নেই। এক সময় বলা হত, বিশ্বব্যাঙ্ক বা আইএমএফ আমাদের যে টাকা ধার দেয় তাতে কোনও শর্ত আরোপ করা চলবে না। অর্থাৎ, তাদের টাকা ধার নেব, কিন্তু কী ভাবে শোধ করব সেটা আমরা ঠিক করে দেব। এ ধরনের যুক্তিকে কুযুক্তি বলাই যে ঠিক, অনেক দিন বাদে সেটা সর্বসমক্ষে বলা শুরু হয়েছিল। আসুন, আমরা সবাই প্রতিবাদ করি, অন্য দেশের নেতাদের গালমন্দ করি, অভিবাসন নীতিকে তুলোধোনা করি, নিজেরা উদারনীতির প্রচারমাহাত্ম্যের ধারায় অবগাহন করি। কিন্তু অপ্রিয় সত্যটা হল, আমরা অন্যদের বাড়িতে একটু থাকতে পাব বলে তাদের দরজায় ভিক্ষাপ্রার্থী। এই সহজ সত্যটা যেন ভুলে না যাই। আমরা ভুললেও, রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশাল অর্থে ও সুবিধায় পুষ্ট আধিকারিকরা যেন মনে রাখেন।

সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা’য় অর্থনীতির অধ্যাপক

Immigration Rohingya people Legal Values
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy