Advertisement
E-Paper

সমান ও স্বাধীন

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিগণ যখন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারার বিবেচনার কাজে বসিয়াছিলেন, তখন তাঁহাদের মনে যে বড় সাংবিধানিক প্রেক্ষিতটি বিধৃত ছিল

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়, রায় সুপ্রিম কোর্টের। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়, রায় সুপ্রিম কোর্টের। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিগণ যখন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারার বিবেচনার কাজে বসিয়াছিলেন, তখন তাঁহাদের মনে যে বড় সাংবিধানিক প্রেক্ষিতটি বিধৃত ছিল, তাহা নিশ্চয়ই ভারতীয় নাগরিকের অধিকারের স্বীকৃতি। এ দেশে পুরুষ ও নারী উভয়ই যে সমান মাপের নাগরিক, তাহাদের অধিকার ও ব্যক্তিপরিসরও যে সমান মানের ও মাপের, দ্বিতীয় যে কোনও মতেই প্রথম অপেক্ষা ন্যূন হইতে পারে না, এবং প্রথম যে দ্বিতীয়কে কোনও ভাবেই নিজের সম্পত্তি বলিয়া দাবি করিতে পারে না— এই হইল সেই বৃহৎ নৈতিক প্রেক্ষিত। ভারতীয় সংবিধানের গোড়াতেই বলা আছে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করিবার লক্ষ্যটির কথা, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এত কাল যাবৎ উপরের দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি বিধিটির মধ্যে প্রায়োগিক অর্থে এক বিরাট লিঙ্গবৈষম্য প্রবিষ্ট হইয়া ছিল।

সংবিধানের রচয়িতারা হয়তো এই কারণেই বারংবার বলিয়াছিলেন যে, সংবিধানের ভূমিকা ও মৌলিক অধিকারগুলির আলোকেই যেন বাকি নীতিপদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার সাংবিধানিক নীতি ও উল্লিখিত দণ্ডবিধির মধ্যে সেই বৈষম্য দূর করিয়া সর্বোচ্চ আদালত একটি অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য সমাধা করিল, নাগরিক সমাজকে দেশের বিচারবিভাগের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করিবার আরও একটি অবকাশ তৈরি করিল।
ঔপনিবেশিক যুগ হইতে প্রচলিত এবং স্বাধীন ভারতেও অপরিবর্তিত ভাবে গৃহীত আইনটি তো যুগোপযোগী ছিলই না, তাহার উপর ইহাতে যেন বৈষম্যের সহিত একটি অত্যাচারের মাত্রাও যুক্ত হইয়াছিল। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অধিকারকে এই আইন এমন জায়গায় লইয়া গিয়াছিল, এবং স্বামীর অনুমতিসাপেক্ষে স্ত্রীর পরকীয়া সমর্থনযোগ্য বলিয়া এমন একটি ভয়ানক সম্ভাবনা খোলা রাখিয়াছিল যে এত দিন কী করিয়া এই আইন প্রচলনসিদ্ধ ছিল ভাবিতে আতঙ্ক হয়। তাই, পরকীয়া আর শাস্তিযোগ্য অপরাধ নহে, এবং স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তি নহে— বিচারপতিদের এই সামান্য দুইটি বাক্যের ভাঁজে আসলে লুকাইয়া আছে একটি অসামান্য পরিবর্তন। এ দেশের নারী-পুরুষের তুলনামূলক অবস্থানে একটি বৈপ্লবিক অগ্রগমন আসিল বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এত জরুরি একটি রায় লইয়াও বিরুদ্ধ স্বর শোনা যাইতেছে দেশের নানা কোণে। রক্ষণশীল পুরুষতন্ত্রের প্রতিক্রিয়াটি লইয়া আলাদা করিয়া কিছু বলিবার থাকিতে পারে না, ইহাকে ঠেকাইবার জন্যই নারীর অধিকার যাচ্ঞায় এখনও আলাদা করিয়া আদালতের দ্বারস্থ হইতে হয়। তবে প্রগতিশীল পক্ষের দিক হইতেও যে প্রশ্ন উঠিয়াছে, তাহার উল্লেখ প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠিয়াছে যে, পরকীয়া যদি অবৈধ না হয়, তবে স্বামীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বামী-ত্যক্তা স্ত্রী ইহার পর কী ভাবে তাঁহার নিজের বা সন্তানের জন্য খোরপোশ আদায় করিতে আদালতের দ্বারস্থ হইবেন। এ বিষয়ে একটিই কথা বলিবার। ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান এত অসংখ্য ধরনে ও উপায়ে বিপন্ন যে কোনও একটি রায়ের দ্বারা সবটুকু সুরক্ষা দানের আশা বাতুলতা। কিন্তু এই রায়ের দ্বারা যে নারীর নিজস্ব শরীরের উপর, এবং তৎসূত্রে নিজস্ব অস্তিত্বের উপর, অধিকার ফিরিয়া আসিল— তাহাকে কোনও ভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ করিয়া দেখা যায় না। সংবিধানের অন্তত দুইটি মৌলিক নীতি এই বিতর্কিত আইনে লঙ্ঘিত হইতেছিল। এক, দেশের যে কোনও আইনকেই সংবিধানের মূল নীতিগুলির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে। দুই, নাগরিকের শরীরের উপর অর্থাৎ নিজের নিভৃততম ক্ষেত্রটির উপর নিজের অধিকারকে কোনও মতেই খাটো করা চলিবে না। সুতরাং, সাম্প্রতিক রায়টি অতিকাঙ্ক্ষিত তো বটেই, তদুপরি যুক্তিগত ভাবেও সংশয়াতীত।

Supreme Court Adultery Court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy