Advertisement
E-Paper

বিসর্জন

সমাজে বিস্তৃত জ্ঞান বা সচেতনতার যে আধার, তাহা যখন দ্রুত পশ্চাদ্‌গামী হয় ও সহিষ্ণুতাকে বিসর্জন দিয়া অসহিষ্ণুতাকে বরণ করিতে উঠিয়া-পড়িয়া লাগে, তাহার ঐতিহাসিক নামকরণ বিষয়ে আলোচনা-গবেষণা চলিতেই পারে।

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ০১:৩৭
অমর্ত্য সেন

অমর্ত্য সেন

২০১৪ সাল হইতে ভারত পিছন দিকে লম্বা লাফ দিয়াছে।— ঋজু ও সরল এই বাক্যটি অমর্ত্য সেনের। এই বাক্য কেন তাঁহাকে উচ্চারণ করিতে হইল, সেই যুক্তি তাঁহার পরবর্তী বাক্যগুলিতে সুবিন্যস্ত। উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারত এখন দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত দেশের মধ্যে শেষ হইতে দ্বিতীয়। কোনও ক্রমে ভারতকে একেবারে তলানি হইতে রক্ষা করিতেছে পাকিস্তান। কিন্তু ইহা শেষ কথা নহে, প্রথম কথা। পরবর্তী এবং মুখ্য কথাটি হইল: ভারত বলিতে যে দেশটি এত দিন বোঝানো হইত, সেই ‘আইডিয়া’ বা ধারণা হইতেই ভারত বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। একটি বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। ‘ধারণা’ বিষয়টি সাধারণত ভাবগত, বস্তুগত নহে। কিন্তু স্বাধীন ভারতের গত সাত দশকের যাত্রায় ‘ভারত’ নামক ধারণাটি অনেক ক্ষেত্রেই বস্তুগত-য় উপনীত হইয়াছিল। ধর্ম, জাত, ভাষা ইত্যাদি নিরপেক্ষ একটি ভারতীয়তা তাহার প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে রূপায়িত হইয়াছিল। আইনকানুন বিধি-বিধান আচার-অনুষ্ঠানে অন্বিত হইয়াছিল। গত কয়েক বৎসরের মধ্যে বাস্তব স্তরেই সেই ধারণাটি আক্রান্ত ও বিপন্ন হইয়া পড়িবার অর্থ: অনেক কষ্টের ও যত্নের অর্জন বিসর্জন দেওয়া হইয়াছে। সমাজে রাজনীতিতে সংখ্যাগুরুবাদের ছড়াছড়ির সঙ্গে এখন এমনকি আদালতের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নের সম্মুখীন হইতেছে। পশ্চাৎপদতা কতটা পরিব্যাপ্ত, তাহার প্রমাণ: এ বিষয়ে অশান্তি কিংবা অসহায়তার সুরটিও আজ প্রবল নহে। তাজমহলের ইতিহাস নূতন করিয়া লিখিবার প্রচেষ্টা চলিতেছে, গাঁধীর পাশে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের স্থান হইতেছে, বৈদিক বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতা প্রচারিত হইতেছে, গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার উল্লেখ পাঠ্যবই হইতে সরিতেছে— এবং, আশ্চর্য, এ সবই মৌন সম্মতিতে গ্রাহ্য হইতেছে।

সমাজে বিস্তৃত জ্ঞান বা সচেতনতার যে আধার, তাহা যখন দ্রুত পশ্চাদ্‌গামী হয় ও সহিষ্ণুতাকে বিসর্জন দিয়া অসহিষ্ণুতাকে বরণ করিতে উঠিয়া-পড়িয়া লাগে, তাহার ঐতিহাসিক নামকরণ বিষয়ে আলোচনা-গবেষণা চলিতেই পারে। কিন্তু অমর্ত্য সেন প্রতিবাদ ও বিরোধিতা নির্মাণের দিকেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছেন। তাঁহার স্পষ্ট সতর্কীকরণ, নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধতা কেবল রাজনৈতিক বিরুদ্ধতার বিষয় নয়। ভারত নামক ধারণাটিকে ফিরাইয়া আনিবার প্রকল্প। আগামী ২০১৯ সালের নির্বাচনে মোদী-বিরোধী শক্তিগুলিকে এই কথা মাথায় রাখিয়াই একজোট হইতে হইবে। একটি বড় উদ্দেশ্যের দিকে তাকাইয়া নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থবিভেদ ও সংঘাত শিকায় তুলিয়া রাখিতে হইবে। বড় বিপদের সামনে এই সব বিভেদ ও সংঘাত নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর।

রাহুল গাঁধী কি অধ্যাপক সেনের কথা শুনিলেন? তাই জন্যই কি তাঁহার নূতন করিয়া ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ তুলিয়া ধরিবার অঙ্গীকার? নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঁকড়াইয়া ধরিবার পরামর্শ? কথাটি উঠিতেছে এই জন্য যে রাহুল গাঁধীর ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা লইয়া ইতিমধ্যে বিস্তর প্রশ্ন তৈরি হইয়াছে। হইবে না-ই বা কেন। নেহরু তো উপবীতের প্রমাণও দিতেন না, মন্দিরে পূজা দিতেও ছুটিতেন না। বিলম্বে হইলেও যদি রাহুলের বোধোদয় হয় যে নরেন্দ্র মোদীর ছাপযুক্ত বিজেপির উপযুক্ত বিরোধী নেতা হইবার জন্য বিজেপির দুই নম্বর দল হইলে চলিবে না, বরং নেহরুবাদের জিনগত উত্তরাধিকারে ফিরিয়া উদার ও সহিষ্ণু ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুলিয়া ধরিতে হইবে। তাহার সঙ্গে পুরাতন কংগ্রেসের আদলে দেশের সকল দল ও সকল মতের একটি ছত্রসমান মঞ্চ তৈরি করিতে হইবে। ভারত নামক ধারণাটিকে তবেই আবার ফিরাইয়া আনা সম্ভব। রাহুল-সহ অন্য সকল বিরোধী নেতাকে বুঝিতে হইবে, প্রথম ও প্রধান কাজ এখন ইহাই। এমন একটি ধারণা যদি এক বার হারাইয়া যায়, তবে তাহার পুনর্নির্মাণ কঠিন। হয়তো অসম্ভবও।

Amartya Sen Development
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy