ভারতীয় মুসলিম মহিলারা এত দিনে ‘স্বাধীন’ পুণ্যের সন্ধান পাইলেন। দেশের নূতন বন্দোবস্তে এখন হইতে তাঁহারা পুরুষসঙ্গী-বিহীন ভাবে হজ যাত্রায় যাইতে পারিবেন, যদি তাঁহাদের বয়স পঁয়তাল্লিশের উপর হয়। স্বভাবতই, এই ‘মুক্তি’র সংবাদ অতি স্বাগত। বিদ্যাচর্চা হইতে শুরু করিয়া জীবনচর্যা, সবই যদি তাঁহারা একা পারেন, তবে একা ধর্মযাত্রায় যাইতে পারিবেন না কেন। এক কালে পুরুষের পুণ্যে নারীর পুণ্য হইত, নহিলে খরচও বাড়িত, অসূর্যম্পশ্যাদের সূর্যালোকে টানিয়াও আনিতে হইত। সে দিন গিয়াছে, ভালই। কিন্তু পুরুষের পুণ্য পাশে না থাকিলে নারীর পুণ্য হইবে না, ইহাই বা কেমন ব্যবস্থা! ইহা কেবল বৈষম্যমূলক নয়, রীতিমত অবমাননাকর। ফলে ভারতীয় সংস্কারটি অতি জরুরি। তবু কতকগুলি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। প্রথম প্রশ্ন, এমন একটি সংস্কারে এত দেরি কেন। ভারতের আগে তো অনেক দেশই এই প্রথা উঠাইয়া দিবার সৎসাহস দেখাইয়াছে। সৌদি আরব অন্তত তিন বৎসর আগে ‘মেহরাম’ বা পুরুষ অভিভাবক ব্যতিরেকে মহিলাদের হজযাত্রার পক্ষে আইন পালটাইয়া দিয়াছে। সেই পরিবর্তনের আঁচ এ দেশের মুসলিম সমাজে আসিয়া পৌঁছাইতে এতখানি সময় লাগিল! একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকও শেষ হইয়া আসিতেছে, অথচ এখনও সুযোগ পাইবামাত্র এমন একটি প্রথা বিষয়ে ভারতের সমাজের, বিশেষত মুসলিম সমাজের, সর্বস্তরে প্রশ্ন ওঠে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হইতে ব্রিটেন, নানা দেশের সংস্কার সঙ্গে সঙ্গে সাধিত হইলেও ভারতীয় মুসলিম সমাজের কণ্ঠে বাধ্যতামূলক পুরুষসঙ্গী কিংবা ‘মেহরাম’ প্রথার বিরুদ্ধতা সে ভাবে শোনা যায় নাই। পঁয়তাল্লিশ বৎসরের নীচে মহিলাদের ক্ষেত্রে কেন এই স্বাধীনতা প্রযোজ্য নয়, তাহা লইয়াও হইচই নজরে আসিল না। যেন ইহাই স্বাভাবিক, ইহাই সংগত। যেন ইহার অপেক্ষা বেশি কিছু দাবি করাই যায় না। এ সকল প্রশ্ন অবশ্যই স্বস্তিদায়ক নয়, তবু না করিয়া উপায় নাই। সমাজের অর্ধাংশের প্রগতি বা মুক্তি বিষয়ে এমন অবহেলা কিন্তু সমাজকে সব দিক হইতে পিছাইয়া রাখে। এক শতকেরও বেশি আগে বেগম রোকেয়া বার বার এই বিষয়ে সাবধান করিয়াছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সরকার ইতিমধ্যেই এই ‘দারুণ কৃতিত্ব’-এর দাবি তুলিয়াছেন। মন কি বাত-এর বক্তব্য শুনিয়া মনে হইয়াছে এত বড় বৈপ্লবিক সংস্কারটি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগেই ঘটিল, তিনিই ইহার কান্ডারি। এই দাবি যে সংগত অথবা স্বীকার্য নয়, তথ্যই তাহা বলিয়া দেয়। তথ্য হইতে অবশ্য উপরের অনুচ্ছেদের প্রশ্নগুলিও সরকারের দিকে ধাবিত হয়। মনে করাইয়া দেয়, তিন বৎসরকাল সময়, এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের ঠেলা লাগিয়াছে এই সংস্কার কার্যকর করিতে। কাজটি শেষ পর্যন্ত হইয়াছে, ইহা সত্যই প্রশংসার্হ, তবে অন্যান্য দেশ যখন আগেই করিয়া ফেলিয়াছে, তখন এই কাজের জন্য খুব বেশি প্রশংসা দাবি করাও ভাল দেখায় না।
কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা বলিতেছে, অন্যান্যদের মতো আবেদনকারী মহিলাদের এ বার হজ যাত্রার জন্য লটারির মুখাপেক্ষী হইতে হইবে না। ধরিয়া লওয়া যায়, সিদ্ধান্ত দ্রুত, চলতি বৎসরেই, কার্যকর করিতে এই প্রস্তাব। সত্যই দ্রুত কাজে পরিণত হইলে এই সংস্কার দৃষ্টান্তসুলভ হইয়া থাকিবে। বহু কালের শৃঙ্খল মোচন করিয়া ধর্মসম্প্রদায়ের অলিখিত কুপ্রথা কী ভাবে রদ করা যায়, তাহার দৃষ্টান্ত। সৌদি আরব যে আইন পালটাইয়া অন্যান্য দেশের কাছে এই সুযোগ পৌঁছাইয়া দিল, তাহাও সুসংবাদ বইকি। সৌদির অতি-রক্ষণশীল সমাজে যে নারীর অবস্থান ও নারীর ‘ইমেজ’ ধীরে ধীরে পালটাইতেছে, গাড়ি চালাইবার অধিকার হইতে একাকী হজের অধিকার সেই পরিবর্তনের সূচক। বিলম্বিত, অতি বিলম্বিত। তবু স্বাগত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy