Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

ব্রহ্মাস্ত্র

ভারতীয় রাজনীতির আত্মা বলিয়া যদি কিছু থাকে, তাহার মধ্যে যত রকমের ঘোরপ্যাঁচ ও জটিলতা বিরাজমান, সব কিছুর সহিতই বাবাসাহেব ওতপ্রোত জড়াইয়া আছেন।

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৮
Share: Save:

পাঠ্যপুস্তকগুলি বলিয়া থাকে, বাবাসাহেব অম্বেডকর হইলেন আধুনিক ভারতের রূপকার। পাঠ্যপুস্তকের বাহিরের বৃহত্তর এবং সত্যতর কথাটি হইল, বাবাসাহেব অম্বেডকর প্রকৃত অর্থে আধুনিক ভারতের আত্মাস্বরূপ। কথাটি শুনিতে ভয়ানক আধ্যাত্মিক ঠেকিতে পারে, কিন্তু বিষয়টি রাজনীতির। ভারতীয় রাজনীতির আত্মা বলিয়া যদি কিছু থাকে, তাহার মধ্যে যত রকমের ঘোরপ্যাঁচ ও জটিলতা বিরাজমান, সব কিছুর সহিতই বাবাসাহেব ওতপ্রোত জড়াইয়া আছেন। সে হিন্দুধর্ম প্রণোদিত রাজনীতির স্পর্ধাই হউক, জাতিবিদ্বেষ জর্জরিত সমাজমনের বিকারই হউক, পশ্চাৎপদ শ্রেণির প্রতি বৈষম্যই হউক, সমস্ত ধরনের অপ্রীতিকর সঙ্কটের সহিত কোনও না কোনও ভাবে যেন অম্বেডকরের নামটি জুড়িয়া যাইবারই কথা। ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির সব রকমের জটিল-কুটিল সমস্যাগুলি তিনি চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়াছিলেন, জাতীয়তাবাদের সুদৃশ্য মোড়কে তাহাদের চাপাচুপি দেন নাই। এই কারণেই গত কয়েক দশক ধরিয়া ভারতীয় রাজনীতিতে অম্বেডকর সর্বাধিক সংবেদনশীল নাম। স্ফুলিঙ্গের মতো ব্যবহৃত হইতেছে তাঁহার নামটি। গাঁধীকে যদি আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠ নেতা আখ্যা দেওয়া হয়, অম্বেডকরকে বলিতে হইবে ভারতের সর্বাধিক বিতর্কিত নেতা। ভারতীয় রাজনীতির মূল কেন্দ্রটি সংঘর্ষময়, বিতর্কিত, আর সেই সংঘর্ষময় রাজনীতির কথা যিনি আজীবন বলিয়া গিয়াছেন, কল্পিত ঐক্যের অপেক্ষা বাস্তব বিভাজনের উপর জোর দিয়া বহু মানুষের অশেষ ভ্রুকুঞ্চনের কারণ হইয়াছেন, আজও ভারতীয় রাজনীতির সংঘর্ষময়তার মধ্যে তাঁহার প্রতি দিন অনায়াস যাতায়াত।

সুতরাং সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে যে এক বার বাবাসাহেবের মূর্তিতে গেরুয়া রং করিয়া তাঁহাকে এক রাজনীতির আরাধ্য করা হইতেছে, আবার কয়েক দিন পরই সেই মূর্তির উপরই নীল রং করিয়া তাঁহাকে প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির আলোকবর্তিকা বলিয়া দাবি করা হইতেছে, কিংবা এক জায়গায় তাঁহার মূর্তি বানাইবার ধুম পড়িতেছে, আবার অন্য কোথাও তাঁহার মূর্তি ধ্বংস করিবার সমারোহ চলিতেছে— এই ঘটনাবলি চিত্তাকর্ষক হইলেও বিস্ময়কর নহে। অম্বেডকরকে দলিতরা তাঁহাদের নিজেদের লোক বলিয়া বিক্ষোভ-আন্দোলন করিবেন, আবার অম্বেডকরের কথাবার্তা সুচারু ভাবে সম্পাদনা করিয়া হিন্দু উচ্চবর্ণ তাঁহাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের পরাকাষ্ঠা বানাইতে উঠিয়া পড়িয়া লাগে। এমনটাই যেন ঘটিবার কথা ছিল। দলিতরা তাঁহাকে বাবাসাহেব বলিতেই পছন্দ করেন, তাঁহার ছবি দলিত বাড়িতে ঈশ্বরের মতো শোভা পায়। আবার ব্রাহ্মণ্যবাদীরাও তাঁহাকে ছাড়িয়া দিতে পারেন না, ‘বাবাসাহেব’ আর ‘অম্বেডকর’-এর মধ্যে ‘রামজি’ মধ্য নামটি ফিরাইয়া আনিয়া তাঁহাকে রামভক্ত হিন্দুত্ববাদ আত্মগত করিতে চায়। জীবৎকালে অম্বেডকরকে লইয়া এত টানাটানি পড়ে নাই। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানের প্রাণপুরুষ হইবার দৌলতে, হিন্দুধর্ম যে আদ্যন্ত অসাম্যবাদী তাহা অনবরত বলিয়া যাইবার দৌলতে, গাঁধীর মতো বিগ্রহপ্রতিম নেতার সহিতও সমাজ-দার্শনিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হইবার দুঃসাহসের দৌলতে মরণোত্তর কালে তিনি একটি অসাধারণ রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত। তাঁহার নাম এখন একটি ব্রহ্মাস্ত্র— যাহার কাছে সে অস্ত্র থাকিবে, যুদ্ধে তাহারই জয়ের সম্ভাবনা অধিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

B. R. Ambedkar Indian Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE