খুব লড়াই করে ক্রিকেটে কোনও দল জিতলে আর অন্য দল হারলে বলা হয়, ‘যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট জিতেছে।’ কিন্তু একই ফরমুলায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরে সদ্য-সমাপ্ত গুজরাত নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির জয়ের পরে ‘যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র জিতেছে’ বোধহয় খুব জোর গলায় বলা যাবে না। গুজরাত নির্বাচনে মারামারি, বোমাবাজি হয়নি; ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের সাহায্যে সায়েন্টিফিক রিগিং-এর থিয়োরি কেউ কেউ খাড়া করার চেষ্টা করলেও তা বিশেষ কলকে পায়নি; সোজা কথায় মানুষ নিজের ভোট নিজ ইচ্ছায় দিয়ে আগামী সরকার নির্বাচন করেছে। এ যদি গণতন্ত্রের জয় না হয়, তা হলে কোনটা জয়?
এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভিতরে, বিশেষ করে সদ্য-সমাপ্ত গুজরাত নির্বাচনের অন্দরমহলে ঢুকতে হবে। নির্বাচন কমিশন ভোটের দিনক্ষণ প্রকাশ করামাত্র ‘আদর্শ নির্বাচনী বিধিনিষেধ’ চালু হয়ে যায়; অর্থাৎ, তখন থেকে নির্বাচনী লড়াইতে থাকা দলগুলি এমন কোনও অঙ্গীকার করতে পারে না বা বক্তব্য বলতে পারে না, যাতে ভোটাররা অন্যায্য ভাবে প্রভাবিত হন। প্রচারে থাকবে আগামী পাঁচ বছরে বিভিন্ন দলগুলি কে কী করবে বলে জানাচ্ছে, তার ইস্তাহার। গুজরাতে আমরা কী দেখলাম? ‘সব কা বিকাশ’ অর্থাৎ সবার উন্নয়নকে পাখির চোখ করা নরেন্দ্র মোদী, ব্র্যান্ড গুজরাতকে বাকি ভারতের মডেল করতে চাওয়ার থিয়োরি ভুলে মেতে উঠলেন কখনও ব্যক্তিগত আক্রমণে, কখনও অ-প্রতিষ্ঠিত (পড়ুন অসত্য) অভিযোগ করতে।
এবং যত নির্বাচনী প্রচার এগোল, যত স্পষ্ট হতে থাকল যে রাহুল গাঁধী গুজরাতের তরুণ তুরকি নেতা হার্দিক, অল্পেশদের সঙ্গী করে কঠিন লড়াই দিচ্ছেন, ততই আগামী পাঁচ বছরের কথা ভুলে মোদী ও তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে বড়, মেজ ও ছোট বিজেপি নেতারা ‘বিলো দ্য বেল্ট’ প্রচারে গেলেন। রাহুল গাঁধীকে কখনও আওরঙ্গজেব, কখনও অহিন্দু বলা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে চক্রান্ত করার অভিযোগ করা, মণিশংকর আইয়ার-এর মোদীকে ‘নীচ’ বলাকে ব্যবহার করে গুজরাত অস্মিতাকে সুড়সুড়ি দেওয়া ও শেষ পর্যন্ত রোড শো বাতিল হওয়ায় নির্বাচনী প্রচার শেষ হওয়ার কিছু আগে সি-প্লেনে চেপে আর দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ানো— কোনওটাই বাদ গেল না। বাদ গেল গুজরাত ও দেশের উন্নয়নের প্রশ্ন। আর যা নিয়ে প্রশ্ন প্রায় উঠলই না, তা হল নির্বাচনী ইস্তাহার। ক’জন জানেন যে গত বিধানসভা নির্বাচনের ইস্তাহারে গ্রামে ২৮ লক্ষ এবং শহরে ২২ লক্ষ ঘর তৈরির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নিদারুণ ব্যর্থতার পর এ বারেও আবার একই দল, একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সংখ্যাটা বাদ দিয়ে? ক’জন জানেন যে স্মার্ট ভিলেজ আর স্মার্ট সিটি-র পাশাপাশি বিজেপি চাষিদের আয় দ্বিগুণের কথা বলেছে? যদি এগুলি গড়পড়তা গুজরাত ভোটারদের কাছে পৌঁছত, তবে তাঁরা আরও ঠিক ভাবে নিজেদের ভোট সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
প্রায় হারের মুখোমুখি পৌঁছে যাওয়া বিজেপি দলকে প্রধানমন্ত্রীর পথ দেখানো এমন ধরনের প্রচার যে কোনও প্রকারে ফের সরকারে বসিয়েছে তা— অপ্রকাশ্যে তো বটেই— এমনকী টেলিভিশন বিতর্কেও মেনে নিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। শুধুমাত্র নেতিবাচক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কখনও বা সাম্প্রদায়িতকাকে সুড়সুড়ি দেওয়া প্রচারের ফলেই যে কংগ্রেস হেরেছে, তা বললে সেটা নিশ্চয়ই অতিসরলীকরণ হয়ে যাবে। কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে যেখানে কয়েক শতাংশ ভোট কমবেশির ফলে বহু আসন হাতবদল হয়েছে, সেখানে যদি এমন প্রচারের ফলে নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত হয়, তবে তাকে গণতন্ত্রের পরাজয় বলেই ধরতে হবে। মজার কথা, সংখ্যাতত্ত্ব জানাচ্ছে যে নির্বাচনের প্রথম পর্বে লড়াই সমান সমান ছিল ও কংগ্রেসের পক্ষে প্রায় সাড়ে ছ’শতাংশ সুইং ছিল, যা পরের পর্বে দু’শতাংশের কাছাকাছি নেমে আসে। কাকতালীয় (!) ভাবে ওই সময়ই প্রধানমন্ত্রী কখনও ‘নীচ’ সম্বোধনে ব্যথিত হয়েছেন, কখনও পাকিস্তান-ষড়যন্ত্রে ‘শিহরিত’ হয়েছেন, কখনও বা ছুড়ে-ফেলা ‘বিকাশ’কে আবার খুঁজে পেয়েছেন!
এই গোটা ঘটনায় আঙুল উঠছে নির্বাচনী কমিশনের দিকে। নির্বাচনী বিধিনিষেধ কি সত্যি সত্যিই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করতে পারে, না কি এটা সেরেফ কতকগুলি ছাপা পাতা, যাকে ইচ্ছেমত ছুড়ে ফেলা যায়। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন নির্বাচনে শোনা যায়, নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কমিশন মামলা করেছে, কিন্তু সেই মামলার কারণে কারও শাস্তির কথা বিশেষ শোনা যায়নি। ফলে আইন ভাঙাই আইন, বিশেষত যখন তার ফলে নির্বাচনী বৈতরণী পার করা যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো কি এতই পলকা যে তাকে এমন ভাবে প্রভাবিত করা যেতে পারে? কিন্তু ঘটনা হল, যতই আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের কথা বলি, তা নিয়ে গর্ব করি, আসলে তার মধ্যে সহস্র ফাঁকফোকর রয়ে গিয়েছে; মাস্ল, মানি, মাফিয়া ও মনগড়া প্রচার দিয়ে তাকে প্রভাবিত করা সম্ভব। যেখানে কোনও এক পক্ষের দিকে বিপুল জনমত, হয়তো সেখানে নয়, কিন্তু গুজরাতের মতো কঠিন লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তেমন আশঙ্কা থেকেই যায়।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ দখলে রাখার পর, কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলি যথেষ্ট অপ্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী গুজরাত জয় করতে এমন বল্গাহীন হয়ে উঠলেন কেন? কেন দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর আর দিল্লির মসনদ জলাঞ্জলি দিয়ে পনেরো দিনে চৌত্রিশটি সভা করলেন গুজরাতে? তার কারণ, তিনি জানেন যে, সামান্য পদস্খলন হলেই রাশ আলগা হয়ে যাবে। মোদী ম্যাজিকের পড়তি হদিশ পেলেই বিজেপির অন্দরমহলে অন্যান্য বহু স্বর দ্রুত জোরালো হতে শুরু করবে।
সেই আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, ফলাফলের পরে সেটা কিন্তু স্পষ্ট। বিজেপি জয়ী হয়েছে, কিন্তু যথেষ্ট জয়ী হয়নি। সেই ‘ব্যর্থতা’ যে কংগ্রেসের পাশাপাশি বিজেপির অ-মোদী অংশকে জ্বালানি সরবরাহ করবে, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু সময় বলবে, অগ্নিসংযোগ হবে কি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy