প্রচারে মিমি চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
সালটা ১৮৪২। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তখন হিন্দু কলেজের ছাত্র। বয়স মাত্র আঠারো বছর। নারীশিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভারতীয় নারীরা যেন বস্তুসামগ্রী—তারা আসবাবপত্রের মতো। তারা শুধু ভোগের উপকরণ মাত্র’।
পরবর্তী কালে সেই নারীসমাজ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের হাত ধরে অন্ধকার ঘরের কোণ ছেড়ে মুক্তির পথ খুঁজেছে। বিশ্বজয় করার পরে, স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের মূল সমস্যা খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ভারতের দুই মহাপাপ—মেয়েদের পায়ে দলানো আর জাতি জাতি করে গরিবগুলোকে পিষে ফেলা।” তিনি বুঝেছিলেন, “মেয়েদের পুজো করেই সব জাতি বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতিতে মেয়েদের পুজো নেই, সে দেশ কখনো বড় হতে পারেনি।”
পুজো মানে আনুষ্ঠানিক পুজো নয়, ‘দেবী’ বলে নারীকে ভুলিয়ে রাখাও নয়। তিনি ‘মেয়েদের পুজো’ বলতে মেয়েদের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার কথাই বলেছেন।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
তার পরে কেটে গিয়েছে প্রায় ১২০ বছর। ঘটেছে বহু নীরব ও সরব নারীবাদী আন্দোলন। আজ নারীসমাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এক পৃথিবীতে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছেছে মানুষ। বিশ্বায়নের স্রোতে আজ প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও আধুনিক সভ্যতার অংশ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কেমন আছেন আজকের নারীরা? আধুনিক পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে কি শ্বাস নিতে পারছেন তাঁরা?
তথ্য কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছে। জাতীয় অপরাধ নিবন্ধীকরণ বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট (২০১১) অনুযায়ী, ভারতে প্রতি তিন মিনিটে এক জন মহিলার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘটছে। প্রতি ২৯ মিনিটে এক জন মহিলা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। প্রতি ৭৭ মিনিটে এক জন নারী পণপ্রথার বলি হন। পণের দাবিতে অত্যাচারে ২০১১-তে ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা ৮,৬১৮টি।
ইউনিসেফ-এর ২০০৯ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪৭ শতাংশ ভারতীয় মহিলার ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে এই হার প্রায় ৫৬ শতাংশ। সুতরাং, এখনও বেশির ভাগ মানুষের কাছে মেয়ে মানে দায়—‘কন্যাদায়’, যার একমাত্র সমাধান বিয়ে। তা সে মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা না হোক, কী যায় আসে! তাই এখনও বেশির ভাগ পরিবারে পুত্রসন্তানই কাম্য। এখনও চলেছে দেদার কন্যাভ্রূণ হত্যা। শ্বাস নেওয়া তো দূরের কথা, জন্মের আগেই মেয়েদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, এ তো সভ্যতার নিদারুণ লজ্জা!
২০১১-র আদমসুমারি অনুযায়ী, নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পুরুষদের শিক্ষার হার যেখানে ৮২ শতাংশ, সেখানে নারীশিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ। এই হার উচ্চশিক্ষায় আরও কম। বর্তমানে কেন্দ্র সরকারের ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য— বাল্যবিবাহ রোধ ও নারীশিক্ষার প্রসার। ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পটি রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক সম্মানিতও হয়েছে।
কিন্তু শুধু সরকারি অনুদান সার্বিক নারী প্রগতি ঘটাতে পারে না, পারছেও না। দেখা যাচ্ছে, কন্যাশ্রীর টাকা পাওয়ার জন্য অনেক বাবা-মা অপেক্ষা করে আছেন। টাকা মিললেই বিয়ের আয়োজন করছেন। সুতরাং, যা শিক্ষার জন্য খরচ হওয়ার কথা, তা অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের খরচে কাজে লাগানো হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে সচেতনার অভাব ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশের অনিবার্য ফলশ্রুতি।
বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, সিনেমা, টিভির ধারাবাহিক—সব ক্ষেত্রেই আধুনিকতার মোড়কে আমরা অনেকেই পুরনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণাগুলি বহন করে চলেছি। এখনো ‘বিউটি’ বা ‘ফেয়ারনেস’ ক্রিমের বিজ্ঞাপনে গায়ের রং ফরসা না হলে মেয়ের বিয়ে বারবার ভেঙে যাচ্ছে। এখনও বিজ্ঞাপনের মেয়েটি নজর কাড়ার জন্য ফর্সা হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এখনও বাসন মাজার সাবানের বিজ্ঞাপনে গৃহিণীদেরই উপস্থিতি। অন্য দিকে, বিশেষ কোম্পানির চার চাকার গাড়ি চালাচ্ছেন পুরুষ মডেল। দিনভর সংসারে কাজ করে বৌমা ক্লান্ত হয়ে ব্যথা উপশমকারী মলমের শরণাপন্ন হচ্ছেন। কখনও আবার বিশেষ মশলা ব্যবহার করে বাড়ির জন্য রান্না করে শ্বশুরের মন জিতে নিচ্ছেন বৌমা। পুরুষেরা বিশেষ ‘ডিওডোরেন্ট’ ব্যবহার করার ফলে নারীরা তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে যাচ্ছেন। চিন্তাভাবনার এই একমাত্রিকতা ভাবাতেই পারে এখনও নারীরা যেন ভোগের সামগ্রী মাত্র, অন্তত সে ভাবেই তাকে তুলে ধরা হচ্ছে। তা সে সচতন ভাবে হোক বা অসচেতন ভাবে। এখনও অনেক সিনেমায় নারীর উপস্থিতি শুধু ‘আই ক্যান্ডি’ হিসেবে। এমনকি, লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল ভাবে ট্রোলড হতে হয় মিমি চক্রবর্তী এবং নুসরত জাহানদের।
সুতরাং, আধুনিক সভ্যতার প্রদীপের আলোর নীচেই রয়েছে গভীর অন্ধকার। সেখানে এখনও নারীরা আলোর পথ খুঁজছেন। এখনও নারী মানে কারও কন্যা, কারও স্ত্রী, কারও মা। এর বাইরে নিজের পথ খুঁজতে চেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের কুমুদিনী। বলেছিল— “এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্যেও খোওয়ানো যায় না।” রবীন্দ্রনাথের কুমুদিনী পারেনি, পথ খুঁজে পাবেন কি আগামী দিনের কুমুদিনীরা?
লেখক রঘুনাথপুর কলেজের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy