Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষক যদি পড়ুয়ার প্রতিবেশী হন, শিক্ষায় আন্তরিকতা বাড়ে?

শিক্ষার পরিসর বেড়েছে, উন্নত হয়েছে মানও। কিন্তু আন্তরিকতা কি কমেছে? কোথায় গেলেন প্যারাবোলা স্যারেরা? লিখছেন রূপক সান্যালএকটা সঙ্গত প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কোচবিহার থেকে বহু দূরবর্তী কোনও জেলায় বা সেখান থেকে কোচবিহারে কোনও শিক্ষক যদি যথাক্রমে পড়াতে যান বা আসেন, সেটা কি কোনও দোষের কাজ?

কোথায় গেলেন প্যারাবোলা স্যারেরা?

কোথায় গেলেন প্যারাবোলা স্যারেরা?

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৯ ০৬:৫৬
Share: Save:

পুরনো বইপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে হাতে উঠে এল নারায়ণ সান্যালের ‘প্যারাবোলা স্যার’। পড়েছিলাম বইটা। এই কাহিনি অবলম্বনে একটা ছবিও হয়েছিল। ছবির নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মুখটা মনে পড়তেই সেই মুখের উপর চলচ্চিত্রের মতো উপর্যুপরি ছায়া পড়তে লাগল আমার এক একজন মাস্টারমশাইয়ের। আর তখনই অনিল চট্টোপাধ্যায়, অর্থাৎ, প্যারাবোলা স্যার যেন এক থেকে বহু হয়ে গেলেন। পরবর্তী কালে একটা পাঠ শুনেছিলাম অডিও রেকর্ডিংয়ে। যার নাম ‘অবনী স্যার’। মূল বিষয় অনেকটাই কাছাকাছি। মাঝেমধ্যেই মনে হয়, এই প্যারাবোলা স্যার, এই অবনী স্যারেরা সব গেলেন কোথায়? তাঁরা এমন বিরল মানুষ হয়ে গেলেন কী ভাবে?’

এর উত্তর হয়তো কেউ দিতে পারবেন। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করেছি যে, ছেলেবেলায় কোচবিহারে আমাদের স্কুলের যাঁরা শিক্ষক ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী অথবা খুব কাছেরই কোনও অঞ্চলের মানুষ। ফলে, তাঁদের সঙ্গে একটা আন্তরিক সম্পর্ক ছিল আমাদের। সেই একই কারণে তাঁরাও শুধু তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নন, তাদের পরিবারের সঙ্গেও পরিচিত থাকতেন। প্রত্যেক শিক্ষকের পড়ানোর আলাদা কৌশল ছিল, আলাদা আলাদা ঘরানা ছিল। এক একজনের ঘরানা তো প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু পরবর্তীকালে লক্ষ করেছি যে, শিক্ষকদের অনেকেরই শিকড় এ দিককার নয়, অর্থাৎ, তাঁরা স্থানীয় নন। কোচবিহারের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের এক স্কুলে হয়তো পড়াচ্ছেন কয়েক’শ কিলোমিটার দূর থেকে আসা একজন শিক্ষক, যিনি তাঁর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পারিবারিক ভাবে পরিচিত হওয়া তো দূরের কথা, ওই তাদের অনেকের নামও হয়তো জানেন না।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এখানে একটা সঙ্গত প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কোচবিহার থেকে বহু দূরবর্তী কোনও জেলায় বা সেখান থেকে কোচবিহারে কোনও শিক্ষক যদি যথাক্রমে পড়াতে যান বা আসেন, সেটা কি কোনও দোষের কাজ? মোটেই তা নয়। কিন্তু বিষয়টা একেবারেই যুক্তি তর্কের নয়, একান্তই অনুভবের। এমন নয় যে, বর্তমান ব্যবস্থায় লেখাপড়া হচ্ছে না। হচ্ছে, নিশ্চয়ই হচ্ছে, নইলে এত ভাল ভাল ফল হচ্ছে কী করে? আবার এমনও নয় যে, সেই সময় সব পড়ুয়াই তুখোড় ছিল, সব শিক্ষকই সমান পারদর্শী ছিলেন। আসলে, ব্যাপারটা অনুভবের। শিক্ষক যদি পড়ুয়ার পাড়াপ্রতিবেশী হন বা স্থানীয় অঞ্চলের মানুষ হন, তাঁর স্নেহস্পর্শের কী রকম অনুভুতি, তাঁর ছত্রছায়ার কতটা শীতলতা, যারা সেই সময়ের ছাত্রছাত্রী, তারা নিশ্চয়ই এটা অনুভব করতে পারে। আগে অনেকেই শিক্ষককেই বলতে শুনেছি যে, তাঁরা চাকরি করতেন না, তাঁরা শিক্ষকতা করতেন।

যে শিক্ষকের কাছে আমার সাহিত্যের প্রথম পাঠ, তিনি নিজে খুব বেশি পত্রপত্রিকায় লেখালিখি করতেন না। যদিও সেই ক্ষমতা তাঁর ছিল। কলকাতার তৎকালীন একটি পত্রিকায় আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে একই পৃষ্ঠায় তাঁর রচনা দেখেছি। তাঁকে কোনও সাহিত্য অনুষ্ঠানে সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করতে বা ভাষণ দিতেও দেখিনি। বাংলা আর ইংরেজি দুই ভাষা-সাহিত্যই তিনি সব্যসাচীর মতো দু’হাতে পড়াতেন। ‘পথের পাঁচালী’ যিনি প্রথম থেকে মুখস্ত বলতে পারতেন, বাংলা সাহিত্য যাঁর নখদর্পণে ছিল, তাঁর নিজের কিন্তু কোনও লাইব্রেরি বা বইপত্রের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল না। তাঁর সংস্পর্শে কয়েকটি বছর থেকে এই ধারণাই হয়েছিল যে, তিনি যতটা সাহিত্যচর্চা করেছিলেন, সবটুকু শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদের উজাড় করে দেওয়ার জন্যই, নিজস্ব কোনও কারণে নয়।

আমাদের একজন সহপাঠী একটি গুরুতর অন্যায় করায় একজন মাস্টারমশাই তাকে বেদম প্রহার করেছিলেন। কৃষ্ণচূড়া গাছের দু’দুটো ডাল তার পিঠে সেদিন ভেঙেছিলেন তিনি। ছাত্রটি কেঁদেছিল খুব। কিন্তু তার চেয়েও আশ্চর্যের কথা, টিচার্স রুমে বসে সেই মাস্টারমশাইও শিশুর মতো কেঁদেছিলেন। সেদিন কিন্তু ছাত্রটির বাড়ি থেকে কোনও অভিভাবক ছুটে আসেননি বা কেউ থানায় যাননি অভিযোগ নিয়ে। ব্যাপারটা ওইদিন ওখানেই মিটে গিয়েছিল।

আমরা তখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র। সেদিন ছিল একজন শিক্ষকের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের দিন। স্কুল ছুটির পর ছোট একটা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সবাই একে একে তাঁর সম্পর্কে বললেন। এবার তিনি নিজে বলতে উঠলেন। বললেন কিছুক্ষণ। তারপর অঝোরে কেঁদে ফেললেন। কোনও বয়স্ক মানুষকে ও ভাবে কাঁদতে খুব একটা দেখিনি।

কিন্তু কেন এই কান্না? কেন এই আন্তরিক দুঃখ? এর কারণ মনস্তাত্বিক, না সামাজিক? আজ যদি কোনও শিক্ষককে জিজ্ঞেস করি— আর ক’বছর আছে? একটা সাধারণ উত্তর প্রায় সকলের কাছ থেকেই মেলে— ‘এবার শেষ হলেই বাঁচি!’ কিন্তু কেন এই বিতৃষ্ণা? কেন এই বিরক্তি?

এর কারণ নিশ্চয়ই সমাজবিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান করেছেন এবং করছেন। কিন্তু যাঁদের কথা আলোচনা করা হল, তাঁরা সকলেই আমাদের বাড়ির কাছাকাছি অঞ্চলের মানুষ ছিলেন। তা হলে এ বার প্রথম প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। স্কুলের শিক্ষকেরা যদি পাড়া-প্রতিবেশী বা স্থানীয় অঞ্চলের মানুষ হন, তা হলে কি তাঁদের কাছ থেকে পড়ুয়ারা বেশি কিছু পেতে পারে? শত শত কিলোমিটার দূরের কোনও জেলা থেকে যদি কেউ পড়াতে আসেন, তিনি কি পড়ুয়াদের প্রতি একই রকম টান অনুভব করবেন, যা আমরা আমাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছি?

এ প্রশ্নের কোনও একমুখী উত্তর পাওয়া সম্ভব নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু আলোচনা তো চলতেই পারে। তবে, এ কথাও ঠিক যে, অতীতের সবই ভাল আর সুন্দর ছিল এবং এখন আর কোনও কিছুই ঠিক নেই, এই ধারণাও ঠিক নয়। পিছনের দিকে তাকালে চোখে পড়ে কিছু কালো কালো দাগও। কিন্তু সে দাগের সংখ্যা ছিল হাতেগোনাই।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Education System
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE