রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কে কোনও ‘বনাম’-এর স্থান নাই। অথচ বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন সময়ে রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রী দ্বন্দ্ব বাধিয়াছে, অনেক সময়েই সেই দ্বন্দ্ব চরমে উঠিয়াছে। কেন্দ্রে ও রাজ্যে দুই প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক দলের শাসন জারি থাকিলে রাজ্যপাল প্রায়শই সেই দ্বন্দ্বের হাতিয়ারে পরিণত হইয়া থাকেন। রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত, তদুপরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিকট দায়বদ্ধ, ফলে হাতিয়ারে পরিণত হইতে তাঁহার বিশেষ আপত্তি থাকে না। শ্রীযুক্ত কেশরীনাথ ত্রিপাঠী সেই ধারা অনুসরণ করিতেছেন কি না, নরেন্দ্র মোদী তাঁহাকে আপন রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে কতখানি ব্যবহার করিতেছেন, তিনিই বা কতখানি ব্যবহৃত হইতেছেন, সেই প্রশ্ন আপাতত প্রশ্নই। তাঁহার ‘স্বাভাবিক’ তথ্যানুসন্ধানে বা পরামর্শে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁহার সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া ‘অস্বাভাবিক’ কি না, তাহাও বিতর্কেরই বিষয়। কিন্তু যে হিংস্র অশান্তি উপলক্ষে নবান্ন-রাজভবন সম্বাদ এমন মাত্রায় পৌঁছাইল তাহার চরিত্র জানাইয়া দেয়— পশ্চিমবঙ্গ বড় রকমের বিপদের মধ্যে রহিয়াছে এবং তাহার পিছনে সক্রিয় রহিয়াছে ক্ষুদ্র ও অশুভ রাজনীতির গূঢ় অভিসন্ধি।
রাজ্য বিপন্ন হইলে বিপদের মোকাবিলার দায়িত্ব প্রশাসনের। রাজ্যপাল সেই প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক প্রধান মাত্র, তাঁহার কোনও কার্যকর ক্ষমতা নাই, থাকা কাম্যও নহে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য প্রশাসকের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন কারণে তাঁহার ক্ষোভ বা অভিমান হইতেই পারে, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি সেই আবেগের কথা ঘোষণাও করিতে পারেন, সেই ঘোষণার ভাষা ও ভঙ্গি লইয়া তাঁহার অনুরাগী এবং তাঁহার বিদূষকরা অগণিত শব্দ ব্যয় করিয়া অনন্ত অবকাশ যাপন করিতে পারেন, কিন্তু শেষ অবধি মুখ্যমন্ত্রীর এক এবং একমাত্র কর্তব্য ধর্ম পালন করা। রাজধর্ম। যাহারা অশান্তি সৃষ্টি করিতেছে তাহাদের চিহ্নিত করিয়া যথাবিহিত শাস্তিবিধান এবং যাহারা অশান্তি সৃষ্টির উদ্যোগ করিতেছে তাহাদের সেই উদ্যোগ সমূলে বিনাশ— ইহাই রাজধর্মের মৌলিক দাবি। আশার কথা, মুখ্যমন্ত্রী সেই ধর্ম পালনের অঙ্গীকার করিয়াছেন।
অঙ্গীকার করিলেই চলে না, রাখিতে হয়। রাজ্যের প্রত্যেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের দাবি: কঠোর ও নিরপেক্ষ প্রশাসন। পশ্চিমবঙ্গে এই বস্তুটি অনেক দিন দুর্লভ। বামফ্রন্ট প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করিয়াছিল। নূতন জমানায় পুরানো ব্যাধিগুলি আরও গভীর ও প্রকট হইয়াছে। পূর্বে যে দলতন্ত্র ঈষৎ আড়ালে থাকিত, এখন তাহা, আক্ষরিক অর্থে, প্রকাশ্য রাজপথ শাসন করে। কিন্তু তাহার সহিত নূতন ব্যাধির প্রকোপও বাড়িয়াছে। দলীয় ক্ষুদ্রস্বার্থ রক্ষা করিতে গিয়া শাসকরা নানাবিধ গোষ্ঠীকে— গোষ্ঠী হিসাবে— প্রশ্রয় দিয়া তাহাদের বিপজ্জনক রকমের অন্যায় আচরণকেও সহ্য করিয়া চলিয়াছে। দুষ্কৃতীর কোনও ধর্ম হয় না, কোনও জাতি হয় না— রাজধর্মের এই প্রাথমিক সূত্রটি লঙ্ঘনের অভিযোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন বারংবার অভিযুক্ত। রাজ্যের অশান্ত এলাকাগুলিতে দুষ্কৃতীরা পুলিশকে তুচ্ছ করিবার যে দুঃসাহস দেখাইতেছে, তাহা ইহারই পরিণাম। পাড়ায় পাড়ায় পুলিশের পৌরোহিত্যে শান্তিবাহিনী গড়িবার প্রকল্প যথাযথ ভাবে রূপায়ণ করিতে পারিলে ভালই, কিন্তু পুলিশকে তাহার কাজ করিতে হইবে। যাহারা দাঙ্গা করে, তাহাদের কঠোর হস্তে দমন না করিলে তাহারা মাথায় চড়িয়া বসিবেই। উত্তর চব্বিশ পরগনায় তেমন দুর্লক্ষণ স্পষ্ট। রাজ্য সরকার কি অশনিসংকেত পড়িতে পারিয়াছে? সংকট চরমে পৌঁছাইলে অনেক সময় প্রশাসন সংবিৎ ফিরিয়া পায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন আরও ব্যাপক, আরও গভীর সংকটের প্রতীক্ষা করিবে, না ঘুরিয়া দাঁড়াইবে— পরীক্ষা প্রশাসনের সর্বাধিনায়িকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy