Advertisement
১১ মে ২০২৪
Elephant

হাতি নিয়ন্ত্রণে পরিকাঠামো দরকার

অত্যন্ত উত্তেজিত বা অসুস্থ না হলে হাতি শতকরা পাঁচ ভাগ ক্ষেত্রেও তাড়া করে কোনও মানুষকে মারে না। ভয় পেয়ে, অতি উৎসাহে, নিজের আজান্তে বা নেশার ঘোরে মানুষই হাতির কাছে চলে আসে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। লিখছেন সমীর মজুমদার গত এক মাসের মধ্যেই বাঁকুড়া জেলায় হাতির আক্রমণে চারজনের মৃত্যুর ঘটনা হল। এর মধ্যে রানিবাঁধের বুধুলিয়া গ্রামেই দু’জন।

প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হাতিকে উত্ত্যক্ত করা। ফাইল চিত্র

প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হাতিকে উত্ত্যক্ত করা। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:২৭
Share: Save:

গত এক মাসের মধ্যেই বাঁকুড়া জেলায় হাতির আক্রমণে চারজনের মৃত্যুর ঘটনা হল। এর মধ্যে রানিবাঁধের বুধুলিয়া গ্রামেই দু’জন। চারজনের মৃত্যুর মধ্যে রানিবাধের বুধখিলা গ্রমের বাসন্তী সিং সর্দার এবং বাঁকাদহের রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের অশোক সর্দারের মৃত্যু হয়েছে সকালে প্রাতঃকৃত সারতে গিয়ে। বাকি একজনের মৃত্যু অন্ধকারে হাতির অবস্থান বুঝতে না পেরে এবং অন্য একজন মারা গিয়েছেন নিজেরই বাড়ির দাওয়ায় হাতির সামনে পড়ে গিয়ে। সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক তবে এ ক্ষেত্রে চারটি মৃত্যুই একরকম দুর্ঘটনাবশত ঘটেছে। হাতি কিন্তু তাড়া করে মারেনি।

ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি দিয়ে দলমার হাতি বাঁকুড়া জেলায় ঢুকছে ১৯৭৪-৭৫ সালের পর থেকেই। প্রতি বছরই এর জেরে ক্ষয়ক্ষতি সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তবে প্রথম দিকে এই হাতির সংখ্যা ছিল পাঁচ-সাতটি মাত্র। তার পরে ১৯৮৭ সাল থেকে দলমার হাতি বাঁকুড়া আর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় (বর্তমান ঝাড়গ্রাম জেলা সহ) নতুন আস্তানা খুঁজে পেল। পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি, বলরামপুর আর ঝালদা বনাঞ্চলে কয়েকটি হাতি দলমা থেকে সময়-সময় আসত, তবে তাতে তেমন কোনও ক্ষতি হত না। ফলে গ্রামের মানুষের তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যেত না। কিন্তু ১৯৯০-২০১০ সাল পর্যন্ত বাঁকুড়ায় দলমার এই দল ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। এর পর ১৯৯৮-৯৯ সাল থেকে এই দলের তাণ্ডবের পরিমাণ কমতে-কমতে এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই চলছে। কিন্তু এই বছর হঠাৎ আবার দলের এক অংশ কংসাবতী নদী পেরিয়ে বাঁকুড়ায় চলে এসেছে। এই দুর্ঘটনা তার একটা কারণ।

আবার এর সঙ্গে আগের আসা দল থেকে বিতাড়িত বা দল ছেড়ে পাকাপোক্ত ভাবে বাঁকুড়ার বনাঞ্চলের থেকে যাওয়া কয়েকটি হাতি বাঁকুড়া বনাঞ্চলে রয়ে গিয়েছে। এগুলি বন দফতরের কাছে সারা বছরের আতঙ্ক। এরা এখন বাঁকুড়ার বনাঞ্চলের হাতি, স্থানীয় হাতি, এরা আর এই জঙ্গল ছেড়ে যাবে না। অর্থাৎ, এ বছর দলমার হঠাৎ চলে আসা নতুন এক দলের সঙ্গে স্থানীয় হাতির দাপাদাপি।

হাতি স্ত্রীতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় পরিচালিত। এক একটি দলে থাকে। একটি দলে ৮-৪০টি বা তার বেশি নানা বয়সের হাতি থাকে। দলে মাঝ বয়সি বা তার একটু বেশি বয়সের পুরুষ দাঁতাল হাতিরা দলকে নেতৃত্ব দেয়। দলে কোনও যুবক পুরুষ হাতি বেয়াদপি করলে তাকে দলের দলপতি দাঁতাল হাতি দল থেকে তাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় দলের মধ্যে উঠতি পুরুষ হাতি দলের নিয়ম না মেনে দল ছেড়ে চলে যায়। প্রতি বছরই একটি বা দু’টি পুরুষ হাতি দলের সঙ্গ ত্যাগ করে এবং একা-একা তাদের পছন্দসই জঙ্গলে ঘুরতে থাকে। তারা আর তাদের আদি বাসস্থান দলমায় ফেরত যায় না। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায় এই রকম হাতির সংখ্যা ২২টির বেশি। এরা একা-একা বা দুই-তিনজন এক সঙ্গে এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। এরাই বন দফতরের কাছে দক্ষিণবঙ্গের আতঙ্ক। এরা কয়েক বছর পর স্থানীয় হাতি নামে পরিচিত হয়ে যায়। এই স্থানীয় হাতি ধীরে-ধীরে তার জৈবিক ক্রিয়া পরিচালনার জন্য বিস্তীর্ণ জঙ্গলের এলাকার পথ-ঘাট সব চিনে ফেলে। শীতে, গ্রীষ্মে বা যখন মাঠে ফসল-আনাজ থাকে না তখন তাঁরা খাবারের খোঁজে রাতের অন্ধকারে হানা দেয় লোকালয়ে, খামারে, স্কুলে, রাস্তায়, গোডাউনে সর্বত্র। তা ছাড়া এই সব স্থানীয় হাতির খাদ্যাভাসেরও ধীরে-ধীরে পরিবর্তন হতে থাকে। তাদের বিপুল দৈনন্দিন খাবারের পরিমাণ প্রায় ১০০-১৪০ কেজি এবং পানীয় জল ১৫০ লিটারের মতো। হাতির ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তি প্রবল হওয়ায় তারা বহুদূর থেকে খাবারের গন্ধ পেয়ে যায়। তারপর রাতের অন্ধকারে চুপি-চুপি চলে আসে খাবারের উৎসের কাছে। হাতির গায়ের রং-এর জন্য সামান্য অন্ধকারেও বিশালাকায় দেহের হাতিকে সামনে থেকে দেখা যায় না। তা ছাড়া হাতি চুপিসারে দ্রুত যে ভাবে স্থান পরিবর্তন করতে পারে মানুষ সেটা বুঝতেই পারে না।

অত্যন্ত উত্তেজিত বা অসুস্থ না হলে হাতি শতকরা পাঁচ ভাগ ক্ষেত্রেও তাড়া করে কোনও মানুষকে মারে না। ভয় পেয়ে, অতি উৎসাহে, নিজের আজান্তে বা নেশার ঘোরে মানুষই হাতির কাছে চলে আসে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। মদ বা নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি হাতির টান প্রবল বলেই সামান্য গন্ধে তারা আকৃষ্ট হয় এবং দেখা গিয়েছে হাতির আক্রমণে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে শতকরা চল্লিশ ভাগ মানুষ নেশা করেছিলেন। সেই কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

শতকরা চল্লিশ ভাগ বা তার বেশি মানুষ অন্ধকারে হাতির উপস্থিতি বুঝতে না পেরে হাতির কাছের চলে যায় এবং পরিণতি হয় মৃত্যু। স্থানীয় হাতি কোথাও আগুন বা বহু মানুষের উপস্থিতি বুঝলে হয় ওই স্থান এড়িয়ে যায়। না হয় ঝোপে-জঙ্গলে বা আশেপাশে চুপ করে অপেক্ষা করে। এই সময় হাতির অবস্থান বুঝে সাবধান না হলে বিপদ ঘটে এবং এইরকম পরিস্থিতিতে সাবধান না হওয়ার ঘটনাই মৃত্যুর এক কারণ। সব ক্ষেত্রেই অসাবধানতার মাসুল দিতে

হয়েছে আক্রান্তদের।

হাতিকে মানুষ তাড়াচ্ছে, বন কর্মীরা তাড়াচ্ছে, ফসল বাঁচাতে গ্রামবাসী তাড়াচ্ছে, অনেকে মজা করে তাড়াচ্ছে ফলে হাতি ছুটছে এক দিক থেকে অন্য দিকে। কেউ কারও নিয়ন্ত্রণে নেই। হাতি কোথায় যাবে কেউ জানে না। তারা ছড়িয়ে পড়ছে নানান জঙ্গলের চারিদিকে, ঘন অন্ধকারে। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। অঘটনও ঘটছে এই কারণে। এই কারণে হাতির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে ধারণা অনেক সময় অনেকেরই ধাকে না। হাতির অবস্থান জানা থাকলে এই সব দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যায়। শহরে, শহরতলিতে বা গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রতিক যে অঘটন ঘটে যাচ্ছে তার কারণ নিহতের হাতির অবস্থান জানা ছিল না। হাতি ছুটে এসে তাকে মারেনি বরং সেই হাতির সামনে ভুলবশত হাতির অবস্থান বুঝতে না পেরে রাতের অন্ধকারে পৌঁছে গিয়েছিল বা হাতি তার খাবারের সন্ধানে এলে তারা সামনে পড়ে গিয়েছিল। এমন ঘটনাই বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যুর কারণ।

এ ছাড়া হাতির হাঁড়িয়া মদ বা নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি আর্কষণ থাকায় তারা নেশার দ্রব্যের ঘ্রাণে উৎসের কাছে ছুটে যায়। উৎস যদি মানুষের দেহ হয় তবেই ঘটে অঘটন। নেশাগ্রস্ত মানুষও নেশায় ঠাহর করতে পারে না হাতির অবস্থান যার ফলে ঘটে বিপদ। জঙ্গল সংলগ্ন অনেক গ্রাম আছে যেখানে হাতি বারবার এলেও একটি-দুটি ঘটনা ছাড়া হাতির আক্রমণে কোনও আহত বা নিহত হবার ঘটনা নেই। এর কারণ এই সব গ্রামের মানুষ নিজেদের সাবধানতার জন্য আগে ভাগেই সব রকম সাবধানতার প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। বন দফতরের বহু সচেতনতা শিবির থেকে তারা জানে কী ভাবে হাতির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা যায়। বন দফতর নানা পরিবর্তিত কারণে আর পরিকাঠামোর অভাবের ফলে তাদের দায়সাড়া বেশ কিছু কাজের জন্যই কিছু বিপদ ঘটছে। কিন্তু শুধু বন দফতরের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধানে দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও পরিকাঠামো। তার আগে জঙ্গল সংলগ্ন মানুষকে দুর্ঘটনা এড়াতে নিজেদের সাবধান হতে হবে।

আবসরপ্রাপ্ত বন আধিকারিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elephant Elephant Attack Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE