Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
দলিতের মনোরঞ্জন, উচ্চবর্ণের ক্ষমতা-লালন

শুধু দলিত হলেই কি চলে?

দলিত পাসি সম্প্রদায়ের রাজা হয়েও নাকি সুহেল দেব উচ্চবর্ণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সরকারি ইতিহাসবিদরা অনেক খেটেখুটে এই ‘তথ্য’ বার করেছেন। ‘ইতিহাস’ বলছে তিনি নাকি গরুদেরও মুসলিম অভিযানের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন!

পরশপাথর: (বাঁ দিক থেকে) রামনাথ কোবিন্দ, লালকৃষ্ণ আডবাণী, নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। দিল্লি, ২৩ জুন। এএফপি

পরশপাথর: (বাঁ দিক থেকে) রামনাথ কোবিন্দ, লালকৃষ্ণ আডবাণী, নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। দিল্লি, ২৩ জুন। এএফপি

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৭ ১২:৩৫
Share: Save:

রামনাথ কোবিন্দ আর মহারাজা সুহেল দেব-এর মধ্যে মিল কোথায়? প্রথম জন হয়তো রাইসিনা প্যালেসে অভিষিক্ত হতে চলেছেন। আর দ্বিতীয় জন? একাদশ শতকের এই রাজার ছবি এখন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারি মহলের যত্রতত্র, অম্বেডকর, সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ ইত্যাদি রথী-মহারথীদের সঙ্গে এক সারিতে শোভিত, এমনকী লখনউ-এর অম্বেডকর পার্কে তাঁর স্ট্যাচু বসানোর তোড়জোড়। এক জনকে বিজেপি নিয়ে এসেছে অতীত খুঁড়ে, আর অন্য জনকে বর্তমান খুঁড়ে। তাই তো আমরা জানলাম আদ্যন্ত অপরিচিত হলেও এঁরা কত ‘মহৎ’ আইকন, এক জন স্ট্যাচু-যোগ্য, অন্য জন প্রেসিডেন্ট-যোগ্য! দুই জনেই দলিত হয়েও ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম রক্ষার আদর্শে আত্মনিবেদনকারী মহাযোদ্ধা!

দলিত পাসি সম্প্রদায়ের রাজা হয়েও নাকি সুহেল দেব উচ্চবর্ণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সরকারি ইতিহাসবিদরা অনেক খেটেখুটে এই ‘তথ্য’ বার করেছেন। ‘ইতিহাস’ বলছে তিনি নাকি গরুদেরও মুসলিম অভিযানের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন!

আর অন্য জন দস্তুরমতো দুই বার রাজ্যসভার সাংসদ, বিহারের রাজ্যপাল। আর তার পিছনে তিনি হিন্দু ধর্মের দিকপাল সেনাপতি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পরমব্রতী সাধক। আরও একটু তদন্তে জানা যাবে তাঁর ব্রতসাধনার রূপটি। হিন্দুত্বের উন্নতিকল্পে ইনি ২০১০ সালে বলেছিলেন তফসিলি জাতি-জনজাতির মধ্যে যত ধর্মান্তরিত মুসলিম ও খ্রিস্টান— তাঁদের গুনতি থেকে একদম বাদ দেওয়া উচিত, কেননা তাঁরা ভেজাল। বলেছিলেন, মুসলিম আর খ্রিস্টানরা মোটেই ভারতের মাটিতে সংরক্ষণ পাওয়ার যোগ্য নন, কেননা তাঁরা ধর্মগত ভাবে ‘অভারতীয়’! সুপ্রিম কোর্ট সেই সময় অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের পশ্চাৎপদ মুসলিমদের জন্য ৪ শতাংশ সংরক্ষণের দাবি সমর্থন করে একটি রায় দিয়েছিল। সেই প্রসঙ্গেই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর এই অমোঘ উক্তি, হিন্দু ধর্মকে ম্লেচ্ছ ছোঁওয়া থেকে বাঁচানোর বীরোচিত চেষ্টা! দুই আইকনের মিলটা তা হলে পরিষ্কার। হিন্দু ভারত তৈরিতে দুই নেতার উপযোগিতাই আকাশ-ছোঁওয়া। আঁকশি দিয়ে টেনে টেনে তাই এঁদের আবিষ্কার।

আসলে নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহরা জানেন, দলিত আইকন খুঁজে বার করা কত হ্যাপা-র ব্যাপার। এ দিকে দলিতদের দিকে মনোযোগ না দিলে চলেই বা কী করে। হিন্দুত্বের রথটা পোক্ত করতে হলে দলিতদের পাশে চাই-ই। বিশেষত উত্তর-মধ্য ভারতের কতগুলি রাজ্যে, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, বিহারে। কে না জানে, এই রাজ্যগুলোতেই আছে দিল্লির ক্ষমতার সোনার কাঠি রুপোর কাঠি। ঘটনা হল, গোবলয়টাই দলিত-বলয়, সেটাই আবার ক্ষমতা-বলয়। গো-রক্ষকও হতে হবে, গো-ভক্ষক দলিতদেরও পাশে টানতে হবে। সব মিলিয়ে বিজেপির কাজটা— উঁহু, সহজ নয়।

গত তিন বছর ধরে বার বার বিজেপি বুঝেছে, তাদের সত্যিকারের সংকটে ফেলতে পারে দলিতরাই, মুসলিমরা নয়। ভারতের জনসংখ্যাটাই এমন ভাবে ছড়ানো যাতে দলিতরাই এক দিন হিন্দু সমাজের ভোটের কাঁটা হয়ে উঠতে পারে। এই দলিতরা তফসিলভুক্ত জাতি-উপজাতির মধ্যেই পড়েন, ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ। স্বাধীন দেশের বয়স সত্তর হল, তবু এই বিরাট দলিত জনতার তিন-চতুর্থাংশের বেশি এখনও থাকে গ্রামীণ অঞ্চলে, ৮৪ শতাংশ পড়ে দারিদ্রসীমার নীচে। আইনমতে এসসি-এসটি’র জন্য যে সুরক্ষাব্যবস্থা, অর্থাৎ সংরক্ষণ— মণ্ডল কমিশনের তিন দশক পরে পরিষ্কার যে তার বিশেষ কিছুই দলিতরা পায় না, প্রায় সবটাই যায় এসসি, এসটি’দের উপরের কিছু গোত্রের কাছে। দুধের সরের মতো এই অংশের নাম ওবিসি বা অনুন্নত পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়। গত কিছু দশক ধরে এঁরা গ্রাম-ভারতের জমিজমার অনেকটারই মালিক হয়ে বসেছেন, বিকেন্দ্রিত ক্ষমতাব্যবস্থায় নেতা-মাতব্বর হয়েছেন, এবং অকাতরে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের থেকে যাঁরা সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে নিচু, সেই দলিত সমাজের উপর।

মুশকিল হল, সবার পিছে সবার নীচে দলিতদের কিছুই নেই, কেবল আছে একটা মহাসম্পদ— ভোটাধিকার। বোঝো! এদের খুশি না করে চললে হবে? ২০০৯ সালে বিজেপি পেয়েছিল ১২ শতাংশ দলিত ভোট, ২০১৪ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ২৪ শতাংশ। ২০১৯-এ হিসেবটা আরও একটু না বাড়ালেই নয়। ফট করে আবার না মুসলিম-দলিত হাত মিলিয়ে বসে, তাও দেখতে হবে। তাই ‘খুশি’ করার চেষ্টা চলছে অনেক দিনই। অথচ রাশটা যেন এখনও ঠিক ধরা যাচ্ছে না। ক্ষমতায় এসে প্রথমেই স্ট্যাচু অব লিবার্টির থেকেও উঁচু অম্বেডকরের প্রতিমূর্তি বানানোর ধুম লাগিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তবু তাঁর নিজের রাজ্যেই ঘটল উনা। গোচর্ম নিয়ে কারবারের অভিযোগে দলিতদের পিটিয়ে মারতেই তারা খামকা তেলেবেগুনে জ্বলে গেল, রাজ্যটাকেই জ্বালিয়ে দেওয়ার জোগাড়। এখনও সেই আগুন পুরোপুরি নেবেনি। আবার, উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন আসার কত আগে থেকেই অমিত শাহের কাপ্তেনগিরিতে সে রাজ্যে দলিত-মনোহরণ যজ্ঞ মহাসমারোহে চলেছে, অথচ এখনও দলিতবিদ্রোহের শেষ নেই। এই সে দিনও গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দুই হাজার দলিত গ্রহণ করল বৌদ্ধ ধর্ম। নালিশ করল, হিন্দুবাদীদের পিটুনি আর অত্যাচারেই চোটেই নাকি এই সিদ্ধান্ত।

বিজেপির হয়েছে মহা জ্বালা। এক দিকে হিন্দুত্ববাদী উচ্চবর্ণ অস্পৃশ্য দলিতদের ধনে-প্রাণে শেষ করতে পারলে বাঁচে, অন্য দিকে হিন্দুত্ববাদী ভোটসর্বস্ব নেতারা দলিতদের বুকে টেনে ‘আয় ভাই’ বলতে চায়। হাজার বিক্ষোভ করলেও এই দলিতদের না পারা যায় গিলতে, না পারা যায় উগরাতে। ঝামেলা কি কম? বিজেপির দলিত মোর্চার প্রাক্তন নেতা সঞ্জয় পাসোয়ানকেই ধরা যাক। ২০১৬-র জুনে তিনি দলকে ভারী একটা কড়া বার্তা দিলেন— বললেন, ‘সিটিং, ইটিং, মিটিং’-এর রাজনীতি ছাডুন, আর একটু কিছু করুন, কাঁসিরাম বা জগজীবন রামের নীতি মাথায় রাখুন, ‘চ্যারিটি’ নয়, ‘প্যারিটি’ চাই! তার পর মাত্র তিনটি মাস। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরেই ডিগবাজি খেয়ে মোদীর দলিত নীতি দলিত প্রীতির ভূয়সী প্রশংসা সঞ্জয়বাবুর মুখে, ওঃ, মোদী হলেন সাক্ষাৎ মসিহা!

দলিত নিয়ে বিজেপির ‘ঝামেলা’টা বুঝলেই রামনাথ কোবিন্দকেও বোঝা যাবে, আইকন তৈরির চ্যালেঞ্জটাও বোঝা যাবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইডেন্টিটি পলিটিকস টেনে আনাটা প্রথম ধাপ, দ্বিতীয় ধাপ একই সঙ্গে সংখ্যাগুরুর রাজনীতিটা আরও শক্ত করা। একই মারে দলিতমনেরও রঞ্জন, উচ্চবর্ণ ইগোর তোষণ, উচ্চবর্ণ ক্ষমতার লালন। দলিত নেতা তো কতই আছেন। নেত্রীও আছেন। কিন্তু সব দলিতই কি আরএসএস ছাপ্পা-ধন্য? বিরোধী দল যতই পাল্টা দলিত মুখ মীরা কুমারকে পেয়ে নাচানাচি করুন, বিজেপির কি ওঁকে দিয়ে চলত? দেয়ার আর দলিতস অ্যান্ড দলিতস, হাজার রকম দলিত নীতি আর রাজনীতি। অম্বেডকরের স্ট্যাচু না-হয় না বানিয়ে উপায় নেই, কিন্তু অম্বেডকরের দেখানো পথে যে দলিতরা চলেন, তাঁরা যে মহা সাংঘাতিক, সেটাও তো মাথায় রাখতে হবে। সার্বিক সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরীণ নির্যাতন, ও সব বড় বড় কথার ফাঁদে পা দিলেই হয়েছে আর কী। হিন্দুত্ব-রথের চাকাটাই শেষে মুড়মুড়িয়ে ভাঙবে।

তাই চোনা বেছে বেছে শেষ পর্যন্ত ‘ঠিক’ নেতাকে তুলে নেওয়া হল। রাষ্ট্রপতি বাছতে মোদীতান্ত্রিকদের ক’দিন বিস্তর মাথা ঘামাতে হল। ভাগ্যিস কোবিন্দ ছিলেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE