Advertisement
E-Paper

অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক

‘সিডিশন’ বস্তুটি এ দেশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই উপহার দিয়া গিয়াছে। এ দেশের শাসকরা এখনও প্রত্যাশা করেন, উপনিবেশ থাকাকালীন ‘সিডিশন’-এর ভয়ে সমস্ত পরাধীন ভারতীয় যেমন ভয়ে কাঁপিতেন, বর্তমান ভারতীয় নাগরিকও তেমনই বুঝিবেন, তেমনই ভয়ে সিঁটাইয়া থাকিবেন।

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

সপ্তদশ শতকের গোড়ার ইংল্যান্ডের সহিত একবিংশ শতকের ভারতের নিকটত্ব কতখানি? ইতিহাসে অনাগ্রহী ব্যক্তিও প্রত্যয়ের সহিত ইহার উত্তর দিবেন। ইংল্যান্ডে তখনও গণতন্ত্রের পাট শুরু হয় নাই। এ দিকে একুশের ভারত গণতন্ত্রের জমিতে পা দিয়া সাত-সাতটি দশক পার হইয়া আসিয়াছে। তবে কি না, প্রভূত বৈসাদৃশ্যের মধ্যে একটি বিরাট সাদৃশ্য চোখ এড়াইবার নহে। সে কালের কোঁকড়ানো স্বর্ণালি পরচুলা-শোভিত, সুদীর্ঘ তরবারি-দৃপ্ত, স্বর্ণপদকলাঞ্ছিত রক্তিমবর্ণ কোট-পরিহিত, চার্চের সহিত ক্রমাগত ক্ষমতার টক্করে ব্যাপৃত ইংরেজ রাজপুরুষও রাষ্ট্রবিরোধিতা বলিতে যাহা বুঝিতেন, আজকের ভারতের গণতন্ত্র-প্রদীপ্ত রাষ্ট্রের নাগরিকদেরও ঠিক তাহাই বুঝিতে হয়। সেই সাড়ে চার শত বৎসর আগেকার আইনটি অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলিতে হয়। স্বভাবতই এই আশ্চর্য হাস্যকর কাণ্ডের কারণ নিহিত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদে। ‘সিডিশন’ বস্তুটি এ দেশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই উপহার দিয়া গিয়াছে। এ দেশের শাসকরা এখনও প্রত্যাশা করেন, উপনিবেশ থাকাকালীন ‘সিডিশন’-এর ভয়ে সমস্ত পরাধীন ভারতীয় যেমন ভয়ে কাঁপিতেন, বর্তমান ভারতীয় নাগরিকও তেমনই বুঝিবেন, তেমনই ভয়ে সিঁটাইয়া থাকিবেন। ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ হইতে ‘নেশন-স্টেট’ যখন আধুনিক যুগের দেবতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, এবং ‘সিডিশন’ কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহ ওই দেবতার বিপরীতে অসুর হিসাবে চিহ্নিত হয়, আজিকার ভারতও সেই ব্যবস্থাই মানিয়া চলিবে। বাস্তবিক, ব্যাপার দেখিয়া বিস্ময়ে গালে হাত দিয়া বসিতে হয়, কেননা যে দেশে এই আইনের জন্ম, সেই ইংল্যান্ডেই ইতিমধ্যে আইনটি বাতিল হইয়াছে।

সুতরাং গত সপ্তাহে দেশের ল কমিশন যখন এই ধারা বিষয়ে পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিল, ভারত প্রগতির দিকে এক পা অগ্রসর হইবার সুযোগ পাইল, এমন বলিলে অত্যুক্তি হয় না। স্বাধীন ভারতের প্রণম্য সংবিধানপ্রণেতারা গভীর অন্তর্দৃষ্টির সহিত সংবিধান নামক দিগদর্শক নথিটি তৈরি করিয়া তুলিয়াছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তত ‘স্বাধীন’ ভাবনার প্রকাশ ঘটে নাই, ইহাও ঠিক। দেশের প্রায় সাত-আটটি আইন এখনও পুরাতন ব্রিটিশ আইনগুলির অপ্রয়োজনীয় ধারক-বাহক। তাহাদের মধ্যে প্রধান— রাষ্ট্রদ্রোহ বিষয়ক আইন বা ১২৪-এ ধারাটি। ল কমিশনের মতে, রাষ্ট্রের স্বার্থের দিক হইতে কোনও কাজ বা কথা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হইলেও তাহাকে ঠিক রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে ফেলিয়া কঠিনতম শাস্তির লক্ষ্য করা যায় না। তাহার কারণ, যে সরকার রাষ্ট্রের কাজকর্ম চালাইতেছে, রাষ্ট্রের স্বার্থের দোহাই দিয়া তাহারা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’র ব্যাখ্যা করিতে পারে। সরকারি নীতির বিরোধিতাও তখন রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য অপরাধ হিসাবে প্রতিভাত হইতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি জাস্টিস চহ্বনের বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেমনই গুরুতর ইহা স্মরণে রাখা যে, সিডিশন বস্তুটি মুক্তচিন্তা বা বাক্‌স্বাধীনতার নীতিটির সঙ্গে এতটুকুও সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে। যে সময়ে সিডিশন আইনের জন্ম, রাষ্ট্রের বিপ্রতীপে ব্যক্তির অধিকারের ধারণাটি তখন বিকশিতই হয় নাই মোটে। অথচ বাক্‌স্বাধীনতার নীতি সর্বার্থেই গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি। রাষ্ট্র অর্থাৎ সরকারের বিরোধিতাও সেই বাক্‌স্বাধীনতার মধ্যেই পড়িতে পারে। সাম্প্রতিক ভারতে ল কমিশনের এই বক্তব্যের মূল্য অসীম। সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক বা নৈতিক যে কোনও অবস্থানকেই যখন রাষ্ট্রের বিরোধিতা কিংবা জাতীয় স্বার্থের বিরোধিতা বলিয়া চালানো হইতেছে— প্রাক্তন বিচারপতির বক্তব্য দেশব্যাপী নাগরিক সমাজকে নূতন আশায় বুক বাঁধিতে সাহায্য করিবে।

Sedition Law Commission of India IPC 124A
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy