—ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে আইনজীবীদের কর্মবিরতি অব্যাহত। কলিকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং উদ্যোগী হইয়াছেন, দৃশ্যতই তাহাতেও আইনজীবীদের আস্থা নাই। তাঁহারা কাজ বন্ধ করিয়া, সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করিয়া ন্যায়বিচারের দাবি জানাইতেছেন। বিচারব্যবস্থার প্রতি, উচ্চ ন্যায়ালয়ের প্রতি এ হেন অনাস্থাপ্রস্তাব পেশ করিতেছেন আইনজীবীরা, যাঁহারা প্রত্যহ বিচারপ্রার্থীদের প্রতিনিধি হিসাবে সেই আদালতেই সওয়াল করেন। ইহাতে যে অস্বাভাবিকতা আছে, আইনজীবীরা তাহা দেখিতে পাইলেন না— তাহা আশ্চর্যের। অথবা, নহে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় ভরসা না রাখিতে পারা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞান। প্রত্যেকেই নিজের মতো করিয়া সমস্যার সমাধান করিয়া লইতে চাহেন। তবে, অন্যান্য পেশার মানুষের সহিত তাঁহাদের যে ফারাক আছে, আইনজীবীরা কথাটি স্মরণে রাখিতে পারিতেন। তাঁহাদের দাবি যদি সম্পূর্ণ ন্যায্যও হয়, তবুও প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তটির জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল। কর্মবিরতির সিদ্ধান্তটি দুর্ভাগ্যজনক।
কর্মবিরতি অথবা ধর্মঘট, বন্ধ, এগুলি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে এমনই বহুলব্যবহৃত যে, কেহ আর তাহার অর্থ ভাঙিয়া দেখিবার চেষ্টাও করেন না। কাজ বন্ধ করিয়া নিজেদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করিবার ‘অধিকার’টি ঐতিহাসিক ভাবে শ্রমিকের। সেই ‘অধিকার’ আদৌ কাহারও থাকা উচিত কি না, তাহা জটিলতর প্রশ্ন। সেই তর্ক অন্যত্র। কিন্তু, ‘অধিকার’টি আদৌ কাহারও থাকিলে তাহা শ্রমিকের। বেতনের বিনিময়ে পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় জড়িত শ্রমিকের সহিত পুঁজিপতির সম্পর্কটি দাঁড়াইয়া আছে উদ্বৃত্ত উৎপাদনের বণ্টনের জমিতে। অর্থাৎ, উত্তর-মার্ক্সবাদী তত্ত্বের ভাষায় বলিলে, সেই সম্পর্ক একটি বিশেষ শ্রেণিপ্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ার কোনও একটি মুহূর্তে অভিঘাত সৃষ্টি করিতে চাহিলে কর্মবিরতি হয়তো শেষ পন্থা হইয়া দাঁড়াইতে পারে। কিন্তু, আইনজীবীরা স্বাধীন পেশাদার। তাঁহাদের পরিষেবা ক্রয় করেন মক্কেলরা, এবং তাহার ব্যবহার ঘটে আদালতের পরিসরে। লক্ষণীয়, যে অশান্তিকে কেন্দ্র করিয়া আইনজীবীরা এই দীর্ঘ কর্মবিরতি পালন করিয়া চলিতেছেন, যে ছুতায় সাংবাদিকদের উপর চড়াও হইতেও বাধে নাই, তাহাতে কিন্তু মক্কেলরাও নাই, আদালতও নাই। এক্ষণে প্রশ্ন করা প্রয়োজন, পরিষেবাটির উৎপাদন বন্ধ করিয়া আইনজীবীরা কাহার সহিত লড়াই করিতেছেন? হাওড়া আদালত চত্বরে যাঁহাদের সঙ্গে তাঁহাদের সংঘাত বাধিয়াছিল, সেই পুলিশ ও সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার অথবা পুরকর্মীদের ঠিক কোথায় ধাক্কা দিতেছে এই ধর্মঘট? এই প্রশ্নের দুইটি উত্তর হইতে পারে। এক, কর্মবিরতি নামক বিপজ্জনক অস্ত্রের দর্শন সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ভিন্নই আইনজীবীরা তাহা চালাইয়া দিয়াছেন। দুই, এই কর্মবিরতির মাধ্যমে তাঁহারা কলিকাতা হাইকোর্টের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে চাহেন। যে আইনজীবীরা নাগরিক সমাজের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, তাঁহাদের পক্ষে কোন উত্তরটি অধিকতর লজ্জার, তাঁহারাই বিবেচনা করিবেন।
আইনজীবীদের কর্মবিরতিতে স্বভাবতই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ। দেশের সব আদালতেই বকেয়া মামলার তালিকা সুদীর্ঘ। পশ্চিমবঙ্গের আদালতগুলিও ব্যতিক্রম নহে। সেই লাইন অতিক্রম করিয়া মামলা যদি এজলাসে উঠেও, হরেক কারণে তাহা ফের দীর্ঘসূত্র হয়। আইনজীবীরা এই পরিস্থিতির কথা বিলক্ষণ জানেন। ইহাও জানেন, মে মাসেই আদালতে গ্রীষ্মাবকাশ। কিন্তু, সেই বিবেচনা কর্মবিরতির সিদ্ধান্তটিতে প্রভাব ফেলিতে পারে নাই। অনুমান করা চলে, রাজনীতির প্রাথমিক পাঠটি তাঁহারা শিখিয়া লহিয়াছেন। বুঝিয়াছেন যে মানুষের যথেষ্ট অসুবিধা ঘটাইতে না পারিলে ‘আন্দোলন’ হয় না। দুর্ভাগ্য, এ হেন অন্যায় আচরণের সাক্ষী থাকিতে হইল ন্যায়ালয়কেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy