শুভনীল চৌধুরীর ‘সেই সত্য, যা রচিবে তুমি’ (২৯-৭) শীর্ষক প্রবন্ধ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধকার তাঁর লেখায় ‘তথ্য’ সম্পর্কে কঠিন বাস্তবকে তুলে ধরেছেন। এটা তথ্য বিস্ফোরণের যুগ। প্রতি মুহূর্তে বিশ্ব জুড়ে এত তথ্যের উৎপত্তি হচ্ছে যে, তার মধ্যে কোনটি ঠিক, কোনটি ভুল, তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তা ছাড়া, এই সব তথ্যের সংগ্ৰহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং পাঠকের কাছে সঠিক পদ্ধতিতে পরিবেশনের কাজটিও ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আপাতভাবে আমরা সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যম থেকে যে সব তথ্য পাচ্ছি, সেগুলো ঠিক না বেঠিক, তার মাপকাঠি আমাদের কাছে নেই। বর্তমানে বহু মিথ্যাকেই কৌশলে সত্যের মোড়কে সুন্দর ভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে, যাতে সেগুলি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে। যেমন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হাজার অন্যায় করেও ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’-এর জন্য সুপারিশ পান। আর সেই সুপারিশ করেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, যাঁর কারণে আজ গাজ়া চরম মানবিক সঙ্কটে আক্রান্ত। আমেরিকাকে নিয়ে আবেগ, নাগরিকদের জন্য উদ্বেগ, পৃথিবীর বুকে আমেরিকাকে আবার ‘মহান’ করার তাগিদ— ভোটে জেতার জন্য এগুলি ছিল ট্রাম্পের তুরুপের তাস। যিনি এক সময় কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং অন্যান্য দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তিনিই আজ ওই দেশের প্রেসিডেন্ট। তাঁর চূড়ান্ত নারীবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, জাতি ও ধর্মবিদ্বেষ তাঁর কথার ভিতর দিয়েই মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম সমস্যা। অথচ, ট্রাম্প এগুলোকে মোটেই পাত্তা দেন না। এ বিষয়ে তাঁর বেলাগাম, বেপরোয়া, নিয়ন্ত্রণহীন মনোভাব সকলের জানা। প্রকাশ্যে তিনি বহু বার বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তন ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়।” ঠিক তেমনই পরমাণু যুদ্ধের বিষয়েও তিনি বেপরোয়া। তাঁর প্রথম চার বছরের জমানায় আমেরিকায় অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ, সমকামীদের উপর চূড়ান্ত অত্যাচার হয়েছে। এ বারেও তার অন্যথা হচ্ছে না। ট্রাম্পের জয় মহিলাদের সুরক্ষার উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে।
শুধু তা-ই নয়, তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে আমেরিকা-সহ বহু দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদের রমরমা বাড়ছে। যে দেশের অর্থনীতি অনেকাংশে যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রির উপর নির্ভরশীল, সে যে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগানোর খেলায় মাতবে— এটাই তো স্বাভাবিক। বর্তমানের আমেরিকা সেই পথেই হাঁটছে। আর এমন এক দেশের প্রেসিডেন্টকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার জন্য সুপারিশকে তাঁর প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্য প্রকাশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি?
গৌতম পতি, কুলবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
ধ্বংসলীলা
শুভনীল চৌধুরীর ‘সেই সত্য, যা রচিবে তুমি’ প্রবন্ধটির শিরোনাম কাব্যিক, বড় তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী। লক্ষণীয়, সমগ্র বিশ্ব আজ যে পথে ভেসে চলেছে, তার অন্তরালে প্রতি পলে রচিত হচ্ছে বীভৎস সব খণ্ড খণ্ড ছবি। সেই বিষয়ে দু’চার কথা বলা আবশ্যক। বলা বাহুল্য, আজ ভুয়ো তথ্য আর মিথ্যার বেসাতি চলছে দুনিয়া জুড়ে। তথ্য সরবরাহকারীর সংখ্যা বেড়েছে, তাই তাঁরা টিকে থাকতে সঠিক তথ্য পরিবেশন করছেন না। উপভোক্তাদের হাতে আসছে রাংতামোড়া সত্য-মিথ্যার রসদ। জোগানদাররা সমাজমাধ্যমকে পাথেয় করে নানান বেশে উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন ছলে বলে কৌশলে। আর উপভোক্তারা তার সত্য-মিথ্যা যাচাই করছেন না। এই সূত্রে প্রবন্ধের শিরোনাম-সহ রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতার পরের অংশটুকু দেখে নেওয়া যাক— “সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/ রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।” তাই তো সত্য-মিথ্যে জড়িয়ে ভুয়ো আখ্যান রচনা করতে শাসকদের জুড়ি মেলা ভার। এমন রং মেশানো তথ্য দেখতে ও শুনতে কার না ভাল লাগে। আর এই মিথ্যা সত্য হয়ে উঠছে বেতনভুক বুদ্ধিজীবীদের কলমের খোঁচায়। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিস্ট শক্তি চিরকাল নিজেদের অনুকূলে আখ্যান নির্মাণ করে কলমওয়ালা বা বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায়। তাতে আমজনতাকে বিপথে চালনার পথ প্রশস্ত হয়।
সেই কারণেই প্যালেস্টাইনের উপর ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলাকে যুদ্ধবাজ ইজ়রায়েল প্রচারে আনতে চাইছে তাদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ হিসাবে; যেন প্যালেস্টাইনের আত্মরক্ষার কোনও অধিকার নেই। এখনও পর্যন্ত সেখানে প্রায় সত্তর হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে শিশু ও মহিলার সংখ্যাই বেশি। সারা বিশ্ব দেখছে এই বিরামহীন রক্তস্রোত। আর এই যুদ্ধের জেরে আজ অঞ্চলটি দুর্ভিক্ষের কবলে। ঠিক তেমনই ইরানের উপর আমেরিকার আক্রমণকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাউর করেছেন ‘গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য যুদ্ধ’ হিসাবে। এ দিকে, রাশিয়া ইউক্রেনকে আক্রমণ করলে তিনি তাকে দিচ্ছেন ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’-র আখ্যা। যুদ্ধ যে অন্যায়, বর্বরতার নির্লজ্জ আস্ফালন, সে কথা কোনও দিনই বলেননি তিনি। অথচ, এই মানুষটিই ভারত-পাকিস্তান এমনকি ইজ়রায়েল-ইরানের যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে গলা ফাটিয়েছেন বারংবার। তা হলে গাজ়ায় চরম মানবিক সঙ্কট দেখেও ইজ়রায়েল-কে যুদ্ধ থামাতে চাপ দিচ্ছেন না কেন তিনি?
এ বার তাঁর চোখ পড়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কারের দিকে। আশ্চর্যজনক ভাবে, যে নেতানিয়াহু-র বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে, সেই তিনিই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। হওয়ারই কথা। কারণ, প্যালেস্টাইনে এই হত্যালীলা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার মদত না পেলে ইজ়রায়েল-এর এত দূর আসা সম্ভব হত কি? তা ছাড়া, গাজ়ায় সামরিক হানা চালিয়ে যাওয়ার ধরন থেকে স্পষ্ট যে নেতানিয়াহু-র অনেক কালের ইচ্ছা, গাজ়া ভূখণ্ডটি দখল করে ইহুদি বেষ্টিত এক বৃহত্তর ইজ়রায়েল গড়ে তোলা। সেই স্বপ্ন চরিতার্থ করতে বাকি বিশ্বকে আরও কত প্রাণহানি দেখতে হবে, কে জানে।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
ছবি-র গল্প
শুভাশিস চক্রবর্তীর অভিনেতা ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে লেখা ‘নিজের গায়ের দামি শাল খুলে জড়িয়ে দিয়েছিলেন শীতার্ত কনস্টেবলের গায়ে’ (রবিবাসরীয়, ২৭-৭) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। বাঙালি আভিজাত্য হোক কিংবা ইংরেজি কেতাবি আভিজাত্য, তার একটি অমর প্রতীক ছিলেন ছবি বিশ্বাস। নানা রকম চরিত্রে অভিনয়ে তাঁর ছিল সহজাত ক্ষমতা। তা সে সিনেমা হোক বা থিয়েটার। থিয়েটার প্রেমিকদের কাছে তিনি ছিলেন মঞ্চে অভিনয়ের এক ‘স্থপতি’। স্টার থিয়েটারে অভিনয় করার সময় নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্ত তাঁকে ঘিরে অনেক গল্প বলে গিয়েছেন। সেই সময় স্টার থিয়েটারে দেবনারায়ণ গুপ্তের পরিচালনায় ডাকবাংলো নাটকের রিহার্সাল চলছিল। নাটকে ছবি বিশ্বাসের দাড়ি ছিল। অথচ, দাড়ি নিয়ে তাঁর ভারী কষ্ট। তাই দাড়ি বাদ গেল। ক’দিন পরে তিনি জানালেন, পরচুলা পরেও তাঁর মাথা দপদপ করে। পরচুলাও বাদ গেল। নাটকের সিনে তাঁর গোঁফ ছিল, অভিনয়ের আগে গোঁফটি লাগিয়ে নিতেন। অভিনয়ের পরে সেটা হাতে সেঁটে নিতেন। সে দিন নাটকের শততম বারের অভিনয় চলছে। সিনের সময় দেখা গেল গোঁফটি তাঁর হাতেই রয়ে গিয়েছে। অভিনয় করার সময় সেটা লাগাতে ভুলে গিয়েছেন। শুধু তাঁর অভিনয়ের গুণে গোঁফ ছাড়া চরিত্রটি সে দিন উতরে গিয়েছিল।
পরের দিন সেই গোঁফটি একটি খামে দেবনারায়ণবাবুকে ফেরত দিয়ে লিখে পাঠালেন “ঝামেলা ফেরত দিলাম। প্রাপ্তি সংবাদ দিস।” পর্দার অন্তরালে এমনই অজস্র গল্প আছে তাঁকে ঘিরে।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)