E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অন্ধকারের প্রত্যাবর্তন

ক্ষুধাসূচকের সত্য যা-ই বলুক— রামমন্দির, স্নানযাত্রা, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বা প্রতিমার কার্নিভাল— আনন্দযজ্ঞেই আমার আপনার সবার নিমন্ত্রণ।

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৪২

নির্ভীক একটি প্রবন্ধ উপহার দিলেন ঈশানী দত্ত রায়। ‘সব সত্যি, সব সত্যি’ (২২-১০) প্রবন্ধটি পড়ে মনে হয়, তাই তো! শাসকের পুণ্য কর্ম, নারীকে পবিত্র রাখতে, সিন্ডারেলা-র ঘড়ি ঘরে ঘরে! পথে পথে পাপ পাপের মতো চলুক, আমাদের মেয়েরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরুক! নিন্দুক যা-ই ভাবুক, নারীকে ‘সুরক্ষিত’ রাখা একটি পবিত্র কর্ম, এই বিশ্বাসটি দৃঢ় ভাবে গেঁথে আছে ঘরে ঘরে। ছোটবেলাতেই আমাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, “খোকা যাবে মাছ ধরতে”, আর “খুকু যাবে শ্বশুরবাড়ি”! খুকুকে শ্বশুরবাড়ির সুরক্ষা দিতে কত পরিবার যে সমস্ত ঘটিবাটি বেচে পণ দিয়ে, কত খুকুর অকাল বোধন ১৮ বছর হওয়ার আগেই করে দেয়; সে পরিসংখ্যানও ‘সব সত্যি, সব সত্যি’! অবশ্য, শ্বশুরবাড়িতে সুরক্ষার সত্যিতে মিশে আছে গার্হস্থ সন্ত্রাস থেকে গৃহবধূ হত্যা, বধূ-বিসর্জনের সত্যিও।

আজ উত্তর-সত্যের প্রচলিত সংজ্ঞার দিকে তাকালে, এক লহমায় যে ঘটনাপ্রবাহের ছবি ভেসে উঠবে, তা উঠে আসে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫-এর জার্মানির ইতিহাসের পাতা থেকে। ‘একটি মিথ্যা বার বার বলতে থাকলে, তা একটি সত্যে পরিণত হয়’— এই বিপজ্জনক উক্তিটির গভীরে ছিল ভয়ানক এক উত্তর-সত্য নির্মাণ প্রকল্প। আত্মজীবনীতে হিটলার জানান যে, কিছু বিষয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ‘প্রোপাগান্ডা’র উদ্দেশ্য এবং সে ক্ষেত্রে সেই বিশেষ উদ্দেশ্যটি সফল করার অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে যে ভাবে সাজানো দরকার, ঠিক সেই ভাবেই প্রোপাগান্ডাটি সজ্জিত হবে। ফলাফল? লক্ষ লক্ষ দেহ— এক নির্মম নিধনযজ্ঞ।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? প্রোপাগান্ডার প্রভাবে অশোকচক্র বিষ্ণুচক্রে পরিণত হয়, ত্যাগের প্রতীক গেরুয়া হয়ে ওঠে রাজনৈতিক রং। খান আবদুল গফ্‌ফর খান, মৌলানা আজাদদের দেশের স্বাধীনতার জন্যে আত্মত্যাগ ভুলে গিয়ে তাঁদের ধর্ম-পরিচয় হয়ে ওঠে জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কখনও তাঁরা দেশদ্রোহী অথবা শুধুই ভোটব্যাঙ্ক! আবার আর এক রকম প্রোপাগান্ডায় ‘আমরা এগিয়ে আছি’ সবেতেই— এগোনোর ছবি দেখে পাঠকের মনে পড়তেই পারে কবি শঙ্খ ঘোষের সেই পঙ্‌ক্তি, “হাঁক দিয়ে বলে কন্ডাক্টর/ পিছনের দিকে এগিয়ে চলুন।”

কবিগুরু বলেছিলেন, সত্যসুন্দর বিরাজ করেন আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে। মঙ্গলালোক থাক না থাক, উত্তরসত্য অতিসুন্দর বিরাজ করছে দেশজোড়া আনন্দলোকে। ক্ষুধাসূচকের সত্য যা-ই বলুক— রামমন্দির, স্নানযাত্রা, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বা প্রতিমার কার্নিভাল— আনন্দযজ্ঞেই আমার আপনার সবার নিমন্ত্রণ।

অনিরুদ্ধ রাহা, কলকাতা-১০

সুখস্মৃতির ভিড়

‘সব সত্যি, সব সত্যি’ শীর্ষক ঈশানী দত্ত রায়ের উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়ে বলতে ইচ্ছা করছে, অত সহজ নয়, অত সহজ নয়। সম্প্রীতির শিকড়টা যে অনেক গভীরে। আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ভালবাসার রঙিন ছবি। পাঁচ দশক আগে যখন আমাদের স্কুলে হিন্দু ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত আর মুসলমান ছাত্রদের জন্য তৃতীয় ভাষা আরবি পঠন চালু হল, শিক্ষকের অভাবে অনেক দূর থেকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল মৌলবি স্যরকে, আরবি পড়াতে। স্কুলের স্থায়ী শিক্ষকেরা প্রতি মাসের শেষে তাঁদের বেতন থেকে কিছু টাকা চাঁদা তুলে মৌলবি স্যরের হাতে সামান্য কিছু সাম্মানিক তুলে দিতেন। তিনি তাতেই খুশি। আর স্যরের দুপুরের আহারের ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের বাড়িতে। মা-কে দেখতাম আসন পেতে কাঁসার থালায় যত্ন করে স্যরকে খেতে দিতেন। তখন স্কুলে পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে সংস্কৃত পাঠের পাশাপাশি আমরা কয়েক জন হিন্দু ছাত্র কিছুটা আরবিও শিখে নিয়েছিলাম মৌলবি স্যরের কাছে।

মনে পড়ছে, ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর মণ্ডপের পাশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমঞ্চে অষ্টমীর সন্ধ্যায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক সাদিক মহম্মদের নির্দেশনা ও অভিনয়ে সমৃদ্ধ একটার পর একটা সামাজিক ও পৌরাণিক নাটকের পালাগান উপভোগের কথাও। কী করে ভুলব সেই রাতটার কথা? যে রাতে বুকে সর্দি জমে শ্বাসকষ্টে ভোগা আমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য ছুটে এসেছিলেন ডাক্তার সদরুল মিদ্দা। সহকর্মী রফিকুল ইসলামের প্রতি নিছক পৃথক ধর্ম পরিচয়ের জন্য বিদ্বেষভাবাপন্ন হব? তিনি যে কোভিড অতিমারির সময়ে ঝুঁকি নিয়ে জরুরি ওষুধ সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। উপকারী বন্ধুর প্রতি মনে আমার বিদ্বেষ থাকলে তা কি ‘ধর্মে সইবে’? বেড়াতে গেলে আজও গৃহিণীর সামান্য স্বর্ণালঙ্কারটুকু নিশ্চিন্তে রেখে আসি অধ্যাপক বন্ধু মহম্মদ শাহনওয়াজ়ের জিম্মায়। বিভাজনের রাজনীতি কি অত সহজ?

আমার বাড়ির ঠাকুরঘরে সযত্নে পাথর বসিয়ে দিয়েছিলেন হোসেন। ব্যক্তিজীবনে আজও ভ্রাতৃপ্রতিম আবদুস শাহিদের সুপরামর্শ ছাড়া যে দিশাহারা বোধ করি! যে দিন আমার ছেলে বাইরের কলেজে প্রথম পড়তে গেল, সে দিন তার পিঠে ছিল প্রতিবেশী জাহাঙ্গিরদার উপহার দেওয়া ব্যাগ। স্মরণে আসছে আমার মেয়ের গৃহশিক্ষক আনাস হকের সে দিনের সজল চোখজোড়া, যে দিন সে দূরে চাকরি পেয়ে বিদায় জানাতে এসেছিল। জীবনখাতায় পারস্পরিক নির্ভরতা ও বিশ্বাস ভর্তি এই রকম অসংখ্য স্মৃতির কোলাজ ভরে আছে।

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

উপেক্ষা নয়

ঈশানী দত্ত রায়ের ‘সব সত্যি সব সত্যি’ প্রবন্ধটি পড়ে কিছু কথা না লিখে থাকতে পারলাম না। আজকের ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সন্ত্রাসবাদের উৎস, বিস্তার ও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখন প্রায় সকলেই অবগত। হালকা চালে অত্যন্ত রূঢ় বাস্তব নিয়ে লেখালিখি নিঃসন্দেহে পাঠককে হয়তো আনন্দ দেয়, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত বাস্তবতা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত নয়। প্রকৃত সত্য হয়তো সাময়িক ভাবে আড়ালে রাখা যায়, কিন্তু তা কখনও চিরকাল গোপন থাকে না।

ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ, জনবিন্যাসে পরিবর্তন এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্বে আঘাত এসেছে বহু বার। কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্বার্থে এমন অনুপ্রবেশকে পরোক্ষ উৎসাহও দেওয়া হয়েছে, যা উদ্বেগজনক।এ দেশের নাগরিকরা এখন অনেক সচেতন। তাঁরা বুঝতে পারছেন, দেশের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া অপরিহার্য। মতবিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু তা যেন তথ্য ও বাস্তবতার আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে, রাজনীতির কুয়াশায় আচ্ছন্ন না হওয়াই বিধেয়।

কাজল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮

দুর্নীতির দেশে

ঈশানী দত্ত রায়ের ‘সব সত্যি সব সত্যি’ প্রবন্ধটি বেশ ভাল লাগল। এই প্রসঙ্গে কিছু কথা না বলে থাকতে পারছি না। সত্যিই আজ আমরা সব যেন জেগে ঘুমানোর ভান করে আছি। বিপদ দরজায় কড়া নাড়ছে। কার ক্ষেত্রে কখন যে কী ঘটনা ঘটে যাবে তার ঠিক নেই।

দেশে আজ যেন সবচেয়ে বড় সমস্যা হিন্দু আর মুসলমান, ধর্ম আর ধর্ম করে সব মাতোয়ারা। দেশে যেন আর সমস্যা নেই। ন্যায় অন্যায়, সত্য-মিথ্যা বিচার করে ঠিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার মানুষের বড় অভাব। কে কত বেশি অনুদান, খয়রাতি দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করতে পারে তার প্রতিযোগিতায় সব রাজ্যের শাসকেরা ব্যস্ত।

খুনি, দুষ্কৃতী, অপরাধী— এদের কোনও রং, জাতি হয় না। এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম যে ভাবে সংখ্যালঘুদের দাগিয়ে দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষের মানুষদের অপরাধের দিকগুলো ততখানি ফলাও করে প্রচার করে না তারা। কিন্তু দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ভাবে এক জন সাধারণ নাগরিকও অন্যায়টা দেখতে পায়। ঠিকই বুঝতে পারে, অপরাধী শাসকদের স্বার্থরক্ষাকারী হলে শাসককুল চোখ বুজে থাকে আর ব্যবস্থা করে যাতে তাকে রক্ষা করা যায়। ফলে দুর্নীতি বেড়ে চলে।

বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fundamentalism History

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy