শুভাশিস চক্রবর্তীর ‘নিজের গায়ের দামি শাল খুলে জড়িয়ে দিয়েছিলেন শীতার্ত কনস্টেবলের গায়ে’ (রবিবাসরীয়, ২৭-৭) শীর্ষক ছবি বিশ্বাসের বিষয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখা পড়ে প্রীত হলাম। বাংলা ছায়াছবির স্বর্ণযুগের সূচনাকালে যে সমস্ত বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রী বাংলা ছায়াছবির অভিনয় জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন ও জনপ্রিয়তার আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন, তাঁদের মধ্যে অগ্ৰগণ্য ও কিংবদন্তি অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের ১২৫তম জন্মবর্ষ পূর্ণ হল ১৩ জুলাই।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে সবাক সাদা-কালো বাংলা ছবির জৌলুস, গরিমা, জনপ্রিয়তা ও তার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় ছবি বিশ্বাস ছিলেন অগ্ৰগামী। তিনি একের পর এক বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক যেমন শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ঐতিহাসিক ও সামাজিক উপন্যাস অনুপ্রাণিত ছায়াছবিতে অভিনয় করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। দাদাঠাকুর ও কাবুলিওয়ালা-য় রহমতের চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শকের মনের মণিকোঠায় চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। তবে এই সময়ে বাংলা মূলধারার ছবির প্রতি দর্শকের আগ্ৰহ ও বিশ্বাসও ছিল প্রবল। ছবি বিশ্বাস বাংলা মূলধারার ছবিগুলির স্থপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ধীরগতির সবাক সাদা-কালো বাংলা ছবিতে আটপৌরে বাঙালি ও অভিজাত বাঙালি দর্শকের দৈনন্দিন জীবনের টানাপড়েন এবং সাহেবিয়ানা দুই-ই তিনি তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন। বাংলা ছায়াছবিতে তিনি তাঁর অভিনয় দক্ষতায় গড়ে তুলেছিলেন এক নিজস্ব ঘরানা। সুঠাম চেহারায় তাঁর রাশভারী স্বভাব, চলন-ভঙ্গিতে আভিজাত্যের ছাপ, গম্ভীর অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর এবং সমাজজীবনে ব্যুৎপত্তি ও রসবোধ এই দিকপাল অভিনেতাকে সহজেই চিনিয়ে দিত। ছবি বিশ্বাসের আগে, বা তাঁর সমসাময়িক সময়ে, এমনকি তাঁর পরবর্তী সময়ে বাংলা ছবিতে বাঙালি আভিজাত্যকে এত সুন্দর ভাবে অন্য কোনও অভিনেতা তুলে ধরতে পেরেছেন কি?
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ছবি বিশ্বাস ও সমকালীন পাহাড়ী সান্যাল, কমল মিত্র, তুলসী চক্রবর্তী, মলিনা দেবী, ছায়া দেবী প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীর আবহে ও তাঁদের সাহচর্যে, সান্নিধ্যে, পরিচর্যায় ও অনুপ্রেরণায় বাংলা ছায়াছবির স্বর্ণযুগে বিশেষ ভাবে ঋদ্ধ হন মহানায়ক ও মহানায়িকা উত্তম কুমার সুচিত্রা সেন। তবে শুধু ছায়াছবির সীমানায় ছবি বিশ্বাসের অসামান্যতা আবদ্ধ ছিল না, নাটক ও মঞ্চ অভিনয়েও তিনি তাঁর দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। নিয়তি নিষ্ঠুর না হলে তাঁর অভিনয়ে বাংলা ছায়াছবি আরও সমৃদ্ধ হত, দর্শক ও শ্রোতারা আরও বেশি আনন্দ পেতেন এবং তাঁর সময়ের তরুণ অভিনেতা ও অভিনেত্রী আরও বেশি সমৃদ্ধ হতেন।
হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
অচলায়তন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত অচলায়তন-এর এক অংশে পঞ্চক দাদাঠাকুরকে বলেছিল, “কিন্তু দেখো ঠাকুর, একটা কথা তোমাকে বলি-অচলায়তনের মধ্যে ঐ-যে আমরা দরজা বন্ধ করে আছি, দিব্যি আছি। ওখানে আমাদের সমস্ত বোঝাপড়া একেবারে শেষ হয়ে গেছে। ওখানকার মানুষ সেইজন্যে বড়ো নিশ্চিন্ত। কিছুতে কারও একটু সন্দেহ হবার জো নেই। যদি দৈবাৎ কারও মনে এমন প্রশ্ন ওঠে যে, আচ্ছা ওই যে চন্দ্রগ্রহণের দিনে শোবার ঘরের দেওয়ালে তিনবার সাদা ছাগলের দাড়ি বুলিয়ে দিয়ে আওড়াতে হয় “হুন হুন তিষ্ঠ তিষ্ঠ বন্ধ বন্ধ অমৃতের হুঁ ফট স্বাহা” এর কারণটা কী— তা হলে কেবলমাত্র চারটে সুপুরি আর এক মাষা সোনা হাতে করে যাও তখনই মহাপঞ্চকদাদার কাছে, এমনি উত্তরটি পাবে যে আর কথা সরবে না। হয় সেটা মানো, নয় কানমলা খেয়ে বেরিয়ে যাও, মাঝে অন্য রাস্তা নেই। তাই সমস্তই চমৎকার সহজ হয়ে গেছে।”
চমৎকার সহজ হয়ে যাওয়া, আমাদের মানিয়ে নেওয়া গণতন্ত্রেও কানমলা খেতে খেতে আমরা কোনও রকমে টিকে রয়েছি। ‘ভৃত্যতন্ত্র’ (২৫-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধের প্রারম্ভেই স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, রাজ্যের পরিবর্তনের স্বরূপ হল নেহাতই প্রসাধনী প্রলেপেরই নামান্তর। স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষবৃক্ষটি গত বছর আর জি কর কাণ্ডের পরেও যে কাটা পড়েনি তা তো দেখাই যাচ্ছে।
গত বছর আর জি করের ঘটনার অব্যবহিত পরেই দেখা গিয়েছিল হাসপাতালের অধ্যক্ষের পুনর্বাসন, সংস্কারের নামে হাসপাতাল ভাঙচুরের ছবি। এবং, আন্দোলনের রাত দখল কর্মসূচিতে হাসপাতাল জুড়ে গুন্ডাবাহিনীর তাণ্ডব পর্যন্ত ঘটেছে। এখনও সেই ঘটনার রেশ ধরে হুমকি সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি হয়েই চলেছে।
সমাজে এক দিনে অচলায়তন তৈরি হয় না। ক্ষমতার প্রশ্রয়পুষ্টরা এখনও যে ‘আর জি কর করে দেব’ বলে অন্যদের শাসাতে পারে, তা ওই দীর্ঘমেয়াদি অচলায়তনরূপ শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারাই সংগঠিত হয়। অশুভ শক্তির আস্ফালনে সকলেই যদি অপরাধীর দোষ ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তা হলে তাতে যতই ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে থাকুক, তাঁদের তৃপ্ত করাই বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। আর দেশজোড়া এক সমান্তরাল অচলায়তন ব্যবস্থা জন্ম নেয়। সেখানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের মুক্ত হওয়ার ঘটনার পরে তাদের ফুল-মালায় জড়িয়ে আমরা বিজয়োল্লাস দেখি। রাষ্ট্রযন্ত্র মুখে যতই নারীনির্যাতনকে অভিশাপ বলে মনে করুক না কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা যথাযথ প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কলকাতায় আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবশালী ব্যক্তি কর্তব্যরত কর্মচারীর মতো সিবিআই দফতরে প্রতি দিন হাজিরা দিয়েছিলেন; কিন্তু তার পরে এক জন বাদে কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায়নি।
কিন্তু এখানেই মনে প্রশ্ন জাগে যে, ঘটনা ঘটার অব্যবহিত পরেই একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তথা অধ্যক্ষ যে বেনিয়মগুলি পালন করেছেন, তা কি প্রশাসনের মদতপুষ্ট এক শ্রেণির দাপুটে মানুষ না হলে তাঁরা করতে পারতেন? নাগরিক সমাজ যতই এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট জনমত তৈরি করতে থাকুক, প্রশাসনের মদতপুষ্ট হর্তাকর্তারা যে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবেন তা তো সকলেই জানেন। সম্পাদকীয় প্রবন্ধে যথার্থই বলা হয়েছে যে— যাঁরা উদ্ধত অধস্তনদের শাসন করতে ভয় পান, তাঁরাই পাচ্ছেন প্রশাসনের ভার। অথচ অচলায়তন সৃষ্টিতে এমন একটি অযৌক্তিক ব্যবস্থাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর। শাসকের আশ্রিত হয়ে থাকার বিকল্প সুখের ব্যবস্থা এ দেশে বড় একটা নেই। বাম আমলেও এই বন্দোবস্তটিই টিকে ছিল। তাই অগত্যা, মনিবের ভৃত্য হয়ে থেকেই নিজের পদটি যদি সুরক্ষিত রাখা যায় তা হলে কে-ই বা আর অন্যায় নিয়ে ভাবনা-চিন্তায় সময় ব্যয় করে, আলোড়ন তোলা তো দূরের কথা।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
গভীর সঙ্কট
বছরের পর বছর পেশাদারিত্বের অভাব এবং পরিকল্পনাহীনতায় প্রায় ডুবতে বসেছে ভারতীয় ফুটবল। এই মুহূর্তে ১৪০ কোটির দেশের ফুটবলের দুরবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সদ্যপ্রকাশিত ফিফা-র ক্রমতালিকায় ১৩৩-এ নেমে গিয়েছে। এশিয়ার দেশগুলির মধ্যেও ২৪ নম্বরে অবস্থিত ভারতীয় জাতীয় ফুটবল দল!
তরুণ ফুটবলার তুলে আনতে না পারার ব্যর্থতার কারণে চল্লিশের কোঠা ছুঁয়ে ফেলা সুনীল ছেত্রীকে পর্যন্ত অবসর ভেঙে ফিরতে হয়েছিল এই ভারতীয় দলে। কিছু দিন আগে পর্যন্ত আইএসএল নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এর মাধ্যমে ফুটবলাররা উঠে আসবেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সেটি নিয়ে কেবলই আশঙ্কার মেঘ। সব মিলিয়ে গভীর সঙ্কটে ভারতীয় ফুটবল। কিন্তু কোনও মাথাব্যথা আছে কর্তাদের?
সুদীপ সোম, হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)