E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: দূরদর্শিতার অভাব

শাসক দল এক ঢিলে দু’টি পাখি মারতে চেয়েছে। এর ফলে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির শাসক তৃণমূলের দিকে সংখ্যালঘু তোষণের যে অভিযোগটি আছে সেটা যেমন খণ্ডন হবে, তেমন মন্দির দেখিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের সমর্থন নিজেদের দিকে হয়তো আবারও ফিরিয়ে আনা যাবে।

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫ ০৫:৫১
Share
Save

প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের রাজনীতি প্রসঙ্গে লেখা ‘ক্ষতি’ (৩-৫) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি যথোপযুক্ত। ওড়িশার পুরীর আদলে রাজ্য সরকারের অর্থানুকূল্যে পশ্চিমবঙ্গের দিঘায় জগন্নাথদেবের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিতর্ক ও আইনের জটিলতা এড়াতে মন্দিরের পরিবর্তে নাম দেওয়া হয়েছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এর পরে মন্দিরের আকর্ষণে হয়তো দিঘার পর্যটন শিল্পের লাভ হবে, কিন্তু আখেরে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির নির্মাণে রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতার বড় রকম ক্ষতি হল।

শাসক দল এক ঢিলে দু’টি পাখি মারতে চেয়েছে। এর ফলে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির শাসক তৃণমূলের দিকে সংখ্যালঘু তোষণের যে অভিযোগটি আছে সেটা যেমন খণ্ডন হবে, তেমন মন্দির দেখিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের সমর্থন নিজেদের দিকে হয়তো আবারও ফিরিয়ে আনা যাবে।

অভিপ্রায়টির মধ্যে দূরদর্শিতা নেই বলেই মনে করি। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, এ রকম নরম হিন্দুত্বকে ব্যবহার করে কট্টর হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলা করা যায়নি। অযোধ্যায় বিতর্কিত সৌধের তালা খোলা থেকে শুরু করে টিভিতে বছরের পর বছর রামায়ণ ও মহাভারত ধারাবাহিক দেখানোর পরও ১৯৮৪ সালের পর থেকে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। নির্বাচনের সময়ে রাহুল গান্ধী মন্দিরে মন্দিরে ঘুরলেও কংগ্রেসের পালে হাওয়া লাগেনি। অরবিন্দ কেজরীওয়ালও প্রকাশ্যে ‘হনুমান চল্লিশা’ পাঠের মাধ্যমে নরম হিন্দুত্বের তাস খেলেও দিল্লির রাজপাট রক্ষা করতে পারেননি। আদপে বিরোধী দলগুলোর এ সব কর্মকাণ্ডে লাভ হয়েছে বিজেপিরই। মেরুকরণের রাজনীতি হলে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে মানুষের সমর্থন কট্টরপন্থীদের দিকেই যায়। সে ক্ষেত্রে বিজেপি প্রশ্নাতীত ভাবে সংখ্যাগুরু কট্টর হিন্দুদের সমর্থন লাভের প্রধান হকদার।

সাম্প্রতিক ধর্মীয় বিদ্বেষের আবহে রাজ্যে ধর্মবিযুক্ত রাজনীতির চর্চাই কাম্য ছিল। সেটাই বাংলার রাজনীতির ঐতিহ্য। যদিও দীর্ঘ বাম জমানার অবসানের পরের দেড় দশকে বাংলার রাজনৈতিক চালচিত্রের অনেক বদল ঘটেছে। অধুনা জীবন-জীবিকা রক্ষা বা অধিকার আদায়ের মতো বামঘেঁষা স্লোগান বাংলার রাজনীতির অঙ্গন থেকে অপস্রিয়মাণ। ‘জয় শ্রীরাম’ বা ‘খেলা হবে’-র মতো অরাজনৈতিক স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে ‘জয় জগন্নাথ’ শব্দবন্ধও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে এবং রাজ্য-রাজনীতির ময়দানে বার বার উচ্চারিত হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে গণদেবতার আশীর্বাদ কোন পক্ষ পায়, সেটাই দেখার!

কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া

প্রতিযোগিতা

‘ক্ষতি’ শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই মন্দির সকল জাত-পাত ধর্মের ঊর্ধ্বে থাকা মানুষের মহামিলন ক্ষেত্র এবং সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র!

বিজেপির সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় রাজনীতির প্রতি আস্থায় যে ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিও গা ভাসিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়তো, সমর্থন হারানোর ভয়। তবুও শাসক-বিরোধী রাজনীতির মূলগত তফাত রয়েই যায়। দেশের বর্তমান শাসক দল সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠের জামা গায়ে দিয়ে গর্বের সঙ্গে নিজেদের হিন্দুত্ববাদী বলে; এবং চরম হিন্দুত্বের রাজনীতি করে। অন্য দিকে বিরোধীরা ধর্মনিরপেক্ষতার জামা গায়ে দিয়ে সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে চেয়ে সংখ্যালঘুদের তোষণকারী হয়ে ওঠেন। আবার কখনও বিজেপির চরম সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে বিরোধী দলগুলি নরম হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী রূপেও প্রতিষ্ঠা পায়।

অর্থাৎ, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবে তারা ভাবের ঘরে চুরি করেই চলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ধর্মপ্রাণ ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলাই এক চ্যালেঞ্জ। ইন্দিরা গান্ধীর সময়েও দেশ সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর ভারসাম্যবাদেই ভোট-রাজনীতির পরিণতি খুঁজে পেয়েছে। সম্প্রতি অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদীর অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের দিনে রামের প্রাণপ্রতিষ্ঠা; আর ২০২৫-এর এই দিনটিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিঘায় জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনে জগন্নাথ দেবের প্রাণপ্রতিষ্ঠা একাকার হয়ে গেল।

প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের রাজনীতিতে রাজ্যের শাসক চেনা ছকেই আশ্রয় নিয়েছেন। স্বভাবতই বলা যায় যে; ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জামাটি গা থেকে ঝেড়ে ফেলে রাজকোষাগারের অর্থে দেশ জুড়ে চরম হিন্দুত্ববাদ রাজনীতির একমাত্র প্রতিরোধী হিসাবে মান্য তৃণমূল নেত্রীর এই মন্দির রাজনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতাকেই আরও বেশি প্রকট করে তুলল। বিশেষত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাসের বার্তা প্রেরণ করাই যখন সংখ্যাগুরুবাদের অন্যতম কর্তব্য রূপে বিবেচিত। চরম সংখ্যাগুরুবাদের সাগরে ভেসে চলা রাজ্যের শাসক দল যে ভোট-রাজনীতির স্বার্থেই ঐতিহ্যশালী ওড়িশার জগন্নাথ মন্দিরের কয়েকশো মাইলের মধ্যেই আরও একটি জগন্নাথ মন্দির স্থাপন করল, তা তো বোঝাই যাচ্ছে।

এখন সমস্যা হল, রাজনৈতিক নেতাদের দৈনন্দিন সংগ্রামে কখনও এগোতে হয়, কখনও পিছোতে হয়, মাঝে-মাঝে আত্মখণ্ডনও করতে হয়। কিন্তু এক জন সাধারণ নাগরিক বা কবি শিল্পী, যিনি প্রতি দিনের সংগ্রামে নেই, কিংবা জনতাকে পদে-পদে চালনা করার দায় যাঁদের নেই; তাঁরা তো এক বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে নেতাদের প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপের বিশ্লেষণ অবশ্যই করবেন, মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে।

রবীন্দ্রনাথও তেমনই স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের সমস্যাগুলিকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবর্গের মতামতের সঙ্গে তাঁর মতামতও এক সময় সংঘাতের আকার নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যখন শুভবুদ্ধি এবং নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমেই ভেদ-বুদ্ধি বিনাশে আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন; তখন রাজনৈতিক নেতারা হিন্দু-মুসলমান-শূদ্রদের মাঝে সংরক্ষণের মাধ্যমেই সমাজে এক সাম্যবাদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় ব্রতী ছিলেন। অথচ, রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন রাজনীতির সংরক্ষণের মাধ্যমে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেদ বুদ্ধির বিনাশ করা যাবে না। তিনি মনে করতেন— সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে দুর্বল করবে, সাময়িক শান্তির জন্য এটাকে প্রশ্রয় দেওয়াও কাজের কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “দেশের যে অতি ক্ষুদ্র অংশে বুদ্ধি, বিদ্যা, ধন, মান সেই শতকরা পাঁচ পরিমাণ লোকের সঙ্গে পঁচানব্বই পরিমাণ লোকের ব্যবধান মহাসমুদ্রের ব্যবধানের চেয়ে বেশি।”

এই ৫ শতাংশ লোকই তাঁদের সুবিধামতো ৯৫ শতাংশকে চালিত করে এবং মাঝেমধ্যেই দাঙ্গা বাধায়। আর এ ভাবেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অবিশ্বাস গড়ে ওঠে এবং পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। এর কোনও সমাধান হয়তো নেই!

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

আত্মবিশ্বাস?

সম্পাদকীয় ‘ক্ষতি’ পড়ে একটি প্রশ্ন তুলতে চাই। গত সব ক’টি নির্বাচনে দেখা গিয়েছে যে, বিজেপি-শাসিত কিছু রাজ্যের থেকে শিক্ষা, কর্মসংস্থানে পিছিয়ে থাকলেও, এ রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট এককাট্টা হয়ে স্বঘোষিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তৃণমূলের ঝুলিতে এসেছে। তাই কি রাজ্যের শাসক দল এখন নিশ্চিন্ত হয়েছে যে, এ বার তারা জনগণের করের টাকায় সংখ্যালঘু তথা দরিদ্র মানুষের উন্নয়ন না করে ধর্মস্থল তৈরি করে চললেও, কেউই কোনও প্রশ্ন তুলবেন না?

নিকুঞ্জবিহারী ঘোড়াই, কলকাতা-৯৯

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Digha Jagannath Mandir Secular State Religious Politics West Bengal government

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।