Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সম্পাদক সমীপেষু: পথিকৃৎ সিপিএম

শীর্ষেন্দুবাবু ছাপ্পা ভোট দেওয়ার কথা লিখেছেন। বাস্তবে এর পিছনে থাকত পার্টি নেতৃত্বের নিপুণ ছক। সেই যে ছাপ্পা ভোটের প্রচলন হল, ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসার পর তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান নেতারা।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০০:২৬
Share: Save:

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (‘আগে উত্তেজনা হত...’, ৭-৪) লিখেছেন, ভোটে এখন যে অজস্র খুনোখুনি ঘটে তা নকশাল আমলই শিখিয়ে গিয়েছে। নকশাল আমলে অজস্র খুন হয়েছে এ কথা ঠিক। তবে এলাকা দখলের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে খুন করে সরিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল তারও আগে, রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ে। যুক্তফ্রন্ট সরকারে জ্যোতি বসু পুলিশমন্ত্রী ছিলেন। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে বা কোথাও পুলিশের সহায়তায় এই কাজ শুরু করে সিপিএম নেতৃত্ব। এমনকি যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলিকেও রেয়াত করেননি তাঁরা। পুলিশ-প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর সেই ট্র্যাডিশনই চলছে। মাত্রার হেরফের হয়েছে নিশ্চয়ই।

শীর্ষেন্দুবাবু ছাপ্পা ভোট দেওয়ার কথা লিখেছেন। বাস্তবে এর পিছনে থাকত পার্টি নেতৃত্বের নিপুণ ছক। সেই যে ছাপ্পা ভোটের প্রচলন হল, ১৯৭৭-এ ক্ষমতায় আসার পর তাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান নেতারা। যত দিন গিয়েছে, সিপিএম নেতারা সূক্ষ্মতার ধার ধারেননি। বিরোধীদের ভয় দেখানো, ভোটে দাঁড়াতে না দেওয়া, ভোটারদের ভয় দেখানো— রাজ্যে এসেছে সিপিএমের হাত ধরে।

অতীতে কংগ্রেস রাজনীতিতে দলাদলি, গোপন হিংসার মধ্যে সৌজন্যের রাজনীতির নজিরও তৈরি করেছিল এ রাজ্য। যে দিন সুভাষচন্দ্র ওয়েলিংটন স্কোয়ারের অধিবেশনে সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন, সে দিন স্কোয়ারের বাইরে কংগ্রেসের সাধারণ সমর্থকরা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বেরিয়ে এসে তাঁদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেন, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নেতাদের বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেন। সে দিন তাঁকে সরিয়ে যিনি কংগ্রেস সভাপতি পদে শপথ নিয়েছিলেন সেই রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাঁর বাড়িতেই সে রাতে অতিথি ছিলেন।

সমরেন্দ্র প্রতিহার

কলকাতা-৪

মেলালেন তিনি!

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখাটি (‘আগে উত্তেজনা হত...’, ৭-৪) সময়োপযোগী। কিন্তু একটি অংশ পড়ে ধন্দ হল। কিশোর বয়সে বামপন্থীদের জয় চাওয়া লেখককে বাম মনোভাবাপন্ন ধরে নিতেই পারি। তিনি নকশাল আন্দোলন, গুন্ডা এবং এখনকার সঙ্কীর্ণ রাজনীতির খুনোখুনি, মৃত্যুকে মিলিয়ে দিলেন!

নকশাল আন্দোলন নিয়ে বিদগ্ধ সাহিত্যিক, সমাজসচেতন মানুষকে কিছু বলাটা ধৃষ্টতা। তবু লিখছি, কারণ নকশাল আন্দোলন এমন এক রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল যার ঢেউ শুধু বাংলায় নয়, ছড়িয়েছিল সারা দেশে। এই আন্দোলন ভুল না ঠিক তা নিয়ে মতপার্থক্য, বিতর্ক থাকতেই পারে। নকশালদের আন্দোলন সশস্ত্র ছিল। বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু তা ছিল একটা আদর্শের, নীতির প্রশ্নে। তা না থাকলে আজ ৫০ বছর পরেও এ নিয়ে আলোচনা হত না। আজকের খুনসর্বস্ব রাজনীতির সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেওয়া ঠিক? আজকের রাজনীতি তো আদর্শহীন, নীতিহীন। কোনও মতে এলাকা দখল, ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে খুন। নকশাল আন্দোলনের মতো সমাজ-বদলের স্বপ্ন দেখা রাজনীতিকে এই রাজনীতির সঙ্গে এক সারিতে বসিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

প্রদীপ দে

বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

সেকাল-একাল

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সাল-তারিখ উল্লেখ না করলেও মনে পড়ছে, এটি ১৯৫৭-র বিধানসভা নির্বাচনের ঘটনা। সকাল থেকে ভোট গোনা শুরু, শহর জুড়ে উত্তেজনা। একা বিধানচন্দ্র রায় নন, কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর লড়াইয়ে বহু রথী-মহারথী ছিলেন। সকাল থেকে আমি ছিলাম আশুতোষ কলেজের সামনে। তখন কলেজের ছাত্র, সবে রাজনীতির স্বাদ পেয়ে বামপন্থীদের সমর্থক হয়েছি। কংগ্রেস ও বামপন্থী সমর্থক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ পানের দোকানে রেডিয়োতে কান পেতে আছেন। চৌরঙ্গির দিক থেকে নানা খবর আসছিল। এক বার বিধানবাবু জিতছেন, পরক্ষণে খবর আসছে বিপক্ষের প্রার্থী মহঃ ইসমাইল জিতছেন। বিকেলে খবর এল ইসমাইল জিতে গিয়েছেন। বামপন্থী সমর্থকেরা হইহই করে উঠল, কংগ্রেস সমর্থকদের মুখ চুন। খবর এল, এ বার পোস্টাল ব্যালট গোনা শুরু হয়েছে। সন্ধ্যায় জানা গেল বিধান রায় ৫৪০ ভোটে জিতে গিয়েছেন।

বাঙালি হিসেবে বিধান রায়কে নিয়ে গর্ব থাকলেও সে দিন চেয়েছিলাম উনি হেরে যান। নির্বাচনে সার্বিক ভাবে বামপন্থীরা হেরে গেলেও কলকাতায় বেশি আসন পেয়েছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। ওই নির্বাচনে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় প্রথম দাঁড়িয়েছিলেন— চিত্তরঞ্জন দাশের দৌহিত্র পরিচয়ে, ভবানীপুর আসন থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হয়ে। যত দূর মনে পড়ছে তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন বসু। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জিতলেও এক বছরের মধ্যে পদত্যাগ করে বামপন্থীদের সমর্থনে পুনরায় ওই আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন এক দল থেকে অন্য দলে গিয়েও নির্লজ্জের মতো সেই দলের প্রার্থী পদে থাকা যেত না। আমরা বন্ধুবান্ধবরা নানান দলকে সমর্থন করতাম, তুমুল তর্ক হত কিন্তু হাতাহাতি হয়েছে বলে মনে নেই। হাজরা পার্কে ভাল বক্তা বক্তৃতা দিলে সব দলের মানুষ দাঁড়িয়ে শুনতেন, বিশেষত সৌম্যেন ঠাকুরের বক্তৃতা থাকলে দল-মত নির্বিশেষে মানুষ শুনতেন। তখন শাসক বা বিরোধী দলের প্রার্থীর নামে এখনকার মতো দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যেত না।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

কলকাতা-৯৩

প্রায়শ্চিত্ত

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে মনে হয়েছিল, এই গুরুতর সমস্যার সমাধানসূত্র না হোক, অন্তত একটা-দুটো কারণ তিনি দেখাবেন, যা থেকে আজকের হতাশ বামপন্থীরা সঠিক রাজনীতির দিশা পাবেন।

বামপন্থী পরিবারে জন্ম নেওয়ার সুবাদে সিপিএম দলটার প্রতি আমারও ছিল আকর্ষণ। বাবা-কাকার কাছে শুনতাম, এই তো গরিবের দল। লড়াই করে বাঁচার দল। গরিবের জন্য লড়াইয়ের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার পরিচিত অনেকেই ছাপ্পা ভোট দিতে যেতেন বুথে। তখন বুঝিনি, এ কি শুধুই কর্মী-সমর্থকদের আবেগ? না কি এর পিছনে রয়েছে যে ভাবেই হোক ভোটে জিততেই হবে, এই মনোভাব? বামপন্থীদের কি এ জিনিস শোভা পায়? অন্যায়ের বিপরীতে পাল্টা-অন্যায় কি তাঁদের আদর্শ হতে পারে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলাই তো তাঁদের মহান কর্তব্য।

খুনোখুনির রাজনীতির জন্য শীর্ষেন্দুবাবু নকশালদের দায়ী করেছেন। আমার মতে তা আংশিক সত্য। ভোটে জেতার রাজনীতি করতে গিয়ে সিপিএম কংগ্রেসি অন্যায়ের বিপরীতে পাল্টা-অন্যায়ের পথ বেছে নিয়েছিল। শুধু ছাপ্পাতেই থেমে থাকেনি, তাদের হাতে অন্য বামপন্থী দলের নেতা-কর্মীও নিহত হয়েছেন। ভোট-রাজনীতিতে একটা দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য প্রায় মুছে ফেলেছে সিপিএম নেতৃত্ব। এ রাজ্যে তৃণমূল যে দুষ্ট রাজনীতি চালাচ্ছে তার প্রায় সবই কি সিপিএম করে যায়নি? কত বড় সর্বনাশ তারা করেছে, তা হয়তো তারা আজ ভাবে না। কাকু-জেঠুদের মতো অনেককে চোখের জল ফেলতে দেখছি আজও।

সংসদীয় ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে বামপন্থাকে যদি সিপিএম নেতৃত্ব এ ভাবে কলঙ্কিত না করত, তা হলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এতটা নিম্নগামী হত না। এখন সর্বত্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলে নির্বাচনে দক্ষিণপন্থীদের সব নষ্টামিকে নস্যাৎ করাই বামপন্থীদের সংগ্রাম হওয়া উচিত। এই সংগ্রামই সুষ্ঠু নির্বাচনের একমাত্র গ্যারান্টি হতে পারে।

অথচ, সিপিএম নেতৃত্ব বস্তুত অকার্যকর। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থেকে কর্মীদের লড়াকু মনোভাবও প্রায় শেষ। ফলে, ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়া মাত্রই কংগ্রেসের ক্রাচ না ধরলে তাঁরা দাঁড়াতে পারছেন না। জনগণের উপর ভরসা নেই বলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করার মতো অমর্যাদাকর জায়গায় নিজেদের নিয়ে যাচ্ছেন নেতারা। ঘুরেফিরে সেই ভোট-রাজনীতি, পরিণাম ভোগ করছি আমরা। নির্বাচনী সন্ত্রাসের দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে। প্রবল সংশয়ে আছি। বার বার কানে বাজে পরিচিত এক বর্ষীয়ান বামপন্থী মানুষের আক্ষেপ, ‘‘কী মর্মান্তিক প্রায়শ্চিত্ত আমাদের!’’

ব্রত দাস

কলকাতা-৭৭

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pioneer CPM Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE