অভিরূপ সরকারের ‘বাঙালির ব্যবসা হয় না’ (৮-৯) শীর্ষক প্রবন্ধটি বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুবই প্রাসঙ্গিক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যে বাংলা ছিল এক নম্বরে, আজ সেই বাংলা এবং বাঙালির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। আরও দুর্ভাগ্যের যে, এই লড়াইয়ে বাংলা এবং বাঙালির ভূমিকাই আতশকাচের তলায়। ব্যবসায় সাফল্যের প্রসঙ্গে বণিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ব্যবসায়ীদের নিজেদের মধ্যে যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাস গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে এই প্রবন্ধে, তা শুধুমাত্র ব্যবসা নয়, নিজেদের অস্তিত্ব সর্ব ক্ষেত্রে জানান দেওয়ার জন্যও জরুরি। বর্তমানে বাঙালিদের মধ্যে তার অভাব যথেষ্ট। অভাব আছে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস ও পরিশ্রম করার ক্ষমতারও।
প্রবন্ধে বাঙালি উদ্যোগপতিদের যে তালিকা ও প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এর সঙ্গে একাসনে বসানো যেতে পারে ভূপেন্দ্রনাথ দে প্রতিষ্ঠিত দে’জ় মেডিক্যালের নাম। সফল উদ্যোগপতি হিসাবে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নামও উল্লেখ্য। আলামোহন দাশের সামান্য মুড়ি বিক্রেতা থেকে শিল্পপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রামও ছিল এক চমকপ্রদ আখ্যান। তাঁর ইন্ডিয়া মেশিনারি, জুট মিল, বস্ত্র প্রতিষ্ঠান, চিনি কোম্পানি থেকে ইনশিয়োরেন্স ও ব্যাঙ্ক অবধি গড়ে তোলার এক দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। তবে প্রবন্ধকারের সঙ্গে একটু ভিন্নমত প্রকাশ করে বলি, বেঙ্গল ইমিউনিটি-র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শুধুমাত্র বিধানচন্দ্র রায়ের নাম উল্লেখ করলে আড়ালে চলে যায় নীলরতন সরকার, কৈলাসচন্দ্র বসু ও চারুচন্দ্র বসুর নাম, যাঁদের যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠান।
আজ যে শিল্প পশ্চিমবঙ্গে একবারে প্রথম সারিতে, সেই আবাসন শিল্পের প্রসারে কিন্তু বাঙালির নেতিবাচক ভাবনার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাড়ি বা জমি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করে তুলে দেওয়া হচ্ছে আবাসন নির্মাতাদের হাতে, শুধুমাত্র পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেওয়ার সাহসের অভাবে। পরবর্তী সময়ে সেখানে যেমন অ-বাঙালিদের সংখ্যা আবাসিক হিসেবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনই দেখা যাচ্ছে সেই আবাসনে বাঙালি ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় দোকান খুলে বা অন্য নানাবিধ ব্যবসা করে রীতিমতো মুনাফা করছে। তবে এই প্রসঙ্গে সরকারেরও ভূমিকা এবং দায়বদ্ধতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। রাজ্য সরকার কোটি কোটি টাকা পুজো কমিটিগুলোকে অনুদান হিসেবে না দিয়ে, বেকার যুবক-যুবতীদের ব্যবসার প্রতি উৎসাহ প্রদানের জন্য ভাতা হিসেবে যদি ব্যয় করত, তবে বহু মানুষ উপকৃত হতেন। এর মধ্যে যদি অর্ধেক সংখ্যকও প্রতিষ্ঠিত হতেন, তবে শিল্পহীনতা থেকে মুক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অনেকের কর্মসংস্থানও হত।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
কেন পিছিয়ে
অভিরূপ সরকারের ‘বাঙালির ব্যবসা হয় না’ প্রবন্ধটি যথার্থ। এখন চাকরির বাজার অত্যন্ত খারাপ। শিক্ষিত বাঙালি যদি চাকরির মোহে দিন কাটিয়ে দেয়, তবে ভবিষ্যৎ ঝরঝরে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ইংরেজ আমলে আইনব্যবসা, শিক্ষকতা ও সরকারি চাকরিকে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র মনে করা হত। ব্যবসাকে মনে করা হত কষ্টসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত। ফলে মারোয়াড়ি, গুজরাতি, পঞ্জাবিরা ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করলেও বাঙালি বেশি এগোতে পারেনি। আজও কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন ছোট-বড় শহরে ব্যবসার হাল ধরে আছে মূলত অ-বাঙালি সম্প্রদায়। বাঙালি সাধারণত লেখাপড়ার সঙ্গে স্থায়ী চাকরিকে বেশি প্রাধান্য দেয়। বাঙালি কখনও তার সন্তানকে সফল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি করার লক্ষ্যে বড় করে তোলে না। তাই অন্যান্য সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তানদের মতো ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি হওয়ার মানসিকতা, পুঁজি সংগ্রহের সাহস, বাজার বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা— এ সব ক্ষেত্রে বাঙালি পরিবারের সন্তান অনেক পিছিয়ে থাকে। চাকরি না পেয়ে কেউ নতুন ব্যবসা শুরু করলেও, ধৈর্য বা ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা না থাকায় তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়।
গৌতম পতি, তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
দুই ছবি
পঁচিশ বছর আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি উৎসব দেখার সময়ই মনে পড়ছিল তারও দশ বছর আগে দেখা এক ছবির কথা, সত্যজিৎ রায়ের শাখা-প্রশাখা। ছবি দুটোর গল্প প্রেক্ষাপট সময় ভিন্ন হলেও কোথাও যেন একটা অনুভূতির মিল আছে— হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া এক ঘটনাকে ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে পৃথক জায়গায় বাস করা পরিবারের লোকেদের একত্র হওয়া এবং গল্পে গল্পে অবধারিত ভাবে নিজেদের অথবা একে অপরের বিষয় আলোচনা করা। শিশির রায়ের প্রবন্ধ ‘রুপোর উপর সোনার জল’ (৫-১০) রজতজয়ন্তী বর্ষে উৎসব ছবিটি নিয়ে আলোচনা পড়ে মনে হল, ঋতুপর্ণ ঘোষ যদি রুপোর উপর সোনার জল দিয়ে ছবিটি নির্মাণ করেন, তা হলে আসল সোনা দিয়ে তৈরি ছবি সত্যজিতের শাখা-প্রশাখা।
ধনী এবং অবসরপ্রাপ্ত সত্তর বছর বয়সি শিল্পপতি আনন্দ মজুমদার তাঁর সম্মানে আয়োজিত এক ভোজসভায় পড়ে গিয়ে আহত হন। সততা ও দুর্নীতিমুক্ত এই ব্যক্তিকে দেখতে ছুটে আসেন পরিবার সমেত তাঁর তিন সন্তান, এক সন্তান মানসিক ভাবে ‘অসুস্থ’ বলে তাঁর কাছেই থাকেন। এই অবস্থায় সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে গল্পে গল্পে তাঁদের নিজেদের দুর্নীতির পর্দাগুলো খুলতে থাকে এবং দেখা যায় তাঁদের বিত্ত অর্জনের অনেকাংশেই দুর্নীতি জড়িয়ে। আনন্দ মজুমদার জেনে যান তাঁর ‘কৃতী’ সন্তানদের এবং মুষড়ে পড়েন। শাখা-প্রশাখা ছবিতে একটা সাময়িক সময়ের জন্য মিলিত হওয়া যৌথ পরিবারের এই ঘটনার সঙ্গে মিল দেখা যায় ঋতুপর্ণের উৎসব-এ। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, পারিবারিক এই ছবি করতে ঋতুপর্ণ সত্যজিতের অনুপ্রেরণা পান। মনে রাখতে হবে, দুটো ছবি দু’টি আলাদা যুগের— বিশ্বায়ন এবং আর্থিক উদারীকরণের আগে সত্যজিতের ছবি আর পরে ঋতুপর্ণের। ফলে সমাজে এবং পরিবারে বেশ পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে যা ফুটে উঠেছে চলচ্চিত্র দু’টিতে। সত্যজিতের মতো ঋতুপর্ণও দেখিয়েছেন মধ্যবিত্তের সংসারে রুপোর উপরে বাঁধানো সোনার মতোই দেখনদারি, যা লুকিয়ে রাখে অবাধ্য নিষিদ্ধ গোপন— মজুমদারবাবুর বিত্তবান সন্তানদের কৃতী হয়ে ওঠার গল্পের মতোই। এখানে বিষয়গুলো সাম্প্রতিক সময়ের উপযোগী। দুর্নীতি আর্থিক বা সামাজিক/পারিবারিক যা-ই হোক, তা দুর্নীতিই। পারিবারিক কেচ্ছা দুর্নীতি সাংসারিক কেলেঙ্কারির কথা সাধ করে আর কে লোকসমাজে প্রকাশ করতে চায়? বরং দামি আসবাব গয়না কার্পেটের নীচে সেগুলো লুকিয়ে থাকে। কিন্তু পারিবারিক মিলনের সময় অনেক দুর্বল মুহূর্তের সৃষ্টি হয়, যখন এই সব কথা ও কাহিনি বেরিয়ে পড়ে।
পারিবারিক মিলন সে দুর্ঘটনাজনিত কারণেই হোক, বা দুর্গাপুজোর মতো উৎসব, আসলে মুখোশ খুলে দেয়। তবে প্রবন্ধকারের কথার সুর ধরেই বলি, বেশির ভাগ সিনেমাই শেষ পর্যন্ত ঘা-খাওয়া মানুষদের জিতিয়ে দেয়। এই ফর্মুলা সত্যজিৎ ও ঋতুপর্ণ দু’জনেই মেনে চলেছেন। সত্যজিৎ প্রশান্তকে আনন্দ মজুমদারের আস্থাভাজন রূপেই শুধু নয়, মানবিক ও মানসিক ভাবে ‘সুস্থ’ দেখিয়েছেন। আর উৎসব-এর শেষের ঘটনা প্রবন্ধকার বলেছেন। প্রসঙ্গান্তরে বলি, শুধু একটা আফসোস থেকে গেল— সত্যজিতের জন অরণ্য ছবিটি দেখে পরে শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, এই বার উনি (সত্যজিৎ) আমাদের দেখে ফেলেছেন। উৎসব ছবিটি দেখার পর আর এমন কথা বলার অবকাশ ছিল না বলেই বোধ হয়। কারণ, যে শিশু দশ বছর আগেই ‘দু’নম্বরি’ কী তা জেনে গিয়েছে, সে কালে কালে পরিবার তথা সমাজের অনেক দুর্নীতি সম্বন্ধেই ওয়াকিবহাল। আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ আর নেই।
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-১০৪
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)