পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী ‘নিয়ে যাবি কে আমারে’ (২৫-৫) প্রবন্ধে ভ্রমণসাহিত্য ও ট্র্যাভল-ভ্লগ’এর যে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই চিঠি। বর্তমানে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভ্রমণ-ভিডিয়ো বা অনলাইন ট্র্যাভল-ভ্লগগুলি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কারণ, এই ভ্রমণ-ভিডিয়োগুলি দেখে মানুষ কোনও অঞ্চল সম্পর্কে, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, গাছগাছালি ও জনজীবন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা অর্জন করতে পারেন। পরে তাঁরা যখন ওই স্থানটি ভ্রমণে যান তখন আগে দেখা ভিডিয়োটির সঙ্গে স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতাগুলি মেলাতে চান।
কিন্তু তা সত্ত্বেও টুকরো ভ্রমণচিত্র বা ট্র্যাভল-ভ্লগ যথার্থ ভ্রমণসাহিত্যের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে না। কারণ সার্থক ভ্রমণকাহিনিতে আমরা লেখকের চোখ দিয়েই সেই অঞ্চলটি সম্পর্কে জানতে পারার পাশাপাশি লেখকের অন্তর্দৃষ্টির যে পরিচয় পাই তার তুলনা কোথায়! অবধূতের মরুতীর্থ হিংলাজ শুধুমাত্র ঊষর মরু অঞ্চলে অবস্থিত এক দেবীমাতার তীর্থভূমিতে পৌঁছনোর কষ্টকর যাত্রার কথাই তুলে ধরে না, লেখক নর-নারীর সম্পর্কের যে কাহিনি তুলে ধরেন তাও তুলনারহিত। গৌরকিশোর ঘোষের নন্দকান্ত নন্দাঘুণ্টি কিংবা চিরপথিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিমালয়ভ্রমণ রচনাগুলি যে অগণিত পাঠকের মনে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছিল তার সবচেয়ে বড় কারণ তাঁরা শুধুমাত্র নগাধিরাজ হিমালয়ের দ্রষ্টব্য স্থানগুলির বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হননি, অত্যন্ত সুললিত গদ্যে মানুষজন, লোকাচার ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। একই কথা বলা চলে সুবোধ চক্রবর্তীর রম্যাণি বীক্ষ্য এবং আরও কয়েকজন ভ্রমণ কাহিনিকারের রচনা সম্পর্কেও। তাঁরা দর্শনীয় স্থানগুলিকে সাহিত্যরসে জারিত করে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন, ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন নিজস্ব অভিজ্ঞতাসঞ্জাত গভীর আত্মদর্শন। ট্র্যাভল-ভ্লগ’এর সে সুযোগ কোথায়? প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, দেশে বিদেশে বইয়ে পড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি অসামান্য বর্ণনা। সুনীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে যেতে দেখে লেখক লেখেন, “...গভীর নীলাম্বুজের মত নবীন নীলাকাশ হংসশুভ্র মেঘের ঝালর ঝুলিয়ে চন্দ্রাতপ সাজিয়েছে।” এই অনুভূতি কি ট্র্যাভল-ভ্লগ’এ প্রকাশ করা সম্ভব?
সমীর কুমার ঘোষ, কলকাতা-৬৫
ক্ষণস্থায়ী
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘নিয়ে যাবি কে আমারে’ প্রবন্ধটি ভ্রমণপিপাসু বাঙালির মনকে আবেগপ্রবণ করে তুলবে। ট্র্যাভল-ভ্লগ’এর ক্ষেত্রে, পথ চলতে চলতে নানা স্থান ও দৃষ্টিকোণ থেকে নেওয়া হয় ‘হাই ডেফিনিশন ভিডিয়ো ক্লিপ’। সম্পাদনা পরবর্তী সেই ক্লিপগুলো জড়ো করে, সিনেমার গানের কলি কিংবা আবহসঙ্গীত জুড়ে দিয়ে, আবেগঘন স্বরের ভয়েসওভার যোগ করে তৈরি হয় ট্র্যাভল-ভ্লগ। এক কথায় বিপণনযোগ্য ‘অডিয়ো ভিস্যুয়াল কনটেন্ট’। মূল লক্ষ্য থাকে লাইক-শেয়ার-কমেন্ট সর্বোপরি সাবস্ক্রাইবারদের সংখ্যা বৃদ্ধি। কারণ, বিষয়টির সঙ্গে ভ্লগারের আর্থিক সম্পর্ক জড়িত। ট্র্যাভল-ভ্লগ মনোরঞ্জন করতে পারলেও হৃদয়ে তার প্রভাব ক্ষণস্থায়ী। অন্য দিকে, ভ্রমণকাহিনি পাঠকমনে তৈরি করে অজানা-অদেখা স্থানে ভ্রমণ সুখানুভূতির এক আশ্চর্য কল্পজগৎ। দীর্ঘমেয়াদি তার অবস্থান, আবেদন।
স্কুলজীবনে জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা ‘ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে’ ভ্রমণ-বিষয়ক প্রবন্ধটি পাঠ্যতালিকাভুক্ত ছিল। কত বার পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। যুবাবয়সে গোমুখ দর্শনে বেরিয়ে, গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ পর্যন্ত চড়াই-উতরাই পার হওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে রচনাটির বর্ণনা মনশ্চক্ষে ভেসে উঠছিল। পাহাড়ি পথ চলার ক্লান্তিতে গতি শ্লথ হয়ে পড়লে কানের কাছে যেন শুনতে পেতাম স্কুলপাঠ্য প্রবন্ধটির অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সেই আপ্তবাক্যটি, “নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” পা দুটো আবার গতিময় হয়ে উঠত। গোমুখ পৌঁছে নয়নাভিরাম দৃশ্যে অভিভূত হয়ে বুঝেছিলাম, নদীর উৎপত্তি সম্পর্কে লেখক যথার্থই লিখেছিলেন, ‘মহাদেবের জটা হইতে’।
‘ভার্চুয়াল ক্লাউড স্টোরেজ’-এ সঞ্চিত সংখ্যাতীত ট্র্যাভল-ভ্লগ প্রকৃতার্থে ক্ষণজীবী। কিন্তু সুলিখিত ভ্রমণবিষয়ক রচনা, আমাদের স্মৃতির ভান্ডারে অরূপরতন হয়ে সঞ্চিত থাকে বহু যুগ ধরে। এখানেই তার সাফল্য এবং সার্থকতা।
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
সাহিত্যেই উৎস
‘নিয়ে যাবি কে আমারে’ প্রবন্ধে পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর মত অনুযায়ী ভ্রমণসাহিত্য কালজয়ী। তুলনায় স্বল্পস্থায়ী ‘ঝকঝকে স্মার্ট হাই ডেফিনিশন’ ট্র্যাভল-ভ্লগ’এর পক্ষে তা সম্ভব নয়। তবে ভ্রমণসাহিত্যের সঙ্গে ‘ভ্লগ’ তুলনীয়ই নয়।
মার্কোপোলো, ইবনবতুতা, ডারউইন, কলম্বাস, ম্যাগেলান, হিউয়েন সাং, আমেরিগো ভেসপুচি, জেমস কুক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রমুখের ভ্রমণবৃত্তান্তের চিরকালীন আবেদন নিয়ে জানতে গিয়ে ‘ট্র্যাভলগ’ শব্দটিকে জেনেছিলাম। ট্র্যাভলগ বিষয়ে অনেক রকম তথ্য মেলে। ইউরোপিয়ানরা, বিশেষত ব্রিটিশরা ভ্রমণের রেকর্ড রাখতে অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন। এই সব ভ্রমণের ধারাবিবরণীই ছিল সে কালের নিরিখে ভ্রমণসাহিত্য, যার চালিকা শক্তি ছিল অর্থনীতি। পরে ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে ট্র্যাভলগে। পরে মূল লক্ষ্যে অর্থনীতি ও রাজনীতিকে রেখেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি গুরুত্ব পেয়েছে।
আজকাল ভিডিয়োতে ভ্লগারকে দেখাতে হয় তিনি রোবট নন, মানুষ। নিজে এই সব জায়গায় গিয়ে লাইভ বা অনলাইন অথবা অফলাইনে ভিডিয়ো রেকর্ড করে সাধারণত ইউটিউবে পরিবেশন করেন। সাধারণত ভ্লগে ক্যামেরায় যা ধরা পড়ে, সেটাকেই সম্পাদনা করা হয়।
ভ্লগের উৎস সুপ্রাচীন ভ্রমণসাহিত্যেই, যার পর্যবেক্ষণ ও বোধের গভীরতা অনেক। মোবাইলে সার্চ করলেই নিমেষে একাধিক ভ্লগ সুলভ। তেমন ভ্লগ হলে মনে হবে দর্শক যেন নিজে ঘুরছেন। ভিডিয়োয় ভ্লগারের অভিনয়গুণ আকর্ষণ বাড়ায় যা ভ্রমণসাহিত্যে দুর্লভ। তবে এই ভ্রমণ-আলেখ্যগুলিতে লেখনী গুণে পাঠক, শ্রোতা মানসলোকে বিচরণ করে ভ্রমণের স্বাদ নিতে পারেন। অডিয়ো ভ্রমণেও বাচিক অভিনয়ে মন ভরিয়ে দেওয়া যায়। দৃষ্টিশক্তি দুর্বল যাঁদের, তাঁরা এতে উপকৃত হন।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
যুগের দাবি মেনে
‘নিয়ে যাবি কে আমারে’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। মানুষের কাছে বিনোদনের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম স্মার্টফোন। সেখানে ট্র্যাভল-ভ্লগ’এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অতীতের তুলনায় এখন বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। রুটিনবাঁধা দার্জিলিং, পুরী, হাজারিবাগ, শিমুলতলার গণ্ডি ভেঙে ভ্রমণ মানচিত্রে জায়গা নিয়েছে অজানা কত নাম। এ সব অফবিট জায়গার সুলুকসন্ধান দিচ্ছে ট্র্যাভল-ভ্লগ। আকর্ষণীয় ছবির সঙ্গে লক্ষ লক্ষ লাইক আর শেয়ার বাড়িয়ে তুলছে ভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা।
দ্রুতগামী জীবনে বই পড়ার আগ্রহ ক্রমশ কমছে। ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী’র গল্প পড়ে ছোটদের যে মন উধাও হত দিকশূন্যপুরে, তার দরজা বন্ধ। কার্টুন ছবিই দেখিয়ে দিচ্ছে সব কিছু। মনের রঙে ছবি আঁকে আজ ক’জন? শৈশব কৈশোর থেকে তৈরি হওয়া এক অভ্যাসই হাতছানি দিত ভ্রমণসাহিত্যের জগতে। অনায়াস কল্পভ্রমণ এনে দিত অপার্থিব মানসিক তৃপ্তি।
কিন্তু ফাস্ট ফুডের মতো চটকদার ট্র্যাভল-ভ্লগ’এ এক দিনেই দেখে নেওয়া যায় পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য। কিছু থাকে, কিছু মুছে যায়। সময়ের দাবিতে ট্র্যাভল-ভ্লগ আজ দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে। ভ্রমণসাহিত্য এখন দুয়োরানির মতো। তার খোঁজ আজ কে রাখে!
প্রবাল বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)