পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’ (২৭-৪) শীর্ষক প্রবন্ধটি এই অস্থির সময়ে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুনামের শীর্ষে উন্নীত হওয়ার মূলে থাকে তার সাধনা। তিল তিল করে গড়ে তোলা বিজ্ঞান, অর্থনীতি, চিকিৎসা শাস্ত্র, শিল্পকলা, অর্থাৎ সামগ্রিক উন্নয়ন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা চলে মননশীল চলমান মণি-মাণিক্যের খনি। মেধাবীদের সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনই দেশকে সমৃদ্ধ করে, দেশ যশের মুকুট পরিধান করে। স্মরণীয়, সেই উন্নতিতে শাসকের বিশেষ ভূমিকা থাকে। প্রকৃত দূরদর্শী উদারমনা শাসক ক্ষমতা বণ্টনে বিশ্বাসী, বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক পরিচালনায়। কিন্তু সেই শাসক যদি গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরে দেশে একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে চান, তখনই বাড়ে সমস্যা। এমন ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা শাসকের চলার পথ কখনও মসৃণ হতে পারে না।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্বাস, তিনি শুধু আমেরিকা নয়, সমগ্র বিশ্বের এক এবং অদ্বিতীয় কর্তৃত্বকারী অধীশ্বর। তাঁর অঙ্গুলি হেলনে সব কিছুই চলবে। তাঁর বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয় যদি শাসকের অনুগত না হয়, তা হলে তা রাষ্ট্রের শত্রু। সে কারণে সমস্ত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলিকে রাষ্ট্রের অনুগত করে তুলতে নতুন ভাবে ধারাবাহিক আক্রমণ চালাচ্ছেন তিনি। ফলে স্বনামধন্য কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিও ট্রাম্পের হুমকির কাছে নতমস্তক হয়, তাঁর অযৌক্তিক হাস্যকর দাবিগুলি মেনে নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তচিন্তা, বহুত্ববাদ অর্থাৎ ভিন্নমতের অবস্থান, বহির্বিশ্বের পড়ুয়াদের পঠন-পাঠন, গবেষকদের গবেষণা, বিজ্ঞানের সত্য অনুসন্ধান— এই সমস্ত কিছুকে হাতিয়ার করে শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায়। তাই নানা আশঙ্কায় শঙ্কিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এমন অনমনীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর একনায়কোচিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাইছেন। কিন্তু শাসকের রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞা করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন— এখানে কী পড়ানো হবে, কারা পড়াবেন, কারা পড়বেন, কোন বিষয়ে গবেষণা হবে, কী মানা হবে, কী হবে না, তা প্রশাসন নির্ধারণ করতে পারে না। তাই তাঁর দৃষ্টিতে দুর্বিনীত এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ট্রাম্প শিক্ষা দিতে চান, মারতে চান আর্থিক ভাবে। আর তার জন্যই ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি সরকারি অনুদান স্থগিত রেখেছেন তিনি।
তবে আশার কথা, আমেরিকার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলি হার্ভার্ড-এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি অনুদান দেওয়া হয় জাতীয় স্বার্থে, সরকারের অনুগত হওয়ার জন্য নয়। এও এক জমি দখলের লড়াই। এই ‘যুদ্ধ’ থেকে ভারতেরও শিক্ষা নেওয়ার আছে বইকি।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
অদম্য
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর প্রবন্ধটিতে এক গভীর পর্যবেক্ষণ নিহিত রয়েছে। সম্প্রতি আমেরিকায় যা ঘটল, বা ঘটছে, তা শিক্ষার প্রতি শাসকের মনোভাবকে বড় বেশি প্রকট করে তুলেছে। আগে আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্স বলেছিলেন, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মানুষের শত্রু। তার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বন্ধ করে দেন আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য সরকারি অনুদান। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিপুল অঙ্কের যে-সমস্ত অনুদান এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তা শর্তহীন নয়। সরকারের শর্ত মেনে নিলে অনুদান চালু হতে পারে, তবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। এতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গোল্লায় যায়, যাক। যদি দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, পড়ুক।
প্রায় ২০০ কোটি ডলারের অনুদান বন্ধ করা হয় দেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমেরিকান শিক্ষা দফতরের সাফ কথা, ছাত্রছাত্রীদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে না পারলে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কেন্দ্রীয় সরকারি অনুদান পাবে না। হার্ভার্ড তার ইহুদি ও ইজ়রায়েল-পন্থী ছাত্রছাত্রীদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। অর্থাৎ, ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রতিবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আন্দোলন চলছে, তাতে ইজ়রায়েল-পন্থীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। এত বড় অনাচার কি মেনে নেওয়া যায়? তার উপর হার্ভার্ডে প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘বৈচিত্র সাম্য অন্তর্ভুক্তি’ (ডিইআই) প্রকল্প রয়েছে। হুকুম হয়েছিল, এ সবও করা যাবে না।
কিন্তু বাদ সাধেন হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্বার। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কী পড়াবে, কী করবে, সেটা সরকার বলে দিতে পারে না। ফলে অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে। এ বার শুধু মানচিত্র আর নামগুলো পাল্টে এ দেশের প্রেক্ষাপটে ভাবা যাক। দেখা যাবে, এ দেশের শাসক দলও অনেকটা একই ভাষায় কথা বলে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সঙ্গে মিল পাওয়া যায় এ দেশের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে, যারা এখনও নিয়মিত রুখে দাঁড়ায় রাষ্ট্রীয় খবরদারির বিরুদ্ধে।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
ক্ষমতার প্রকাশ
‘কণ্ঠরোধের দেশ’ (২১-৪) সম্পাদকীয়তে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে লেখা হয়েছে “ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ফরমান পাঠিয়ে যা যা পদক্ষেপ করতে বলেছে তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বলেই নয়, গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামোয় যে কোনও স্বাধীন, স্বনির্ভর বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই অত্যন্ত অবমাননার...।” অথচ, প্রশ্ন করার অধিকার উচ্চশিক্ষার প্রধান প্রাপ্তি। বিজ্ঞান থেকে কলা, সর্বত্রই তা একই ভাবে সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ই মনুষ্য-জীবনের প্রথম গণপরিসর। ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’ প্রবন্ধে পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী যথাযথ ভাবে বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিরুদ্ধে এই আক্রমণের পরিকল্পনা যে দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে সেটা হল— বিশ্ববিদ্যালয় যদি রাষ্ট্রের অনুগত না হয়, তা হলে অবশ্যই রাষ্ট্রের শত্রু। এই কথাগুলো যে কতখানি প্রাসঙ্গিক, তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাজমাধ্যমের লেখায় প্রমাণিত।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ‘পাওয়ার নলেজ’ বলে একটা পরিভাষা তৈরি করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন— ক্ষমতার শিকড় জ্ঞানে, সে জ্ঞানকে কাজে লাগায় এবং আপন উদ্দেশ্যে তাকে সাজিয়ে নিয়ে পুনরুৎপাদনও ঘটায়। জ্ঞানের মধ্য দিয়েই ক্ষমতা তার নিজস্ব ময়দান তৈরি করে, বাঁটোয়ারা করে। কিন্তু তাই বলে ফুকো জ্ঞানকাণ্ডকে ধ্বংস করতে বলেননি। বরং বলেছেন, জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ সব সময়ে নতুনের সূচনা করে। এ দিকে, ‘ট্রাম্প ও ফ্যাসিবাদের ছায়া’ (১৯-৪) শীর্ষক প্রবন্ধে পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন— ট্রাম্পের ধারণা, পৃথিবীর সব দেশের উপর আমদানি শুল্ক বসালে আমেরিকার বাণিজ্যিক ঘাটতি মিটবে, দেশের শিল্পোৎপাদন হইহই করে বৃদ্ধি পাবে, আমেরিকার শ্রমিকরা আবার আগের মতো কল-কারখানায় ভাল মাইনের কাজ পাবেন। শুল্ক যুদ্ধ ঘোষণা করে তিনি আমেরিকান শত্রু-মিত্র সকলেরই সরবরাহ শৃঙ্খল ঘেঁটে দিয়েছেন।
রুশ সাম্রাজ্যে জ়ারের এক শিক্ষামন্ত্রী একদা বলেছিলেন, জনতাকে, অন্তত জনতার বৃহদংশকে লেখাপড়া শেখালে, ভালর চেয়ে মন্দই বেশি হবে। এই কথাটির সারসত্য বুঝে তাঁরা জনগণের এক বৃহৎ অংশকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। তাই লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা বিপ্লব করে প্রথমেই জনতার ক্ষমতায়নে তাঁদের কর্মসূচিতে শিক্ষাকে স্থান দিয়েছিলেন, সোভিয়েট ইউনিয়নে অতি দ্রুত শিক্ষিতের হার শতকরা ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
ইতিহাসের সেই অধ্যায়কে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর সহৃদয় বন্ধু ইলন মাস্ক নিশ্চিত ভাবেই কালো তালিকাভুক্ত করবেন।
সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)