E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: তাঁদের দাপটেই...

নির্বাচন যেখানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেখানে নির্বাচন কমিশনের প্রবল স্বাধীনতাই চাই। সংবিধানের বার্তাও তাই। কিন্তু নির্বাচন ক্ষমতার উৎসও বটে, তাই স্বাধীনতা হরণের চেষ্টাও থাকবে।

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৫ ০৮:৫৩

নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘নিরপেক্ষতা হারানোর পর’ (১০-৭) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। সুকুমার সেন শুধু প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ছিলেন না, তিনি ছিলেন এ দেশের নির্বাচন পরিচালনার অন্যতম পথিকৃৎ। নির্বাচন কমিশনের ভিত্তিটাই তিনি গড়ে দিয়েছিলেন, আর এই কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। কারণ নির্বাচন কী সে-বিষয়ে কোনও ধারণাই তখনও পর্যন্ত ছিল না। তার উপর লোকসভা ও বিধানসভার এক সঙ্গে ভোট, কুড়ি লক্ষ ইস্পাতের ব্যালট বাক্স চাই। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ ভোটকর্মী চাই। প্রায় ১৮ কোটি ভোটার চিহ্নিত করে প্রথম ভোটার লিস্ট বানাতে হবে। কী ভাবে ভোটপত্র বানালে ৮৫% নিরক্ষর ভোটারও ভোট দিতে পারবেন, একেবারেই শূন্য থেকে এত কিছু হিসাব করা একমাত্র সুকুমার সেনেরই কৃতিত্ব। বিষয়টি তিনি স্পষ্ট করেই জওহরলাল নেহরুকে জানিয়ে ধৈর্য ধরার কথা বলেছিলেন। যথাসম্ভব সন্তোষজনক ভোটার লিস্ট বানিয়ে তবেই তিনি নির্বাচন করিয়েছেন। এই স্বাধীনতা তিনি প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন।

নির্বাচন যেখানে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেখানে নির্বাচন কমিশনের প্রবল স্বাধীনতাই চাই। সংবিধানের বার্তাও তাই। কিন্তু নির্বাচন ক্ষমতার উৎসও বটে, তাই স্বাধীনতা হরণের চেষ্টাও থাকবে। সবাই টি এন শেষন (ছবি) নন যে, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হয়েই ধাক্কা দেবেন এই বলে, “নির্বাচন কমিশন ভারত সরকারের কোনও অংশ নয়, তাই চিঠিপত্রে ‘নির্বাচন কমিশন, ভারত সরকার’ লেখা যাবে না।” এই কমিশন ‘ভারতের নির্বাচন কমিশন’। শেষন জানিয়ে দিয়েছিলেন, ভারত সরকার নিজেই এমন কিছু প্রথা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে নির্বাচন কমিশন তার নিজের সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে অসমর্থ হচ্ছে। সরকার পক্ষ, বিরোধী পক্ষের তীব্র আক্রমণ তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি। বলতে গেলে টি এন শেষনই ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তার সংবিধান স্বীকৃত স্থানে বসিয়ে গিয়েছিলেন।

এমনিতেই হাজারো কারণে এ দেশের প্রতিটা ভোট যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা-প্রসূত, এ কথা বলা যায় না এবং জনপ্রতিনিধিরা যে অধিকাংশ জনগণ দ্বারা সমর্থিত তাও না। তার উপর যদি ভোটার লিস্টে কারসাজি চলে, সুবিধাজনক নির্বাচনী এলাকা বানানো হয়, ভোটের সময় নানাবিধ কারচুপি প্রশ্রয় পায়, ভোটে জেতামাত্র সরকার গঠনের জন্য জনপ্রতিনিধিরা দলবদল করতে পারে, তা হলে গণতন্ত্রের হাতে থাকে কতটুকু? তাই অন্তত নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকলে কিছুটা গণতন্ত্র বজায় রাখা যায়। তার জন্য এক জন নিরপেক্ষ, বিচক্ষণ এবং সাহসী মুখ্য নির্বাচন কমিশনার প্রয়োজন। তাঁকে নির্বাচন করার জন্য কঠোর গণতান্ত্রিক উপায় আজও প্রচলন করা গেল না?

দুর্গেশ কুমার পান্ডা, তেঘরিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

প্রশ্ন উঠবেই

প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘নিরপেক্ষতা হারানোর পর’ শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন বিভাগ একটি নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে কাজ করবে এবং ভারতের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অবাধ নির্বাচনের সামগ্রিক ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ যিনি মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হবেন, তাঁকেও নিরপেক্ষ হতে হবে। যে-হেতু সংবিধান অনুযায়ী ভারতের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত, সে-হেতু সরকারি কর্মকর্তারাও সমদৃষ্টিতে তাঁর দেশের নাগরিকদের দেখবেন।

এ তো হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়, আর বাস্তব চিত্রটা হল এর থেকে অনেকখানি ভিন্ন প্রকৃতির। ক্ষমতাসীন দল চিরকাল প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের চেয়েও সংশ্লিষ্ট দফতরের আমলাদের দিকটিও আলোচনা করা প্রয়োজন।

আসলে, এ কথা বলার কারণ এটাই যে, উচ্চশিক্ষিত এই সব মানুষ রাজনৈতিক চাপে অনেক সময়ই নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়ে বসেন। তবুও, এ কথা অনস্বীকার্য যে, আজও বহু সরকারি আমলা আছেন, অতীতেও ছিলেন, হয়তো ভবিষ্যতেও আসবেন, যাঁরা মেরুদণ্ড সোজা রেখে তাঁর কর্মজীবন শেষ করতে পারেন। এই তালিকাটিও বেশ দীর্ঘ। অনেক সরকারি আমলাই তাঁর কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইস্তফা দিয়েছেন।

প্রবন্ধে লেখক উল্লেখ করেছেন বিহারের নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার কথা। নাগরিক কি না প্রমাণের জন্য যে যে শংসাপত্রের প্রয়োজন বলে নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, খুব কম সংখ্যক মানুষ সেই সব শংসাপত্র প্রদান করতে পারবেন। এর আসল উদ্দেশ্যটি সহজেই অনুমেয়। আর এর পরে যাঁরা ভোটাধিকার হারাবেন অথবা নাগরিকত্ব, তাঁদের জন্য কী ব্যবস্থা, তা কোথাও উল্লেখমাত্র করা নেই।

আতঙ্কের সূত্রপাত হয় এখান থেকেই। প্রশ্ন হল, ইতিপূর্বে একাধিক বার বিহার রাজ্যের নির্বাচনে যে সমস্ত ব্যক্তি তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, তাঁরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হলে, তাঁদের ভোটে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের নির্বাচন কি অবৈধ নয়? এ সব প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

আসলে ক্ষমতার আস্ফালন যে কতটা সুদূরপ্রসারী, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সাধারণ জনগণ। কিন্তু নিত্যনতুন নির্দেশিকায় জেরবার প্রান্তিক জনগণের কণ্ঠস্বর পৌঁছয় না কর্তৃপক্ষের উচ্চাসন পর্যন্ত। নিরপেক্ষতা একটি মানবিক বোধ, কঠোর মনঃসংযোগ এবং দীর্ঘ অধ্যবসায়ের পর তা অর্জন করতে হয়। যে নাগরিক তাঁর নিত্যদিনের সংসার চালাতেই হিমশিম, সেই নাগরিকের কাছে ভোটের প্রাসঙ্গিকতাই বা কতটুকু? তবুও নির্বাচন আসে যায়, সরকার বদলায়, নতুন নতুন বিষয়ের অবতারণা হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না।

রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি

গণতন্ত্রের দায়

প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘নিরপেক্ষতা হারানোর পর’ প্রবন্ধটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এত বড় গণতান্ত্রিক দেশে জাতীয় নির্বাচন কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়। ভারতের এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গোটা বিশ্বের কাছে একটা দৃষ্টান্তমূলক পদ্ধতি। সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশন কী ভাবে, কোন পদ্ধতিতে, কোন আইনে, কোন কমিটির দ্বারা নির্বাচিত হবে, সেটা বড় নয়। বড় কথা, নাগরিকরা ঠিক পদ্ধতিতে, ঠিক ভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেন কি না। সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সচেতন থাকা প্রয়োজন। শাসক দলের দিকে ঝুঁকে, তাদের কথা শুনে নির্বাচন কমিশন চলতে পারে না। নির্বাচন কমিশন স্বশাসিত সংস্থা। সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা সংবিধানের মূল কাঠামোর অঙ্গ। তার অনেকটাই টি এন শেষন দেখিয়ে দিয়েছেন। ১৯৫১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ভোট দিয়ে আসা মানুষের ভোটাধিকার আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ল কেন? তাঁরা সবাই আজ ভুয়ো ভোটার হয়ে গেলেন?

তা হলে এই ভুয়ো ভোটারের মাধ্যমেই তো এত দিন ধরে নেতারা বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হয়েছেন। রাজকোষ থেকে কোটি কোটি টাকা ভাতা-সহ সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। তা হলে তো তাঁদের সুদসমেত সমস্ত টাকা ফেরত দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে। যা-ই হোক, ইতিমধ্যে যে সকল ভারতীয় নাগরিক জন্মের শংসাপত্র, স্কুল পাশের সার্টিফিকেট, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভারতীয় পাসপোর্ট, এলআইসি বন্ড, পোস্ট অফিসের পাসবুক, ব্যাঙ্কের পাসবুক, পুরনো বাড়ি জমির দলিল ইত্যাদি দেখিয়ে ভোটাধিকার অর্জন করেছেন এবং করবেন তাঁদের নাম কিছুতেই ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া ঠিক নয়। তাই নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও স্বাধীন ভাবে কাজ করে যেতে হবে, ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে হবে। বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত— তা প্রমাণ করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

ECI Chief Election Commissioner Sukumar Sen jawaharlal nehru

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy