এ বারের নারী দিবসে এ দেশে ও সমাজে নারী নানা দিক থেকে কতটা অবহেলিত ও বঞ্চিত, সে বিষয়ে পত্রপত্রিকায় একাধিক লেখা বেরিয়েছে। নারীদের প্রতি অবহেলা ও বঞ্চনা জীবিকার নানা ক্ষেত্রে নিত্য দিন ঘটে চলেছে। এক জন পুরুষ দিনমজুর যে মজুরি পান, একই কাজ করলে মহিলাদের দেওয়া হয় কম মজুরি। এমনকি আজও বহু পরিবারে মাছের ভাল পিসটা দেওয়া হয় ছেলেদের, মেয়েদের জোটে লেজা! মেয়েরা নাকি লেজা বেশি পছন্দ করে! মেয়েরা কোন খাবার খেতে পছন্দ করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার খোঁজ রেখেছে কি কোনও দিন? ছেলেরা খেয়ে নেওয়ার পর যা পড়ে থাকে, আজও অনেক পরিবারে মেয়েদের সেটাই দেওয়া হয়। আর টাকার অভাব থাকলে, ভাইবোনের মধ্যে মেধাবী হলেও মেয়েটির পড়াশোনা আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়। “মেয়েমানুষ অত লেখাপড়া শিখে করবেটা কী! বিয়ে দিয়ে দাও!”
আমরা শিক্ষিত যুক্তিমান মানুষ, যারা এ বিষয়ে অনেক কিছু জানি ও বলি, তাদের মধ্যে ক’জনই বা নিজ বাড়িতে স্ত্রী বোন ও মায়েরা কী খেল বা তাদের সাধ-আহ্লাদ, প্রয়োজনের দিকে নজর দিই! এ দেশ চূড়ান্ত লিঙ্গবৈষম্যের ব্যাধিতে আজও আক্রান্ত। লিঙ্গবৈষম্য দেশের সুস্থায়ী উন্নয়নের অন্তরায়, যা দেশের আর্থিক বিকাশের পক্ষেও শুভ নয়। আর সে কারণেই সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্ধারিত সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ভারত বেশ পিছিয়ে। গত বছরের ফলাফল অনুযায়ী ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারত রয়েছে ১০৯তম স্থানে। নারীকে বঞ্চিত রেখে এ কেমন ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’! এটি একটি জাতীয় লজ্জা!
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
গোলাপদিবস নয়
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘটা করে উদ্যাপন করা হল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই দিবসের সূচনা হয়েছিল শ্রমজীবী নারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তাঁরা লড়াই করেছিলেন সমান মজুরি, কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা আদায়ের লক্ষ্যে এবং শোষণের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন? নারী দিবস যেন শুধুই এক আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন, যেন নতুন বছরের শুভেচ্ছা বা জন্মদিনের মতোই একটি বিশেষ দিন মাত্র, কর্পোরেট মার্কেটিং-এর সুযোগ। সমাজমাধ্যমে ঝড় ওঠে শুভেচ্ছার। দিন শেষে? জীবন আবার সেই আগের মতোই চলতে থাকে। নারী দিবস শুধু একটা দিন, তার বেশি কিছু না।
কিন্তু বাস্তবে মেয়েদের অবস্থা কী রকম, সেটা সকলেরই জানা। শহরের উঁচু দালানগুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে হয়তো মনে হতে পারে— হ্যাঁ, পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু একটু গভীরে তাকালেই দেখা যাবে, ছ’মাসের শিশু থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধা— সবাই বিকৃত লালসার শিকার। আর জি করের বিচার আজও হয়নি। এক জন উচ্চ পদস্থ পেশাজীবী নারী যদি ন্যায়বিচার না পান, তা হলে সাধারণ নারীদের কথা তো বলা বাহুল্য! আন্দোলন হয়, প্ল্যাকার্ড ওঠে, সমাজমাধ্যমে ট্রেন্ড চলে। তার পর? মানুষ ভুলে যায়। হঠাৎ এক দিন এই খবরটিও পাওয়া যায় যে, তিলোত্তমার হয়ে বিচার চাইতে যাওয়া এক তরুণও ফেরার পথে তার বান্ধবীকে ধর্ষণ করে! মেয়েদের শুধু ধর্ষণ করা হয় না, বরং তাকে পশুর মতো ছিঁড়ে-খুঁড়ে শেষ করে দেওয়া হয়। যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারা, কন্যাশিশুকে গর্ভেই হত্যা করা, রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে— যে কোনও সুযোগে শরীরে হাত দেওয়া হয়! প্রেমে প্রত্যাখ্যানের জবাবে মুখ ঝলসে দেওয়া হয় অ্যাসিডে, বিচ্ছেদের পর প্রাক্তন প্রেমিক প্রতিশোধ নেয় গোপন ছবি-ভিডিয়ো ফাঁস করে।
আমার বয়স যখন ১৮-১৯, মেয়েদের সুরক্ষা নিয়ে কথা প্রসঙ্গে এক বান্ধবী বলল যে, সে ছোটবেলাতেই তার বাড়ির খুব কাছের এক জনের কাছে লালসার শিকার হয়। প্রথম বার জানলাম এ রকমটাও হয়! পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল সে মুহূর্তে। তার পর আরও অনেকের থেকে জানতে পারলাম, অনেকেই ছোটবেলায় ঘরের ভিতরেই আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেক মেয়ে নিজেই বুঝতে পারেন না, কতটা শোষিত হচ্ছেন। ঘরের ভিতরে, নিজের পরিচিতদের হাতেই সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন মেয়েরা।
শুধু শারীরিক নিপীড়ন নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণও মেয়েদের প্রতিনিয়ত বন্দি করে রেখেছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা পুরুষের সমান পরিশ্রম করেও কম মজুরি পান। তবে, শুধু পুরুষদের দিকে আঙুল তুললেই কি সব দায় শেষ? সমানাধিকার মানে কি শুধু সমান সুযোগের দাবি তোলা, না কি সমান দায়িত্বও নিতে হবে? এক জন পুরুষ বেকার হলে, অধিকাংশ নারী কি তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হবে যদি ছেলেটি সংসার সামলানোর দায়িত্ব নেয়? যদি স্বামীর আয় স্ত্রীর চেয়ে কম হয়, তা হলে সেই সম্পর্কের ভিত্তি কতটা শক্ত? এক জন স্ত্রী যদি স্বামীর আয়ের উপর নির্ভরশীল হতে পারেন, তবে স্বামী স্ত্রীর আয়ের উপর নির্ভরশীল হলে তা ‘অসম্মানজনক’ কেন?
এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার! এক জন বিবাহিত কর্মজীবী নারী তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে চাইলে, শ্বশুরবাড়ির বাধা আসে কেন? ছেলের ক্ষেত্রে তো এটা স্বাভাবিক। তা হলে মেয়েদের জন্য আলাদা নিয়ম কেন? আর একটি বড় সমস্যা আইনের অপব্যবহার। মেয়েদের সুরক্ষার জন্য বানানো কিছু আইনই এখন অনেক পুরুষের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিথ্যে মামলায় নিরীহ পুরুষদের ফাঁসানো হচ্ছে, তাদের আত্মহত্যায় পর্যন্ত বাধ্য করা হচ্ছে। সমানাধিকার চাইলে, এটার বিরুদ্ধেও মেয়েদের কথা বলতে হবে। সর্বোপরি, মেয়েদের নিজেকেও ভোগ্যবস্তু বা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রের বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। নয়তো পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে কী ভাবে?
নারী দিবস শুধু শুভেচ্ছা জানানো বা গোলাপ দেওয়ার দিন না। এটা নিজের অধিকার, দায়িত্ব, শক্তি, ও সংগ্রামকে উপলব্ধি করার দিন। নারীর মুক্তি তখনই সম্ভব, যখন তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেবেন, এবং সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য লড়বেন।
শঙ্খ শুভ্র দাস, মহাকাল নগর, আলিপুরদুয়ার
তাঁদের নামে
দেশের মধ্যে মেট্রোরেল চালু হয় প্রথম আমাদের এই কলকাতায়। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ১৯৭২ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর স্বপ্ন ছিল মাটির তলা দিয়ে ট্রেন চালু করা। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ছিল সুমধুর সম্পর্ক। ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই তিনি পাতাল রেলের প্রস্তাব তুলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও সেই প্রস্তাবে ছাড়পত্র দেন। আর সেই সূত্রেই ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতার জাদুঘরের বিপরীতে মেট্রোরেল প্রকল্পের শিলান্যাস করেন ইন্দিরা গান্ধী, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ও তৎকালীন রেলমন্ত্রী টি এ পাই-কে পাশে রেখে। কয়েক মাসের মধ্যে দ্রুত গতিতে কাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এর পর বিপত্তি ঘটে ১৯৭৭-এ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায়। মেট্রোর কাজ গতি হারায়। ১৯৮০ সালে পুনরায় ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এবং বাংলায় এ বি এ গনি খান চৌধুরী রেলমন্ত্রী হওয়ার পরই আবার মেট্রোর কাজে গতি আসে। পরিণামে ১৯৮৪-র অক্টোবরে ভারতে প্রথম মাটির তলা দিয়ে ট্রেন চালু হয়।
সল্ট লেক পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। সেই সল্ট লেক আজকের বিধাননগর। বিধাননগরেও আজ মেট্রোর সম্প্রসারণ ঘটেছে। মেট্রোর বহু স্টেশনের নাম বিখ্যাত বাঙালিদের নামে শোভা পাচ্ছে। মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন, বিধানচন্দ্র রায় ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নামে মেট্রোর দু’টি স্টেশনের নামকরণ করা হোক।
বাবলু নন্দী, কলকাতা-৭৯
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)