Advertisement
১১ মে ২০২৪
Gour Kishore Ghosh

সম্পাদক সমীপেষু: সত্যনিষ্ঠ লেখনী

বর্ণময় জীবন ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী গৌরকিশোর ঘোষের রিপোর্টে সব সময় থাকত নিজস্বতার ছাপ। তিনি ছিলেন আদর্শবাদী, সত্যনিষ্ঠ লেখক।

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২২ ০৪:৪৫
Share: Save:

ঈশিতা ভাদুড়ীর ‘দেশ মাটি মানুষের লেখক’ (২১-৬), এবং সুগত বসুর ‘নিষ্ক্রিয়তাও পাপ’ (১-৭) ও ‘বন্দে মানবম্’ (২-৭) শীর্ষক প্রবন্ধ সূত্রে কিছু কথা। বর্ণময় জীবন ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী গৌরকিশোর ঘোষের রিপোর্টে সব সময় থাকত নিজস্বতার ছাপ। তিনি ছিলেন আদর্শবাদী, সত্যনিষ্ঠ লেখক। এক সময় নিজের সাহিত্য দর্শন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে সত্যের সম্পর্ক যে নিবিড়, এই কথাটা শুনি অন্নদাশঙ্কর রায়ের মুখে ৩৬-৩৭ বছর আগে। তরুণ বয়সে কথাটা শুনেছিলাম বলেই হোক কিংবা অন্নদাশঙ্কর কথাটা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন বলেই হোক, আমার কাছে ওটা লেখক জীবনের মন্ত্র হয়েই রয়ে গেল।” (‘জীবন, সত্য, সাহিত্য’, জিজ্ঞাসা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৯০)।

এই সত্য-মিথ্যার স্বরূপ নিয়ে সত্যান্বেষী গৌরকিশোরের ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর ‘জবানবন্দী’ গল্পে। এখানে ভবেশবাবু সম্মুখীন হয়েছেন নিষ্ঠুর সত্যের। আবার মধ্যবিত্ত জীবনের অবক্ষয়-অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব-স্বার্থ সঙ্কীর্ণতাও তাঁর ‘অন্ধকূপ’-এর মতো গল্পে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে যাবতীয় মূল্যবোধের বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত মন। আবার যুদ্ধ আবহে গৌরকিশোর লক্ষ করেছিলেন তীব্র খিদের দূষিত গন্ধে ভরে ওঠা শহরকে। হয়তো সেই কারণে যুদ্ধোত্তর কলকাতার রেখাচিত্রও ‘গল্প’ হয়ে ধরা পড়েছে তাঁর কলমে, “ভাঙা একটা টিনের সুটকেস সম্বল করে একদিন কলকাতায় এসেছিলুম। আর এই কলকাতা ছাড়লুম এক ভাঙা মনের তোরঙ্গ ঘাড়ে করে।” (‘এই কলকাতায়’)।

গৌরকিশোর ঘোষ নিজে এক সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার কর্মী হিসেবে রিলিফ কমিটিতে কাজ করেছিলেন, লঙ্গরখানা চালিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে তিনি যুক্তও ছিলেন এক সময়ে। দলের পক্ষ থেকে লালমণিরহাটে রেলকর্মী ইউনিয়ন পরিচালনা করেছিলেন। কাজেই যুদ্ধ-দাঙ্গা-মন্বন্তর, দেশভাগ ও রাজনৈতিক পটভূমিতে ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদতরণী, হা হা’-র মতো গল্প বা ‘প্রেম নেই’, ‘মনের বাঘ’-এর মতো উপন্যাস ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন ‘ম্যানেজার’, ‘একটি হত্যা, একটি লাশ, একটি আততায়ী’-র মতো গল্প।

আসলে ভীরুতা, আত্মসমর্পণ, আত্মরক্ষার জন্য পালিয়ে থাকার পরিণামের কথা স্পষ্ট ভাবে তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসে উঠে এসেছে। প্রচণ্ড হিংস্রতা ও আতঙ্ক নিয়ে ক্লীবের মতো পড়ে থাকাকে তিনি কখনও সমর্থন করেননি। তাই নিষ্ক্রিয় স্থাবর আশ্রয় ছেড়ে তিনি নিজেও পৌঁছতে চেয়েছিলেন সক্রিয়তার জঙ্গমে।

সুদেব মাল, খরসরাই, হুগলি

শূন্য আসন

গৌরকিশোর ঘোষের শতবার্ষিকী উপলক্ষে সুগত বসুর দুই পর্বে প্রকাশিত প্রবন্ধটি সংরক্ষণযোগ্য। আজ গৌরকিশোরের মতো নির্ভীক সাংবাদিকের বড় প্রয়োজন। যে হিন্দু মানুষটি ছোটবেলার বন্ধু আব্বাসের গল্প শোনান, ধরে নিতে হয় তিনি সত্যিই অসাম্প্রদায়িক। অথচ, তাঁর আশপাশের লোকজন গোটা দেশে যে আগুন জ্বালাতে চলেছে, তা থেকে নিজেও যে নিস্তার পাবে না, এটা নিশ্চিত। যে হিন্দু মহিলা হিজাব পরে ইদের নমাজে শামিল হন, তিনি নিশ্চয়ই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। অথচ, এই শহরে কান পাতলেই শোনা যায়, রাজাবাজার, খিদিরপুরের জন্য নিয়ম আলাদা। জঙ্গি মানেই মুসলমান।

যে শহরে একই পাড়ায় এক পাথরে তিলক আর অন্য পাথরে চাদর দেখে বড় হয়েছি, যে শহরে আমার প্রিয় বন্ধু কামাল আমার সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেয়েছে, সে শহরেও অবিশ্বাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এক বন্ধুর মুখে শুনলাম, উত্তরপ্রদেশে মাথায় ফেজ টুপি পরে গরু নিয়ে যদি কেউ এক ঘণ্টা রাস্তায় ঘুরে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন, তবে বুঝতে হবে আল্লা বাঁচিয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই ঠাট্টা, তবু এই ভাবনাটাই সাংঘাতিক। আমাদের শহরে ভাবনার আঘাত কিন্তু চোরাগোপ্তা। দু’-একটা ঘটনা যা সম্প্রতি ঘটেছে তা বিচ্ছিন্ন, বা খুচরো ঘটনা নয়। বরং এর অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যদি অচিরে কোনও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা না করা হয়। মনের শুদ্ধি আসে উদাহরণ দেখে। সুগত চমৎকার লিখেছেন, গান্ধীজি পদযাত্রায় যে সব গ্রাম পেরিয়েছেন, সেই গ্রামে ফিরে এসেছে মানুষ। দেশের বড় প্রয়োজন এমন এক জন নেতার, যিনি সর্ব ধর্মের ঊর্ধ্বে নিজেকে দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত অর্থে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং তাঁর অনুগামীদের শিক্ষিত করতে পারবেন।

ধর্ম মানে ভিন্ন রাস্তা, যা ধরে বিভিন্ন মানুষ একই ঈশ্বরের কাছে মিলিত হন। সেই সচেতনতার অবিরাম প্রচার জরুরি, আর তাই প্রয়োজন গৌরকিশোরের মতো তেজিয়ান সাংবাদিকের, যিনি কখনও নিজের কলম বিক্রি করেননি।

পার্থ সরকার, কলকাতা-৩৩

নির্ভীক প্রতিবাদী

সাল ১৯৭০। নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বরাহনগরে থাকাকালীন গৌরকিশোর ঘোষকে নকশালদের কোপের মুখোমুখি হতে হলেও, আদর্শের দোহাই দিয়ে খুনের রাজনীতিকে তিনি কখনও মেনে নিতে পারেননি। তাঁর শাণিত কলমে এ-হেন হঠকারিতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তীক্ষ্ণ আক্রমণ। নকশালরা ডাক দিয়েছিলেন, ‘গৌরকিশোর ঘোষের মুন্ডু চাই’। পরিচিত শুভানুধ্যায়ীদের অনেকেই তখন ‘রূপদর্শী’-কে বরাহনগরের মতো ‘উপদ্রুত’ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নাছোড়। এমন পরামর্শে কর্ণপাত করেননি, তাঁর কলমও থামেনি। রাতবিরেতে কাজকর্ম সেরে একাই হেঁটে ঢুকতেন পাড়ার রাস্তায়। এই মানুষটিই আবার নকশালদের বিরুদ্ধে যখন পুলিশ নির্বিচারে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেই দমননীতির প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন। ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে বার বার লিখেছিলেন, পুলিশ যে ভাবে নকশাল-নিধন চালাচ্ছে তা অমানবিক।

তিনি ছিলেন উদারপন্থী, ছুতমার্গহীন ভাবধারার মানুষ। ধর্ম, সম্প্রদায় প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কোনও দিনই তাঁর কোনও রকম গোঁড়ামি ছিল না। প্রচলিত রীতি-নিয়মকে তিনি নিজের জীবনেও অবজ্ঞা করেছেন। এর অন্যতম উদাহরণ তাঁর বিবাহ। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলেন। রেজিস্ট্রি সেরে কলেজ স্ট্রিটে বন্ধু অরুণ সরকারের বাড়িতে ফুলশয্যা হয়েছিল। পরে এক দিন আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে অনুষ্ঠান। সেখানে প্রবেশমূল্য ধার্য ছিল পাঁচ টাকা! টিকিট না কেটে প্রবেশ নিষেধ। গৌরকিশোরের বাবাকে পর্যন্ত ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে টিকিট কাটতে হয়েছিল। তাঁর সম্পর্কে এই সব ঘটনা কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে।

সায়ন তালুকদার, কলকাতা-৯০

অক্ষরের ক্ষমতা

আনন্দবাজার পত্রিকা-র শতবর্ষে সম্পাদকীয় ‘শতাব্দীর অঙ্গীকার’ (১০-৭) হৃদয় স্পর্শ করে। পত্রিকার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ভাষণে বর্তমান শাসক দলের সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে রুখতে আহ্বান করেছেন। এই সাবধানবাণী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণকে জাগ্ৰত করার গুরুদায়িত্ব এই পত্রিকাকে অবশ্যই নিতে হবে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে আমি মালদহ জেলা স্কুলের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম। বিকেলবেলা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়ার আগে জেলা লাইব্রেরিতে এক বার খবরের কাগজ পড়ার জন্য ঢুঁ মারতাম। আনন্দবাজার পত্রিকা-য় প্রকাশিত তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের প্রদত্ত ভাষণের কিয়দংশ আমার এখনও মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, জনসাধারণ ছাপার অক্ষরে যা দেখে, তা বিশ্বাস করে। আশা করব আনন্দবাজার পত্রিকা বিধানচন্দ্র রায়ের এই মহৎ বাণী স্মরণে রাখবে।

জহর সাহা, কলকাতা-৫৫

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gour Kishore Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE