দুর্যোগ থেকে ক্ষতি কমাতে প্রস্তুতি, সচেতনতা এবং সমন্বিত পদক্ষেপ কতটা জরুরি, তা বোঝাতে প্রতি বছর ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস দিবস পালিত হয়। অথচ, এই দিনটি পালনের তাৎপর্য খুব কম জনই জানেন। সম্প্রতি দুর্গাপুজোর ঠিক আগে কলকাতায় ২৪ ঘণ্টায় আড়াইশো মিলিমিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হয়েছিল, যা শহরের অনেক এলাকাকে জলমগ্ন করেছে, যান চলাচল ব্যাহত করেছে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে খাস কলকাতাতেই বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। পুজোর পরেই উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি এলাকায়, বিশেষ করে দার্জিলিং, কালিম্পং ও জলপাইগুড়িতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও ভূমিধসের কারণে অনেক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন, সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই পরিস্থিতি দেখায় যে, এই মাত্রার দুর্যোগ কখনও হঠাৎ আসতে পারে না, তাই পূর্ব প্রস্তুতি থাকলে ক্ষতি অনেক কমানো যায়।
মনুষ্যসৃষ্ট দূষণের কারণেই যে প্রকৃতির এ-হেন খামখেয়ালিপনা, তা এত দিনে আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তা রোধে আমাদের সর্বাঙ্গীণ উদ্যোগ আছে কি? দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলি চিহ্নিত করা, নিরাপদ আশ্রয়-কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, বিপদের সময়ে খাবার, জলের সরবরাহ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজকে সক্রিয় ভাবে যুক্ত করা। স্কুল, পরিবার ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ালে শিশু, বয়স্ক এবং দরিদ্রদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এ ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক। দুর্যোগের পর উদ্ধার ও ত্রাণকার্যকে দ্রুত এবং দক্ষ ভাবে পরিচালনা করাও অত্যন্ত জরুরি। আমাদের উচিত বিপদের পূর্বাভাস পাওয়ামাত্র খাদ্য ও জল সংরক্ষণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে থাকা, সতর্কতা মেনে চলা এবং একে অপরকে সহায়তা করা।
আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সবার সচেতনতা ও প্রস্তুতি সমাজকে নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাখতে অপরিহার্য। আগামী দিনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও নিজেদের ও সমাজকে সুরক্ষিত রাখতে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
রাজ ঘোষ, কামালপুর, পূর্ব বর্ধমান
মূল কারণ
সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়, রাস্তা, সেতু, জঙ্গল এবং সংলগ্ন ঘরবাড়িতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, সেই প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় ‘বিপর্যয়ের কারণ’ (৭-১০) খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। যথার্থ ভাবেই এর কারণ হিসেবে সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়, প্রশাসনিক ঔদাসীন্যে হিমালয়ের অতি ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ হয়েছে। দিনের পর দিন উত্তরবঙ্গের নদীগুলির নাব্যতার দিকে নজর না দেওয়া, পাহাড় কেটে বাড়ি-ঘর, রেলপথ নির্মাণ, বৃক্ষ উচ্ছেদ, বিভিন্ন ঝোরা বোজানো, এই সমস্ত নব্য নগরায়ণের জেরে নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য, আলগা হয়ে যাচ্ছে মাটি। ফলে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই পাহাড় থেকে নেমে আসছে ধস, জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে সংলগ্ন জনপদ এবং জঙ্গল।
এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর চিরাচরিত প্রথায় শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক তরজা ও একে অপরকে দোষারোপের পালা। দলীয় রং বদল করলে যেমন সংশ্লিষ্ট দলের নেতা-নেত্রীদের অবস্থান আগের চেয়ে রাতারাতি পাল্টে যায়, তেমনই একদা বিরোধী দল ক্ষমতাসীন হলে বদল ঘটে লক্ষ্যবস্তুরও। ২০১১ সালের আগে বন্যা হলে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ম্যান মেড বন্যা’ বলে দোষারোপ করতেন বামফ্রন্ট সরকারকে। এখন মুখ্যমন্ত্রী হয়েও রাজ্যে ‘ম্যান মেড বন্যা’র তত্ত্ব থেকে তিনি সরেননি বটে, কিন্তু সরকারকে আড়াল করতে লক্ষ্য হয়েছে প্রতিবেশী ভুটান, সিকিম, বিহার, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্য ও ডিভিসি, মাইথন, পাঞ্চেতের মতো জলাধার।
অথচ, ভুটানের নদী থেকে জল প্রবেশ করলে উত্তরবঙ্গের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কোনও আগাম ব্যবস্থা নেই কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলে না। একই রকম ভাবে রাজ্য সরকার নীরব থেকেছে নদী থেকে বালি চুরি, জঙ্গল কেটে সাফ করে দেওয়া, এই সমস্ত অপরাধের ক্ষেত্রে। শুধু উত্তরবঙ্গে নয়, সমগ্র রাজ্যেই নিকাশি ব্যবস্থা যে প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে, তার প্রমাণ মিলেছে সাম্প্রতিক কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে কলকাতা ও শহরতলির জলমগ্ন হয়ে পড়ার ঘটনায়। বিপর্যয়ের মূল কারণ চিহ্নিত করে প্রশাসন যদি এখনই কোনও পদক্ষেপ না করে রাজনৈতিক তরজায় মেতে থাকে, তবে পরবর্তী বিপর্যয়ের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
শিক্ষা নিতে হবে
উৎসবের ছুটিতে প্রতি বছর ভ্রমণপিপাসু বাঙালি সমুদ্র, পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এ বছর দশমীর মনখারাপের রেশ কাটিয়ে না উঠতেই উত্তরবঙ্গের প্রবল বৃষ্টি, ধস এক রাতের মধ্যেই সব উলটপালট করে দিল। প্রবল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল কোথাও সড়ক, বাড়িঘর, আবার কোনও গ্রামের অর্ধেক অংশ। প্রায় ৩০ জনের প্রাণহানি হল, নিখোঁজ আরও অনেক। পাহাড়ের সৌন্দর্য হারিয়ে চারিদিকে প্রকৃতির ধ্বংসলীলা ছড়িয়ে গেল। এক অন্য দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াঙের ছবি ধরা পড়ল পর্যটকদের চোখে। এর কারণ হিসাবে উঠে এল নানা তত্ত্ব। প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিপথকে যদি ব্যাহত করা হয়, সে এক সময় ভয়াল রূপ ধারণ করে, তার প্রমাণ মাঝে মাঝেই আমরা পেয়েছি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বার বার পাহাড়ি এলাকার নিজস্ব প্রাকৃতিক চরিত্রকে বজায় রাখার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আর্থিক লালসা সমস্ত স্বাভাবিকত্বের তাল কেটে দেয়।
এ বছরই আমরা বার বার দেখেছি বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় হড়পা বান, বহু প্রাণহানির ঘটনা। এর থেকে আমাদের শিক্ষা নিতেই হবে। তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা প্রত্যেকটা নদী তার ভয়াল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। এখনই আমাদের সতর্ক হওয়ার সময়। এ নিয়ে প্রশাসনিক চাপানউতোর চলবে, রাজনৈতিক দায় ঠেলাঠেলিও চলবে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তার নিজের বাঁচার জন্য প্রকৃতিকে বাঁচাতেই হবে। পাহাড়, সমতল— হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যেতেই হবে।
দেবদূত মণ্ডল, ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
অবশ্যম্ভাবী
উত্তরবঙ্গের সাম্প্রতিক বিপর্যয় নিয়ে পরিবেশকর্মী ও ন্যাফ-এর কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসুর ‘জল বেরোনোর পথ না পেলে ঘটবে বিপর্যয়’ (৬-১০) শিরোনামে একটি ছোট্ট কিন্তু অমোঘ লেখা পড়লাম। আমরা বৃষ্টিহীন দিনে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে যে যেখানে পারছি বাড়ি-ঘর-হোটেল-ব্যবসা খুলে ফেলছি। পাহাড় কেটে বড় বড় চওড়া রাস্তাঘাট বানাচ্ছি। এই যে মেঘভাঙা বৃষ্টি বা হড়পা বান, এ সব কি আগে হত না? যাঁরা এ সব নিয়ে বহু দিন চর্চা করেন তাঁরা জানেন, এ সব আগেও বহু বার হয়েছে, বিশেষ করে হিমালয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে। কিন্তু এখন আমরা এর ঘন ঘন খবর পাচ্ছি কারণ আমরা প্রকৃতির অন্দরমহলে এমন ভাবে ঢুকে গেছি যে, তার হাঁপ ছাড়ার অবকাশটুকু রাখিনি।
ধারালীর ভয়ঙ্কর ভিডিয়োটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা খেয়াল করলে দেখবেন, বর্ষা, বৃষ্টির দিনে জল-পাথর-কাদামাটি প্রভৃতি বার করার যে খাতটি পাহাড় প্রাকৃতিক নিয়মেই বানিয়ে রেখেছিল বহু বছর ধরে, ধারালী শহর ঠিক তার উপর বসে গিয়েছিল। এই পরিণতি তাই ঘটতই। অনেকটা এমনই এ বার উত্তরবঙ্গে হয়েছে। আমরা সভ্যতা আর উন্নয়নের নামে যে পথে হাঁটা শুরু করেছি, এবং বেশ অনেকটা পথ চলেও এসেছি, সেখান থেকে একেবারে উল্টো দিকে ফেরা হয়তো সম্ভব নয়। যদি না কোনও বিরাট পরিবর্তন এসে বর্তমান এই ধারাটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুন কোনও ধারার জন্ম দেয়।
ইন্দ্রনীল মণ্ডল, কলকাতা-১৬
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)