অতনু বিশ্বাসের ‘সুখের সন্ধানে যাও?’ (২৬-৭) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। সুখের সন্ধান তো সকলেই পেতে চায়। কিন্তু মানুষ কি সত্যিই জানে কিসে তার সুখ? মানুষ যুগে যুগে একটু সুখের সন্ধান পেতে আকুল হয়েছে। পদাবলি কীর্তনেও প্রকাশ পেয়েছে সেই আকুতি, “সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু/ আগুনে পুড়িয়া গেল।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্যে শান্তাকে দিয়ে বলিয়েছেন, “তুমি সুখ যদি নাহি পাও,/ যাও, সুখের সন্ধানে যাও,” মান্না দে’র জনপ্রিয় গানেও সুখের অনুভূতির এমনই প্রকাশ আমরা পেয়েছি, “সবাই তো সুখী হতে চায়/ তবু কেউ সুখী হয় কেউ হয় না।” সম্ভবত তাই নিজেকে সুখে রাখতে এবং অন্যকে সুখ পাইয়ে দিতে আমাদের উদ্যোগের শেষ নেই। প্রবন্ধকার বলেছেন, কোভিড-কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইস্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভাল থাকার ক্লাস করানো হয়েছিল, যা মূলত ‘সুখ’-এর রংচঙে মোড়কে পুরে কাউন্সেলিং-এর প্রচেষ্টা। যাতে স্কুলের ছোট শিক্ষার্থীদের মনকে একটু ভাল রাখা যায়। শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ার আতঙ্ক থেকে ওদের রক্ষা করে একটু ‘সুখ’-এর অনুভূতি এনে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
কিছু বিতর্ক থাকলেও, আমরা যখন ২০০৫-এর একটি গবেষণাপত্রের সূত্রে জেনে গেছি, সুখের ক্ষেত্রে জিন বা বংশগতির প্রভাব ৫০%, ক্রিয়াকলাপের অবদান ৪০%, আর জীবনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বাকি ১০% সুখকে’, তখন বোধ হয় সুখের সন্ধান পাওয়া বা দেওয়ার কাজটা খুব সহজ নয়। সুখের মুখ্য নিয়ন্ত্রক যখন মানুষের মন, তখন মনের চাহিদা মেটাতে মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হয়। আবার মনের পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের চাহিদাও কিছু কম নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে মানুষ ইন্দ্রিয় সুখের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে মনের শাসন অগ্রাহ্য করেছে। দূরে সরে গেছে নীতি, নৈতিকতা, সামাজিক অবস্থানের প্রশ্ন। সুখের উৎস সন্ধান করতে গিয়েই আমরা জানতে পারলাম, মানুষের সুখানুভূতির ক্ষেত্রে ‘স্বার্থপর জিন’-এর একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। মানুষের কার্যকলাপে জিনের প্রভাব ঠিক কতটা, তা অনুমান করা কোনও ব্যক্তির একার পক্ষে সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ তাঁর সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের পরিসর বাড়িয়ে ‘সুখের সন্ধান’ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে কি না, ভেবে দেখা দরকার। হয়তো এই জিনের প্রভাবেই মানুষ নিজের দোষ খোঁজার চেয়ে অপরের দোষ খুঁজতে বেশি ব্যস্ত থাকে। ব্যক্তিগত ‘সুখের সন্ধান’ করতে গিয়ে সমষ্টির সুখকে চিরতরে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে দেখেই কি বিশ্ব জুড়ে অবিরাম সুখের সন্ধান চলেছে?
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
বিসর্জন
অতনু বিশ্বাসের ‘সুখের সন্ধানে যাও?’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, অজানা অসুখে হতাশাগ্রস্ত এক রাজার রোগ সেরে গিয়েছিল খ্যাপাটে এক ভবঘুরের জীবনদর্শন উপলব্ধি করে। যার কোনও চালচুলো নেই, খাওয়াদাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই, পেলে খায়, না পেলে খায় না, কোনও চিন্তা-ভাবনা নেই ইত্যাদি। ছেলেবেলায় পড়া সুকুমার রায়ের ‘রাজার অসুখ’ গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝার বয়স বা মস্তিষ্ক— সেই সময় আমাদের কোনওটাই ছিল না। অনেক পরে আমরা এই গল্পের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। প্রাচুর্য মানুষকে বস্তুবাদী করে এবং সেই প্রাচুর্য থেকে অন্য এক রকম আনন্দ বা তৃপ্তি পাওয়া সম্ভব হলেও তা মানুষকে সুখ বা প্রশান্তির জীবন উপহার দিতে পারে না। অর্থনৈতিক ভাবে যাঁরা সচ্ছল, তাঁদের কাছে বিকল্পের কোনও অভাব নেই। কিন্তু অভাববোধ না থাকা, আর তা থেকে সুখবৃষ্টি বর্ষিত হওয়া, পরস্পর-বিরোধী দু’টি অবস্থান। পৃথিবী জুড়ে সুখের সন্ধানে যে প্রচেষ্টা বা অধ্যয়ন চলছে, তা কোনও কর্মশালা বা পাঠক্রমের মাধ্যমে আয়ত্ত করা সম্ভব কি? কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নাগরিককে সুখে রাখার উদ্যোগ করতে পারে। যেমন— আমেরিকার ঘোষণাপত্রে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের অধিকার প্রদান। কিন্তু এ সবই রাষ্ট্রের একটি প্রচেষ্টামাত্র।
সুখের ব্যাখ্যা প্রান্তিক মানুষের কাছে যে রকম, উচ্চবিত্তের কাছে ঠিক তেমনটি কখনই নয়। তাই নানা স্তরের জীবনশৈলীর মধ্যে গবেষণাপ্রসূত একটি একমাত্রিক সাধারণ তত্ত্ব খাড়া করা এক রকম অসম্ভব। সুখ যে-হেতু মনস্তাত্ত্বিক একটি প্রেক্ষিত, তাই কার জীবনে এটি কী ভাবে আসবে, সেটি সম্পূর্ণ ভাবে তাঁর জীবন-দর্শনের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বের উন্নততর দেশগুলো থেকে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনশৈলী যখন একেবারেই অন্য রকম ছিল, তত দিন পর্যন্ত আমরা হয়তো কম-বেশি সুখী ছিলাম। আজ আমাদের দেশের অধিকাংশ অনুকরণপ্রিয় জনসাধারণের জীবনশৈলীতে সেই পশ্চিমি দেশগুলির পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে। গ্রামগঞ্জে সেই প্রভাব প্রচ্ছন্ন হলেও পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ব জুড়ে উদারনীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঢেউ এবং প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার আমাদের দেখনদারি জীবনশৈলীতে অনেকটা অভ্যস্ত করে ফেলেছে। তাই গ্রামগঞ্জের মানুষের মধ্যে এই ‘অ-সুখ’ ধীরে দেখা গেলেও, তাঁদের জীবন এর প্রভাবমুক্ত নয়।
প্রকৃতপক্ষে, বস্তুবাদী আনন্দ সাময়িক এবং ক্ষণস্থায়ী। আনন্দ আর সুখের ব্যাখ্যাও তাই ভিন্ন, যা হয়তো সমস্ত মানুষের জীবন থেকে পাকাপাকি ভাবে ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছে। ‘সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল’— এই প্রবচন আর এখন খুব একটা শোনা যায় না। কারণ, সুখের জন্য স্বস্তি আমরা অনেক দিন আগেই বিসর্জন দিয়েছি।
পিনাকী রুদ্র, কলকাতা-১২৪
বন্যা রুখতে
সুপ্রতিম কর্মকারের প্রবন্ধ ‘বাঁধ নয়, পলিমুক্তি’ (২৮-৭) প্রসঙ্গে বলি, ঝাড়খণ্ডের পালামু-র উৎসমুখ থেকে ২৯০ কিমি আসার পর রানিগঞ্জের কাছে দামোদর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে প্রবেশ করেছে। তার পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ আগে আমতা হয়ে শ্যামপুরে হুগলি নদীতে মিশত। পরবর্তী কালে তার শেষ অংশ মজে যাওয়ায় আমতার কিছুটা পর থেকে একটি খাল কেটে দামোদরকে গড়চুমুকে হুগলি নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অন্য শাখা মুণ্ডেশ্বরী নাম নিয়ে খানাকুল পার হয়ে রূপনারায়ণের সঙ্গে মিশেছে। এই রূপনারায়ণের স্রোতের টান লক্ষণীয় ভাবে কম। কারণ, এটি এই এলাকার একমাত্র পূর্ববাহিনী নদী। স্বাভাবিক গতির অভাবে মাঝে-মাঝেই পলি জমে ভরাট হয়ে গিয়েছে এর অনেক অংশ। ফলে জল ধরে রাখার ক্ষমতার অভাবে খানাকুল-উদয়নারায়ণপুর এলাকার বন্যা পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। ডিভিসি প্রথম থেকেই একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প। তার উপর ডিভিসির জল ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। সেচের জন্য জমিতে জলের চাহিদা মেটাতে জুলাই-অগস্ট মাসে ডিভিসির জলাধারে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত জল ধরে রাখতে হয়। সাধারণত এই এলাকায় জুলাই-অগস্টের পর তেমন বৃষ্টি হয় না। কিন্তু সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে নিম্নচাপের প্রভাবে ঝাড়খণ্ডের উৎস এলাকায় প্রচুর বৃষ্টি হলে সেই জল ধরে রাখার ক্ষমতা ডিভিসির থাকে না। এই সময় দ্বারকেশ্বরের অববাহিকাতেও বৃষ্টি হলে সেই অনিয়ন্ত্রিত জলের সঙ্গে ডিভিসির ছাড়া জল যুক্ত হয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
নিম্ন দামোদর অববাহিকার হাওড়া এবং হুগলিতে একটা বড় অংশের দুর্দশা মানুষই রচনা করেছে নদীর স্বাভাবিক গতিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে। চতুর্দিকে বাঁধ দিয়ে নদীকে এমন বেঁধেছি, যেখানে বন্যা পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা অসম্ভব। তবে কিছু ব্যবস্থা করা যায়। আঞ্চলিক কোনও মাস্টারপ্ল্যান-এর পরিবর্তে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। কেন্দ্র ও রাজ্যকে যৌথ ভাবে এই উদ্যোগে শামিল হতে হবে।
সৌম্য বটব্যাল, দক্ষিণ বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)