E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অসহনীয় চাপ

এসআইআর-এর গোটা প্রক্রিয়াটিতেই বিএলও-দের দায়িত্ব প্রসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এল। প্রথমত, এত অল্প সময়ে সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে বিএলও-দের উপর যে পরিমাণ কাজ চাপানো হয়েছে, তা কত দূর যুক্তিযুক্ত?

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৫০

“আমার এই পরিণতির জন্য নির্বাচন কমিশন দায়ী”— কথাগুলি স্পষ্টাক্ষরে লিখে সম্প্রতি আত্মঘাতী হয়েছেন নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা এক মহিলা বিএলও। ‘কৃষ্ণনগরে দেহ উদ্ধার বিএলও-র’ (২৩-১১) শীর্ষক সংবাদে প্রকাশিত, তিনি এক জন পার্শ্বশিক্ষিকাও ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলগুলির অলিখিত নিয়ম অনুসারে, তাঁর মতো পার্শ্বশিক্ষক/শিক্ষিকাদের সামান্য বেতনে অধিক পরিশ্রম করতে হয়। চাকরি বজায় রাখার তাগিদে তাঁরা মেনে নিতে বাধ্যও হন। এর উপরে রাজ্যে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়ায় তাঁদের উপর চেপেছে বিএলও-র দায়িত্ব। এই প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যার পথ নিয়েছেন। তাঁর সুইসাইড নোটটিতেও সেই কথাই লেখা আছে। তিনি একা নন, গত কয়েক দিনে অনেকেরই অসুস্থ হয়ে পড়ার সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। মৃত্যু, আত্মহত্যার খবরও মিলেছে। অথচ, ওই একই দিনে প্রথম পাতায় প্রকাশিত “বিএলও-সহায়কে ‘সাড়া নেই’ রাজ্যের” শীর্ষক অন্য সংবাদটিতে দেখা গিয়েছে, কমিশন পাল্টা অভিযোগ করেছে যে, রাজ্য সরকারের কাছে বিএলও-দের সহায়তা করার জন্য যে সব দাবি পেশ করা হয়েছিল, তাতে মান্যতা দেয়নি নবান্ন। উভয় তরফের চাপানউতোরে আটকে থাকছে বুথ লেভেল অফিসারদের যন্ত্রণা লাঘবের বিষয়টি।

এসআইআর-এর গোটা প্রক্রিয়াটিতেই বিএলও-দের দায়িত্ব প্রসঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এল। প্রথমত, এত অল্প সময়ে সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে বিএলও-দের উপর যে পরিমাণ কাজ চাপানো হয়েছে, তা কত দূর যুক্তিযুক্ত? বিশেষ করে, যাঁদের এই কাজে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তাঁদের পক্ষে নিখুঁত ভাবে প্রতিটি ধাপ নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করা কি সম্ভব? দ্বিতীয়ত, শিক্ষক-শিক্ষিকারা অ্যানড্রয়েড ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহারে স্বচ্ছন্দ না হলে তাঁরা অফলাইনের কাজ হয়তো শেষ করে ফেলবেন, কিন্তু অনলাইনে সেই তথ্যগুলি তুলবেন কী করে? বস্তুত এই সমস্যা অনেক বিএলও-র ক্ষেত্রেই প্রবল হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, কাজের সময়ে লিঙ্ক না পাওয়া, দীর্ঘ সময় সার্ভার ডাউন থাকা সময়ে কাজ শেষ করতে দিচ্ছে না। চতুর্থত, বিএলও অ্যাপ বার বার আপডেট হওয়ায় তাল রাখতে সমস্যা হচ্ছে। একই অবস্থা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের বার বার নিয়ম পরিবর্তনের কারণেও। পঞ্চমত, কোনও ছুটি ছাড়া একটানা কাজ করা বাস্তবে কত দূর সম্ভব? একেবারে হাসপাতালে ভর্তি না হলে বা পরিবারের কারও মৃত্যু না হলে রেহাই মিলছে না। ষষ্ঠত, সুপারভাইজ়রদের কোনও সমস্যা বিষয়ে জানালেও তার প্রতিকার হচ্ছে না— এই বিষয় নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। সর্বোপরি, অজানা-অচেনা জায়গায় মহিলা বিএলও-দের সন্ধ্যার পর কাজ করতে হলে নিরাপত্তার প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে। সে বিষয়ে কমিশন কোনও ব্যবস্থা করেছে কি?

আগামী দিনে বিএলও-দের বাস্তব সমস্যাগুলির প্রতি নির্বাচন কমিশনকে আরও অনেক বেশি মানবিক হতে হবে।

সুচরিতা সান্যাল, কলকাতা-৩৩

কিছু প্রশ্ন

নির্বাচন কমিশনের কাছে এসআইআর বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। এক, কোনও মহিলার ১৯৯০-এ জন্ম। পড়াশোনা প্রাথমিক পর্যন্ত। ২০১০-এ বিয়ে, পরে শ্বশুরবাড়ির পদবিতে ভোটার তালিকায় নাম তোলেন। সে ক্ষেত্রে ২০০২-এ বাবা-মায়ের নাম থাকলেও উনি তাঁদের সঙ্গে ‘লিনিয়েজ’ কী ভাবে প্রমাণ করবেন? দুই, কোথাও বাংলায় এনুমারেশন ফর্ম দেওয়া হয়েছে, কোথাও ইংরেজিতে। অথচ বেশির ভাগ ভোটার তালিকা (২০০২ বা ২০২৫) বাংলায়। কম্পিউটারে বিএলও অ্যাপ ইংরেজিতে। কোন হরফে লিখবেন ভোটার? বানান ভুল হলে কার দায়িত্ব? তিন, অনেকেই ২০০২-এ নাম তোলাননি, বা তুলতে পারেননি, তাঁদের ক্ষেত্রে কী হবে? চার, এসআইআর-এর ফর্ম পূরণের নির্দিষ্ট নির্দেশাবলি সম্বলিত কোনও গাইডলাইনের লিঙ্ক কি আছে? ছাপা বা অনলাইনে। নানা বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে এ বিষয়ে। পাঁচ, পিতা প্রয়াত হলে কার নাম দেওয়া সঙ্গত? প্রয়াত হলে কি লেট/প্রয়াত লেখার জায়গা আছে? ছয়, ২০২৫ অংশে কি প্রয়াত পিতা বা মাতার ভোটার কার্ড নম্বর দেওয়া যাবে? সাত, যাঁদের নাম নেই, তাঁদের জমি বা ফ্ল্যাটের দলিল কি গ্রাহ্য হবে? পাট্টা সরকারি। দলিলও তো সরকারের জায়গায় রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। পর্চাও সরকার দেয়। পাট্টা গ্রাহ্য হলে সরকারের দেওয়া দলিল বা পর্চা কেন হবে না? আট, ২০০২ এবং ২০২৫-এ ভোটার তালিকায় প্রচুর নামের ও পদবির বানান ভুল আছে। সেগুলি কী ভাবে ঠিক করবেন ভোটাররা? নয়, ধরা যাক, সংশ্লিষ্ট ভোটারের নাম ২০০২-এর ‘এসআইআর’ তালিকায় ছিল না, তবে তাঁর বাবা-মা-ঠাকুরদা-ঠাকুমার ছিল। তিনি অনলাইনে ওই অপশন বেছে নিয়ে ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়ে ২০০২-এর লিস্ট মিলিয়ে বাবা-মায়ের বিধানসভা কেন্দ্র, পার্ট নম্বর, সিরিয়াল নম্বর সব যথাস্থানে ফিলআপ করার পরে সার্চ অপশনে গেলে স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ‘নো ডিটেলস ফাউন্ড’। তার পরে ফর্ম আর পূরণ করা যাচ্ছে না। দশ, কোনও মহিলার ভোটার কার্ডে বিয়ের আগে পদবি এক রকম ছিল, পরে পদবি বদলেছে। তাঁর এপিকে সেই পদবি বদলায়নি, অথচ আধার কার্ড যে-হেতু পরে হয়েছে সেখানে বর্তমান পদবি-সহ আপডেটেড তথ্য রয়েছে। এপিক-আধার কার্ডের তথ্যের মধ্যে ফারাক থাকলে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করাই যাবে না। কেন এই বৈষম্য? এগারো, পুরনো এপিক কার্ডে অনেকেরই নাম, বাবা বা স্বামীর নাম, সম্পর্ক, নামের বানানে ভুল আছে। অনেকে হয়তো সেই কার্ড বদলাননি। তাঁরা এখন ভিন রাজ্যে বা দেশে থাকলে কী ভাবে ফর্ম পূরণ করবেন? এপিক ও আধারের নাম ও বানানে ফারাক থাকলে ফর্ম ফিলআপ করা যাবে না। বারো, অনেকে ভিন দেশ থেকে কমিশনের সাইটে লগ-ইন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। তাঁরা কী করবেন? তেরো, কেউ অনাথ আশ্রমে মানুষ। তাঁর স্ত্রী-ও। তাঁদের ২০০২-এ ভোটার লিস্টে নাম নেই। তাঁরা কী করবেন? একই ভাবে, বৃদ্ধাশ্রমে যাঁরা আছেন তাঁদের নথি কে দেবেন, রাস্তায়, স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে যাঁরা থাকেন, তাঁদের নাম কী ভাবে উঠবে?

আরও কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন এক, এসআইআর ফর্ম পূরণের গাইডের লিঙ্ক কি আছে ভোটারদের জন্য? লিখিত আদেশনামা মেমো নম্বর সমেত? দুই, ইউটিউব বা সাংবাদিক সম্মেলনে বলা বক্তব্য কি গ্রহণযোগ্য? লিখিত নির্দেশ দেওয়া হলে তার কপি কোথায়? তিন, নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত মুখপাত্র কে? তাঁর কথাই কি শেষ কথা? লিখিত আদেশনামা ছাড়া তিনি কি নতুন কিছু যোগ বা বিয়োগ করতে পারেন? চার, ফর্মে মোবাইল নম্বর দিতে হচ্ছে। এটা ভোটার কার্ডের সঙ্গে লিঙ্ক করা হবে কি? পাঁচ, একটি নম্বর কি পরিবারের সব ভোটারের ফোন নম্বর হিসেবে ব্যবহার করা যাবে? ছয়, পশ্চিমবঙ্গে যে এসআইআর হচ্ছে, তার সরকারি গেজেট কবে কোথায় প্রকাশিত হয়েছে? সাত, ফেসবুকে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশন ১১ দিন পর ফর্ম পূরণ বিধি প্রকাশ করেছে। যাঁরা ফেসবুক করেন না, তাঁরা কী ভাবে জানবেন এই নিয়ম? আট, বাবার নাম ২০০২-এর লিস্টে আছে, কিন্তু নিজের নাম নেই। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড সব স্বামীর নাম দেওয়া আছে ‘গার্জেন’ হিসেবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। কোন কাগজ দেখালে বাবার নামের সঙ্গে সম্পর্কের লিঙ্ক করা যাবে? নয়, নিজের, বাবা, মায়ের নাম, জন্ম তারিখ, ফোন নম্বর, আধার নম্বর সব নেওয়া হচ্ছে। এগুলি হ্যাকাররা পেলে ভোটারদের অনলাইন জালিয়াতি কি সহজ হয়ে গেল না? আধার কার্ডের সময় ১৩ কোটি তথ্য ফাঁস হয়েছিল। এ বার? দশ, বিএলও অ্যাপ কত বার বদল হয়েছে? এবং কেন? এত প্রস্তুতিহীন কাজ কেন? এগারো, এক বার বলা হল মৃত ব্যক্তির ফর্ম দেওয়া যাবে না। আবার বলা হল দেওয়া যাবে। সব মিলিয়ে চার বার চার রকম নির্দেশ? এত দিশাহারা কমিশন ভোটারদের ভুল ধরবে কোন উপায়ে? বারো, এত ভুল কেন, বিশেষ করে মুসলিমদের নামের বানানে? সর্বোপরি, ২০ দিনে সাড়ে সাত কোটির বেশি ভোটারের তথ্য সংগ্রহ সঠিক ভাবে সম্ভব?

ঋত রায়চৌধুরী, কলকাতা-৬৪

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Special Intensive Revision BLO Mental Depression Work Pressure Election Commission of India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy