কৌশিক সেনের ‘যে বোধকে শাসক ভয় পায়’ (২-৯) প্রবন্ধটি আপাতদৃষ্টিতে সাম্প্রতিক আর জি কর হাসপাতালের এক মহিলা-চিকিৎসকের কর্মরত অবস্থায় ধর্ষণ ও নির্মম ভাবে খুনের বিরুদ্ধে এক প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী তথা শিল্পীর প্রতিবাদরূপে পরিগণিত হতে পারে। কিন্তু প্রবন্ধে বরেণ্য চিত্রপরিচালক মৃণাল সেনের কালজয়ী ছবিগুলির উল্লেখ আমার অন্তত তেমন প্রাসঙ্গিক মনে হল না। এ বার ছবিগুলোর প্রেক্ষাপটের ব্যবচ্ছেদ করা যাক। একদিন প্রতিদিন ছবিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি চাকরিরতা মেয়ের সারা রাতভর না ফেরার ইতিবৃত্তকে পরিচালক ফ্রেমবন্দি করেছেন। মেয়েটির ফিরে আসা ও পারিবারিক স্বস্তিকে মৃণালবাবু প্রকাশ করেছেন, আবার উনুন ধরলো। বার্তা একটাই, ঘটনাক্রমের বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন। মহিলা-চিকিৎসকের নির্মম পরিণতির পর তার গৃহে না প্রত্যাবর্তনের মর্মান্তিক ঘটনা কি একদিন প্রতিদিন-এর তুল্য, বোধ হয় না। বরং মর্মবিদারক বাস্তব। আজ এই হাড়হিম করা ঘটনা নিয়ে গোটা রাজ্য যে সঙ্গত কারণে আন্দোলনে উত্তাল, সেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের প্রশ্নে মৃণাল সেনের কোরাস ছবিটির উল্লেখ ঠিক স্পষ্ট নয়। কোরাস প্রধানত সত্তরের দশকের বেকারত্বের একটি দলিল। এবং মৃণালবাবুর আপন রাজনৈতিক চিন্তন প্রক্রিয়ার প্রকাশ। প্রবন্ধটির পরতে-পরতে প্রবন্ধকার প্রতিবাদের ভাষার সঠিক মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু আমি অন্তত কষ্টকল্পিত ভাবেও মৃণাল সেনের বিখ্যাত ছবিগুলোর (কোরাস, পদাতিক, ইন্টারভিউ) সঙ্গে বর্তমানের বহুমুখী ঐতিহাসিক আন্দোলনের সাযুজ্য পেলাম না। বরং পরিশেষে পদাতিক-এর উল্লেখ কিছুটা হলেও মর্মস্পর্শী, বর্তমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। প্রবন্ধকারের কাছ থেকে এই উত্তাল রাজ্য তথা দেশব্যাপী আন্দোলনের মূল্যায়নে আরও প্রণিধানযোগ্য মতামত আশা করেছিলাম।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
অপ্রাসঙ্গিক
আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি প্রতিবাদ করাই কৌশিক সেনের মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে বলতেই হয় তাঁর প্রবন্ধটিতে তার ছিটেফোঁটাও ব্যক্ত হয়নি। প্রবন্ধকার কিছু জানা কথাকেই নাটকীয় ভঙ্গিতে বলেছেন।
আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে মৃণাল সেন তাঁর কোনও একটি ছবিতে যে কথা পরিবেশন করেছেন, আজকের পটভূমিতে তা অপ্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি সে দিনের সমস্যা আর আজকের সমস্যাও এক নয়। বলা বাহুল্য, আজকের সমস্যা অনেক জটিল ও সুদূরপ্রসারী। সে দিনের প্রতিবাদের সঙ্গে আজকের প্রতিবাদকে এক সারিতে রাখা যায় না। সে দিন ছবিতে একটি মেয়ে রাতে বাড়ি ফিরতে পারেনি, ফিরেছে পর দিন সকালে এবং বেঁচে। আজকে রাতের অন্ধকারে পরিকল্পিত ভাবে বাস্তবের এক বিদুষীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তার সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। মেয়েটি কোনও দিনই আর বাড়ি ফিরবে না।
এটা নাটক বা সিনেমা নয়। তাই আজকের নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের ভাষা অন্য রকম। প্রতিবাদ চোখে চোখ রেখে সম্মিলিত ভাবে মানবহত্যার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের গাফিলতির বিরুদ্ধেও।
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
দৃষ্টিভঙ্গি
‘যে বোধকে শাসক ভয় পায়’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কলকাতার এক হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদের ঝড় এই শরতের রোদ্দুরকেও ম্লান করেছে। মহানগর জুড়ে ধর্ষণ কাণ্ডে যখন সমগ্র সমাজ উত্তাল, তখন দেশের অন্যত্র ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত প্রমাণের অভাবে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে এবং ফুল মালায় তাদের বরণ করে নেওয়া হচ্ছে।
গত বছর প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতেই আইআইটি-বিএইচইউ’এর ছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনায় বিজেপির আইটি সেলের তিন সদস্য গ্রেফতার হয়েছিলেন। অভিযুক্তরা গ্রেফতারের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রমাণের অভাবে জামিন পেয়ে গেলেন এবং জেল থেকে বেরোনোর পর তাঁদের ফুল মালা দিয়ে স্বাগতও জানানো হল। সংবাদে প্রকাশ, তিন অভিযুক্ত কুণাল পান্ডে, অভিষেক চৌহান ও সক্ষম পটেল বিজেপির আইটি সেলের পদাধিকারী। সে সময় নরেন্দ্র মোদী, যোগী আদিত্যনাথ, জে পি নড্ডা-সহ বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ওই তিন জনের ছবিও প্রকাশ্যে এসেছিল। বিলকিস বানো মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের মুক্তি পাওয়ার পরেও তাদের এ ভাবে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
আমাদের দেশ ধর্ষণ নামক জঘন্য কাণ্ডটিকে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে, তা এই সকল ঘটনাতেই পরিষ্কার। এ দেশে ধর্ষণকাণ্ডে অপরাধীদের দ্রুত সাজার পক্ষে সওয়াল করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একই সুরে কথা বলেছেন। অথচ, ঘটনা ঘটার অব্যবহিত পরেই যদি সমাজের এক দল ক্ষমতাবান লোক প্রমাণ বিলুপ্ত করতে উঠে পড়ে লাগে, তা হলে অভিযুক্তরা চিরকালই প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রযন্ত্র মুখে যতই নারী-নির্যাতনকে অভিশাপ বলে মনে করুক এবং অতি কঠোর আইন প্রণয়ন করুক, অভিযুক্ত আসামি (কিংবা সংগঠিত অপরাধের ক্ষেত্রে একাধিক অপরাধী) প্রমাণের অভাবেই বেকসুর খালাস হয়ে যাবে।
কলকাতায় আর জি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবশালী অধ্যক্ষ দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর আর্থিক কেলেঙ্কারির পাশাপাশি খুন ও ধর্ষণের মামলায় প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডলও। রাজ্যের শাসক দলও যতই অভিযুক্তের ফাঁসির দাবি নিয়ে সরব হোক, এবং সিবিআই-এর উপর চাপ বাড়ানোর রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করুক, ঘটনার যথাযথ প্রমাণ ছাড়া তদন্তকারী দল কখনও দ্রুত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে না।
যদিও ধর্ষণ কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যের বিচারে সারা ভারতে পশ্চিমবঙ্গ বেশ সন্তোষজনক অবস্থানেই রয়েছে, তা সত্ত্বেও আত্মতৃপ্তির কোনও জায়গা নেই। শাসককেও মেনে নিতে হবে যে, সুস্থ গণতন্ত্রে প্রতিবাদের ঝড় উঠবেই। সংগঠিত প্রতিবাদ সুস্থ গণতন্ত্রেরই প্রতীক। রাজ্যের শাসক দলকেও তাকে কুর্নিশ জানাতে হবে।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
শিক্ষা জরুরি
দেবশ্রী সরকারের ‘মেয়ে, অতএব দোষী’ (১-৯) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে নারীরা যেন মেনে নিয়েছে। বাহ্যিক কিছু পোশাকের পরিবর্তন হলেও সমাজের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যুগোপযোগী মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হয়নি। এখনও অনেক নারী পুত্র এবং কন্যা মানুষ করার সময় বৈষম্য বজায় রাখেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রয়োজন। এর জন্য তৃণমূল স্তর থেকে নারী ও পুরুষ উভয়েরই সঠিক শিক্ষা জরুরি। রাজ্যের সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শরীরচর্চার ক্লাস রাখা আবশ্যক। যেখানে থাকবে ক্যারাটে, কুস্তি, জুডো ইত্যাদি। এতে ছোট মেয়েদের মধ্যেও শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই জোর বাড়বে। এর পাশাপাশি ছোট বয়স থেকেই স্কুল ও বাড়িতেও তাদের শেখাতে হবে ‘ভাল ও মন্দ’ স্পর্শের প্রভেদ বোঝা। এতে ছোট মেয়েরাও নিজেদের বিপদ সময়মতো বুঝতে পারবে।
আজ মেয়েরা পুলিশ-সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, বিমান চালক হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে, বক্সিং, হকি, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলাতে দেশকে স্বমহিমায় এগিয়ে নিয়ে চলেছে। যে দেশের প্রায় প্রত্যেকটি দেবীর হাতে থাকে অস্ত্র, সেই দেশে নারীরা দুষ্কৃতীদের সামনে অসহায় হবে কেন?
শ্রাবন্তী হালদার, কলকাতা-৩৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy