Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: উৎকৃষ্ট বিপণন

বিশ্বাসের নিরীক্ষার চেয়ে বিশ্বাসের দীক্ষা এ দেশে তীব্র। এ যুগেও তুকতাক, জাদুটোনা, জলপড়া, তাবিজ-কবচের অলৌকিকতায় বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা প্রচুর।

শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ০৭:৩৩
Share
Save

তাপস কুমার দাস-এর লেখা ‘শেষ অবধি রাজনীতির ক্রীড়নক’ (২৪-১) শীর্ষক প্রবন্ধের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত। আকর্ষণীয় চাকরি হেলায় ছেড়ে দিয়ে মহাকুম্ভে ‘আইআইটি বাবা’ হিসাবে চিহ্নিত অভয় সিংহ হাজার সাধু-সন্তদের ভিড়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁর ‘ব্র্যান্ডিং’-এর পিছনে স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের ভূমিকা কোনও গোপন কথা নয়। এ দেশের আত্মা এখনও বহুলাংশে অন্ধ সংস্কারের মোহজালে বিজড়িত। বিশ্বাসের নিরীক্ষার চেয়ে বিশ্বাসের দীক্ষা এ দেশে তীব্র। এ যুগেও তুকতাক, জাদুটোনা, জলপড়া, তাবিজ-কবচের অলৌকিকতায় বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা প্রচুর। তাই রকেট উৎক্ষেপণের আগে যাগযজ্ঞের ঢালাও আয়োজন করা হয়, মহাকাশযান চাঁদের দক্ষিণ মেরু স্পর্শ করা মাত্র সেই স্থান কোনও ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীর নামে নয়, ‘শিবশক্তি’ নামে নামকরণ করা হয় রাষ্ট্রীয় ফরমানে।

দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি চায় অধ্যাত্মবাদের প্রচার ও প্রসার। স্বভাবতই বিজ্ঞানমনস্কতার ও যুক্তিবাদী চেতনার সঙ্গে তার বিরোধ অনিবার্য। যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতা প্রশ্ন করতে শেখায়। বেদ ও মনুবাদী সংস্কৃতির আবার প্রশ্নকে বড় ভয়। তার দাবি সীমাহীন আনুগত্য। বৈদিক বিমান, গণেশকে প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন বা পুরাণকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দিতে তাঁরা কুণ্ঠিত নন, ডারউইন বা নিউটনের তত্ত্বকে অসাড় বলে প্রচার করতেও। রামমন্দিরে রামলালার প্রতিষ্ঠার দিন দেশের স্বাধীনতা দিবস বলে ঘোষণা করতে তাঁদের সঙ্কোচ হয় না। সেই আবহে অধ্যাত্মবাদ বা গুরুবাদকে মহিমান্বিত করার জন্য পূর্বাশ্রমের আইআইটি বাবার চাইতে উৎকৃষ্ট বিপণন আর কী হতে পারে? রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে বহু আত্মত্যাগী সন্ন্যাসী-মহারাজ রয়েছেন যাঁরা প্রাচুর্য ও বিলাসের হাতছানি এড়িয়ে ত্যাগের কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন। বিলাস-বৈভবের বিপ্রতীপে অধ্যাত্মবাদের ‘আইকন’ হয়ে ওঠার জন্য তাঁদের কোনও আলোকবৃত্তের মধ্যে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হয়নি।

আজকের এই ‘বাবা’রা নিজের অজানতেই ধর্ম-ব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল।

সরিৎশেখর দাস, কলকাতা-১২২

মোহান্ধ

‘শেষ অবধি রাজনীতির ক্রীড়নক’ প্রবন্ধে তাপস কুমার দাসের বিশ্লেষণ যথার্থ। আমরা নিজেরাই আত্মজিজ্ঞাসা করতে পারি, সাফল্যের উত্তুঙ্গ শিখরে পৌঁছে, সেই সাফল্য হেলায় পিছনে ফেলে ত্যাগের পথ গ্রহণ করার জন্যই যদি এই মানুষটি এত জনপ্রিয় হয়ে থাকেন, তা হলে এই ধরনের আরও অনেক ব্যতিক্রমী মানুষের দৃষ্টান্ত কেন আমাদের গোচরে আসে না?

লেখক এমনই উদাহরণ হিসাবে অলক সাগরের উল্লেখ করেছেন। আইআইটি দিল্লির প্রাক্তন এই অধ্যাপকের কথা জানা গিয়েছে ক্রিকেটার ভিভিএস লক্ষ্মণের সৌজন্যে, মানুষটি নাকি একাই লাগিয়েছেন ৫০ হাজার গাছ। কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছেন মধ্যপ্রদেশে জনজাতি গোষ্ঠীর উন্নয়নে শামিল হবেন বলে। কিন্তু এমন এক জন সর্বত্যাগী মানুষের কথা কেউ জানতই না। বেতুল জেলায় নির্বাচনের সময় পুলিশ অলক সাগরকে সন্দেহভাজন ব্যক্তি মনে করায় তিনি জনসমক্ষে নিজের পরিচিতি আনতে বাধ্য হন।

এডওয়ার্ড সাইদ ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, বছরের পর বছর ধরে বিশ্বের পূর্বাংশকে ছকে বাঁধা কিছু ছবির মাধ্যমে দেখতে অভ্যস্ত পাশ্চাত্য। যেমন ভারত হল ম্যাজিক, বাঘ, সাপ আর সাধুদের দেশ, আধ্যাত্মিকতাই ভারতের একমাত্র শক্তি ইত্যাদি। তবে এই স্টিরিয়োটাইপ তৈরি হওয়ার জন্য শুধু পাশ্চাত্যকেই দায়ী করা অনুচিত। আমাদের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ইসরো) প্রধান পর্যন্ত বলেছেন, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু দ্বন্দ্ব তো অবশ্যই আছে— দ্বন্দ্ব আছে বিশ্বাসনির্ভর ধর্মের সঙ্গে। ‘বেদে সব আছে’ বলে যাঁরা প্রচার করেন তাঁদের সঙ্গে কি বিজ্ঞান একমত হতে পারে?

আসলে আমরা স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ‘অমৃত মহোৎসব’ উদ্‌যাপন করলেও ঔপনিবেশিকতার মোহজাল থেকে মুক্ত হতে পারিনি। আইআইটি-র এক প্রাক্তনী তাই সাধু হলে নিমেষে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, আর অন্য দিকে এক প্রাক্তনী বিশাল সম্পত্তি ছেড়ে নীরবে জনসেবা করলেও দশকের পর দশক ধরে লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যান। কারণ, তিনি কোনও আখড়ায় নয়, কাজ করছেন জনজাতি গোষ্ঠীর উন্নয়নে, প্রকৃতি সংরক্ষণের। প্রশ্ন ওঠা উচিত— কোনটি বেশি জরুরি।

সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪

সেই ফাঁদ

তাপস কুমার দাস-এর ‘শেষ অবধি রাজনীতির ক্রীড়নক’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে রাজনীতির ভরকেন্দ্র ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ থেকে অপসৃত হয়ে ধর্ম বা ধর্ম-বিষয়ক মৌলবাদে স্থানান্তরিত হচ্ছে। আইআইটি বাবা অভয় সিংহ রাজনৈতিক ব্যাপারীদের হাতে পড়ে একটি উন্নত মানের রাজনৈতিক পণ্যে পরিণত হয়েছেন, হয়তো তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে নরেন্দ্র দাভোলকরের নাম বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি নিজের অসামান্য কেরিয়ার হেলায় ফেলে দিয়ে এসে মহারাষ্ট্রে যে সমিতি গড়লেন, তা ধর্মীয় কারবারিদের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। ভাববাদী দর্শনের বিপ্রতীপে যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেই তিনি যুক্তিবাদী দর্শনের সর্বভারতীয় প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কখনওই রাজনীতিকদের ক্রীড়নকে পরিণত হননি। বরং যুক্তিবাদী দর্শনকে সঙ্গী করে ধর্মীয় রাজনীতির মুখোমুখি হয়েছিলেন বলেই বুঝি জীবন দিয়ে তার মূল্য চোকাতে হয়েছিল— যে ইতিহাস আমরা কমবেশি সবাই জানি।

সুতরাং আইআইটি বাবাকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলোয়াড়রা লোফালুফি করবেন, এবং লাভের ফসল ঘরে তুলবেন, এও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আইআইটি বাবা ধর্মতত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও ধর্মশাস্ত্র চর্চার দেওয়াল ঘেরা বৃত্তে পা না রাখলেই বোধ হয় ভাল করতেন। এখানে যুক্তির আলো, মুক্তবুদ্ধির বাতাস কিংবা খোলা মনের এক টুকরো আকাশ নেই, কিন্তু প্রতি পদে শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য, কল্যাণগড়, উত্তর ২৪ পরগনা

ভিন্ন ধারার

‘শেষ অবধি রাজনীতির ক্রীড়নক’ প্রবন্ধে একটি তথ্যের সংশোধন সংযোজন। শঙ্কর গুহনিয়োগী— যাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড মনে রাখা জরুরি বলে প্রবন্ধে উল্লিখিত, তিনি চিকিৎসক ছিলেন না। সত্তরের দশক থেকে শুরু করে পরের দু’দশক দেশে শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনে নতুন ধারার পথিকৃৎ তিনি। অধিকার বুঝে নেওয়া ও পাওনা আদায় ছাড়াও শ্রমিকদের সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত ও তা অবশ্যই সম্ভব— রাজনীতিতে এই ভাবনার উদ্ভাবন ও প্রয়োগ তাঁর নেতৃত্বে। শ্রমিক-সন্তানদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, নেশামুক্তি, সাফাই অভিযান, পাঠাগার চর্চা, সাংস্কৃতিক অনুশীলন সবই ছিল তাঁর ‘নির্মাণ ভাবনা’র অন্তর্গত। মালিক ও প্রথাগত শ্রমিক সঙ্ঘ— কোনও পক্ষের অন্যায়কেই তাঁর কর্মধারা স্বস্তি দেয়নি। ১৯৯১-র ২৮ সেপ্টেম্বর, ভোররাতে ভিলাই-এর বাসগৃহেই শঙ্কর গুহনিয়োগীর জীবন থেমে যায় আততায়ীর গুলিতে।

মানস দেব, কলকাতা-৩৬

চাই সদিচ্ছা

‘বইমেলার জঞ্জালে ভরে আছে মাঠ, সাফাইয়ের দায় নিয়ে চাপান-উতোর’ (১-৩) প্রতিবেদন প্রসঙ্গে এই চিঠি। মেলা শেষ হওয়ার পর পরিবেশকে রক্ষার দায়িত্ব মেলা কর্তৃপক্ষ ও স্টল-মালিকদের। তাঁদের সবার যৌথ প্রচেষ্টায়, সদিচ্ছা থাকলে মেলা প্রাঙ্গণ দ্রুত পরিষ্কার হতে বাধ্য।

রীতা পাল, কলকাতা-২৪

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

IIT Baba Hinduism

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}