Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অন্তরে অধিষ্ঠাত্রী

পাশ-ফেলের ধারণাটি এ প্রজন্মের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়, ফলে এই প্রার্থনা দেবীর কাছে আর খুব একটা কেউ করে বলে তো জানি না।

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:৩৪
Share
Save

সরস্বতী পুজোর সঙ্গে প্রতিটি প্রজন্মের বেশ কিছু স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। নব্বইয়ের দশক নাগাদ কোচিং ক্লাসের রমরমার সময়ে স্কুলের পুজোর পাশাপাশি কোচিং সেন্টারের পুজোও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন এই পুজোকে ঘিরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত ছিল, এ সব নিয়ে কত সাহিত্য কত স্মৃতি কত লেখাজোখা। আগে দেবীর কাছে কত পাশ করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রণাম-পুষ্পাঞ্জলি অর্পিত হত, বিশেষত তখন বসন্তই ছিল ফাইনাল পরীক্ষারও মরসুম। পাশ-ফেলের ধারণাটি এ প্রজন্মের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়, ফলে এই প্রার্থনা দেবীর কাছে আর খুব একটা কেউ করে বলে তো জানি না। বরং সরস্বতী পুজোর দিন এখন বাঙালির প্রেমদিবসে পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে। সেও নেহাত মন্দ নয়। যুগ ও সময়ের দাবিকে সম্ভবত দেবীও উপেক্ষা করতে পারেন না। তবে মাঝখান থেকে অধ্যয়ন আর সংস্কৃতি চর্চা এখন গৌণ বিষয় হয়েছে।

তবু দেবী আছেন। পাড়ার মোড়ে, গ্রামের ছায়াঘেরা বাঁশবনের ভিতরে, নানা রকম ক্লাবে, রং ওঠা ফাটা দেওয়ালের স্কুলের ক্লাসঘরে, ঝাঁ-চকচকে বেসরকারি স্কুলের মার্বেল পাথরের মেঝেতে, বাড়ির কোণে— সব জায়গায় তিনি পূজিত। শুধু নস্টালজিয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে চান যাঁরা, তাঁদের মনে নিশ্চিত ভাবে অবস্থান করেন এই দেবী। আবার যাঁরা বর্তমানের কঠিন জমিতে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের কাছে দেবীর আসন ঘিরে নানা সংশয়, চিন্তা। তাঁর যেখানে আসল অবস্থান, সেই মন্দির নিয়ে আমরা ক’জন ভাবি? ভেবে দেখেছি কি, অন্য সকল দেবদেবীর মন্দির থাকলেও এই দেবী সরস্বতীর কিন্তু সেই অর্থে মন্দির কোথাও নেই। আসলে তিনি হলেন বাগ্‌দেবী। তাঁর অবস্থান আলাদা কোনও স্থানে নেই। এক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের মধ্যেই তাঁর অবস্থান দেখা যায়। সেই মানুষটি কেমন কথা বলেন, কেমন আচরণ করেন, কতটা সংস্কৃতি-মনস্ক— এই গুণাবলিই তো দেবী সরস্বতী। তাই তাঁকে খুঁজতে আলাদা কোথাও যেতে হয় না, মানুষের অন্তরই তাঁর মন্দির। তবে আজকাল দেবী পূজার সংখ্যা যেমন কমছে, দেবীর কৃপাধন্য মানুষও কেমন যেন ম্যাজিকের মতো উবে যেতে বসেছে।

শঙ্খ অধিকারী, সাবড়াকোন, বাঁকুড়া

আসল নকল

রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরস্বতীর হার-জিত’ (রবিবাসরীয়, ২-২) প্রবন্ধ পড়ে কিছু কথা যেন মনের বাইরে বেরিয়ে ভবিষ্যতের পাতায় কী একটা লিখে দিয়ে গেল! আমরা হয়তো বাহ্যিক দৃষ্টিগোচর নির্জীব বস্তুকে নিয়ে এমন যুদ্ধে মেতেছি, যাতে হার-জিতটা ক্রমশ অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ধরছে। সবাই তার নিজের মতো করে সমাজমাধ্যমে নিজের কাঙ্ক্ষিত জিতটাকেই মেলে ধরে এক ছদ্মআনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়, ভুলে যায় কবে শেষ প্রিয় মানুষদের সঙ্গে বসে নির্ভেজাল আড্ডায় সময় কাটিয়েছে, যেখানে না আছে চাকরির দম্ভ কিংবা পকেটে জোরের মাপবিচার। সেখানে থাকার কথা নির্মল অনুভবের আদান-প্রদান, যেমনটা হয়তো আজ থেকে তিন দশক আগে ছিল। আমরা এতটাই একা যে, কাঞ্চনজঙ্ঘার নিসর্গ উপভোগের চেয়ে সেখানে লাইভ করতে বেশি উদ্যোগী। বাবা-মাকে কতখানি সময় দিলাম, সেটা তো তাঁদের কত টাকা পাঠালাম বা কী কিনে দিলাম তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ! সবাই কি তা মানেন? ভার্চুয়াল হতে হতে এক দিন এ ভাবে কাছের মানুষগুলো পর্দার বাইরে অপরিচিত হয়ে উঠবেন না তো?

এই প্রবন্ধ ছোটবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল আর টেনে আনল এমন কিছু স্মৃতি যা ছিল মনের গভীরে। হয়তো সমাজমাধ্যমে এই স্মৃতি রাখার জায়গা নেই, কারণ এটা যে কোনও ‘স্টোরি’ নয়।

চার্বাক চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-২

নারীর পূজা

জ্ঞানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিভেদ নেই। তাই পুজোর ক্ষেত্রেও লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়। অতীতে যে কোনও পুজো-উৎসবে, প্যান্ডেলে, মন্দিরে, বাড়ির ঠাকুরদালানে সাধারণত মহিলাদের প্রাধান্য বরাবরই লক্ষণীয় ছিল, কিন্তু পৌরোহিত্যের দায়িত্বে থাকতেন ব্রাহ্মণ পুরুষেরা। বিগত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে সরস্বতী পুজোয় সে নিয়ম বদলেছে। এখন মহিলাদের পুরোহিত আসনে বসে নিষ্ঠা-সহকারে পুজো করতে দেখা যাচ্ছে।

সম্প্রতি জানা গেল পূর্ব মেদিনীপুরের নয়াপুট সুধীরকুমার হাই স্কুলে ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপকই স্কুলে বরাবর সরস্বতী পুজো করার দায়িত্ব পায়। সে নিয়মেই এ বার একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া অরুণিমা নায়কের উপর ভার পড়েছে। কাজেই বড় পরিসরে পুজো করার সুযোগ পেয়ে যথারীতি প্রস্তুতিও নিয়েছে ছাত্রীটি। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমানাধিকারের ভাবনাকে জাগাতে এই অভিনব পদ্ধতি প্রশংসনীয়। সরস্বতী বিদ্যার দেবী, সবাই তাঁর কাছে সমান। সুতরাং নারীরা সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে যাবেন কেন!‌ এ বারে সরস্বতী পুজোয় অনেক জায়গায় পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নিয়েছেন মহিলারা যা খুবই আনন্দের। শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাড়িতেও দেখা যাচ্ছে ভক্তি-সহকারে পুজো, পুষ্পাঞ্জলি ও দেবীর আরতি করছেন মহিলারা। ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়ে পুজো করতে এগিয়ে এসেছেন মহিলারা। চন্দননগরের শিক্ষায়তনে পুরোহিতের আসনে দায়িত্ব সামলেছেন ওই কলেজেরই ছাত্রী। তাঁর উচ্চারণ করা মন্ত্রেই গলা মিলিয়ে অঞ্জলি দিয়েছেন অন্য ছাত্রছাত্রীরা। ইউটিউব ও পাঁচালি দেখে পুজো করেছেন তিনি। সবাই প্রশংসা করেছেন।

কাজী নজরুল তাঁর কবিতায় বলেছেন, “বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” একুশ শতকের নারীরা কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই। তাঁরা যেমন রাঁধতে জানেন তেমনই চুল বাঁধতেও জানেন। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমান তালে সব কিছু করতে পারেন তাঁরা। সেখানে বাদ থাকবে কেন পৌরোহিত্য?

উৎপল মুখোপাধ্যায়, চন্দননগর, হুগলি

পূজার ছলে

‘তিনটি সরস্বতী পুজো, নালিশ ব্রাত্যর কাছে’ (৩-২) প্রতিবেদন প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা। এমন অশান্তির আবহে সরস্বতী তুষ্ট হলেন কি? তর্ক-বিতর্ক, হুমকি, প্রাক্তনী বা বহিরাগতদের দাদাগিরি, দলীয় মতামত— সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে কি পুজো অনুষ্ঠিত হতে পারে না?

এই একটি পুজোয় কিন্তু ধর্মীয় প্রভাব গৌণ। বাড়ির কড়া অভিভাবকরাও এই দিনটিতে এত প্রশ্রয়, ছাড় দেন যে কচি-কাঁচারা উৎসাহ-উদ্দীপনায়, আনন্দে আকুল হয়ে ওঠে। তা হয় কোনও ধর্মবোধ ব্যতীতই। স্কুলে যাওয়াটা সে দিন বড়ই আহ্লাদের বিষয়। কবে থেকেই বা সারস্বত দিনটি প্রেমের দিন হিসাবে মান্যতা পেল, সে সব নিয়ে অসংখ্য গল্প, প্রতিবেদন রচিত হয়েছে, হবেও। সব মিলিয়ে কোথাও যেন এই কথাটি প্রতিধ্বনিত হয়— সরস্বতী পুজোর সঙ্গে ধর্মভেদের যোগ নেই।

খবরে যখন উঠে আসে একটি মুসলমান বাড়ির যুবক প্রতিমা বানিয়েছেন, তাঁদের পরিবারে সোৎসাহে সরস্বতী পুজো হয়েছে, তখন ভারী আনন্দ হয়। আবার কোনও এক প্রত্যন্ত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীরাই সোৎসাহে হিন্দুদের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থেকে সরস্বতী পুজোর আয়োজনে শামিল হন, কারণ, তাঁদের পরবেও হিন্দুরা যোগ দেন। এই বোধই যথার্থ গণজাগরণ, যা এই মুহূর্তে ভীষণ প্রয়োজন। বলিউডে যখন জনপ্রিয় খান-বাদশারা সিদ্ধিদাতার পুজোতে মেতে ওঠেন, তাঁদের প্রতিমা কেনা থেকে পুজো, বিসর্জন অবধি হরেক ছবি প্রচারিত হয়, তখন কি ধর্মভেদের কারণে কোনও সমস্যা হয়? এই পরিবেশই তো কাম্য।

ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

saraswati puja study Culture

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}